কোনও ব্যক্তির সামাজিক এবং নৈতিক জ্ঞানচর্চার প্রকাশে ভাষা-সংস্কৃতির অবদান নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। কোনও দেশের রাষ্ট্রিয় কাঠামোয় ভাষা এবং ভাষাকেন্দ্রিক একধরনের প্রভাব, প্রতিপত্তি, একইসঙ্গে অধিকার কায়েমের এক সূক্ষ্ম লড়াই চলতে থাকে, সময়ের পর সময় পেরিয়ে। বলা যেতে পারে একধরনের রাজনৈতিক তরজাও চোখে পড়ে ভাষাকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানকে লক্ষ্য করে। সহজ একটি প্রসঙ্গ এই ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। ভারতীয় সংবিধান অনুসারে সারা ভারতে প্রায় ২৩টির মতো ভাষাকে উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ভাষাসমূহের মধ্যে প্রশাসনিক এবং সরকারি অন্যান্য কাজের ক্ষেত্রে মান্যতা পায় হিন্দি ভাষাটি। বলাবাহুল্য ভারতের মাটিতে হিন্দি ভাষাভাষি মানুষের সংখ্যা এবং সেইসঙ্গে ভাষাটির ব্যবহার এত বেশি যে এ দেশের বাইরে অনেক দেশেই ভারতের রাষ্ট্রিয় ভাষা হিসেবে হিন্দিকে চিহ্নিত করার প্রবণতা লক্ষণীয়। এই ক্ষেত্রে আমাদেরও কিঞ্চিত ভূমিকা রয়েছে।
ভাষা যেহেতু একটা জাতির সাংস্কৃতিক মনন এবং চিন্তনের ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করে, কাজেই কোনও ভাষা শিক্ষণের মধ্যে দিয়ে আমরা একরকমভাবে ওই ভাষাটিকেও রপ্ত করে নেওয়ার একধরনের প্রচেষ্টা করে থাকি। আমরা বলতে খুব মোটা দাগে আমি পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী বাঙালি এবং বাংলা ভাষাভাষি মানুষদের কথাই বলতে চাইছি। পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের অন্যান্য স্থানে বসবাসকারী বাঙালির মনে ইদানীং একধরনের বাংলা না বলার প্রবণতা, একইসঙ্গে হিন্দির ঢং-এ বাংলা বলার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। এর বিপরীতেই রয়েছে বাংলাদেশে বাংলা ভাষাভাষি মানুষদের কথা। সেই বিষয়টি নিয়ে পরে আলোচনা করা হবে। হিন্দি ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি আমার ব্যক্তিগত কোনও বিরূপ মনোভাব নেই। তবে বাংলা ভাষার এইধরনের সংমিশ্রিত রূপ দেখতেও খুব একটা ইচ্ছা প্রকাশ করি না। বাঙালি এখন কিঞ্চিত হিন্দিভাষীদের, ক্ষেত্রবিশেষে অন্যান্য সংস্কৃতির ধারাবাহিক রীতি-নীতিকে আত্মস্থ করতে ব্যস্ত। ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’- সত্তাটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক, তবে কচুরি যখন বাঙালির মুখে ‘কচৌরি’ অথবা লুচি যখন তার ভোল বদলে ‘পুরি’তে পরিণত হয় তখন বড্ডই শ্রুতিকটূ লাগে। শব্দসংকরের বিষয়টা না হয় ব্যাকরণগত তত্ত্বের নিরিখে বাদই দিলাম। কথায় কথায় বাঙালির মুখে হিন্দির ‘কিউ কি’-মতো করে ‘কেন কী’ বলার ধরণ বড়ই বেমানান। তাতে না হয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণ, না বজায় থাকে সাংস্কৃতিক সাতন্ত্রতা। বিষয়টি হয়ে ওঠে একপ্রকার অর্থহীন।
আলোচনা পরিসরে অন্য একটি বিষয় উল্লেখ করা যায়, অতিথি আপ্যায়নের পরম্পরায় বাঙালি চিরকালই আন্তরিক। তাঁর এই আন্তরিক স্বভাবের জন্যই কোথাও গিয়ে অন্যান্য সংস্কৃতিরও একপ্রকার সংশ্লেষণ ঘটে গিয়েছে বাঙালি চেতনাতে। এখনকার দিনে বাঙালি বিয়ের আচার অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এসেছে পরিবর্তন। গায়ে হলুদ, অধিবাস বদলে হয়েছে ‘সংগীত’, ‘মেহেন্দি’ কিংবা ‘হলদি’তে। বাঙালি এইভাবে নিজেকে, একইসঙ্গে নিজের সাংস্কৃতিক পরিসরটুকুকে বদলে নিতেই পছন্দ করছে তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বায়নের যুগে দাঁড়িয়ে নিজেকে আন্তর্জাতিক বলার তাগিদে বাঙালির অন্যতম পছন্দের উক্তি, “ জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না...”
পশ্চিমবঙ্গবাসী এলিট বহু বাঙালিই এখন আদতে ভুলেছে তাঁর মাতৃভাষা চর্চার ক্ষেত্রকে, এখন প্রায়শই ফরাসি এবং জার্মান ভাষা শেখার একপ্রকার প্রতিযোগিতা চোখে পড়ছে। ইংরেজি ভাষা শিক্ষার পরে এই দুই ভাষাচর্চা ব্যক্তির সাংস্কৃতিক বৃত্তকে অনেকাংশে পরিপূর্ণ করবে এমনটা মনে করেন অনেকেই। সেক্ষেত্রে মাতৃভাষা তদূপরি বাংলাভাষাতে শিক্ষাচর্চার ক্ষেত্রটি গৌণ হলেও সেক্ষেত্রে কোনও ক্ষতি নেই। শুদ্ধ বাংলা ভাষাতে কথা না বলতে পারার কারণে বাঙালি যতটা না লজ্জা পায়, তার সঙ্গে অনেক বেশি হীনমন্যতায় ভোগে ইংরেজি না জানার কারণে। আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান এবং বিশ্বায়নের প্যারামিটারে ইংরেজি ভাষার প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে কোনও দ্বিমত থাকতে পারে না, তবে মাতৃভাষার গুরুত্ব সেক্ষেত্রে লঘু এমনটা নয়।
২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। দিনটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের মূলেও রয়েছে একধরনের ঐতিহাসিক সূত্র। রয়েছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। বাংলাদেশের মাটিতে সংঘটিত ভাষাকেন্দ্রিক এই সংগ্রাম পরবর্তী সময়ে বহুমাত্রিক রূপ লাভ করেছে। একুশের ভাষা আন্দোলন একরকমভাবে ভাষার অধিকার এবং বাকস্বাধীতা/মতামত প্রকাশের স্বাধীন অধিকারের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতেই শিক্ষা দেয়। একুশের শহীদের সংগ্রামেও ছিল সেই কায়েমী শক্তির প্রতি একধরনের জেহাদ। মাতৃভাষার প্রতি তাঁদের অঙ্গীকার এবং দায়বদ্ধ থাকার ভঙ্গিমা।
বাংলাদেশের (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান) মাটিতে সংঘটিত এই সংগ্রামের দূরবর্তী ফলশ্রুতি কিন্তু আজও সমানভাবে তাঁদের রাষ্ট্রিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। বাংলা ভাষা চর্চা এবং একইসঙ্গে ভাষাটিকে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে তাদের প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে কুর্নিশযোগ্য। অভ্র কি প্যাড কিংবা বাংলা উইকিপিডিয়া সব ক্ষেত্রেই কিন্তু বাংলাদেশের বাংলাভাষী মানুষের নতুন নতুন উদ্যোগ রয়েছে। মিশ্র সংস্কৃতির এই যুগে অবিমিশ্রিত এবং স্বাতন্ত্র বজায় রেখে নিজ নিজ ক্ষেত্রে আরও সুন্দর হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তাঁরা। এই প্রসঙ্গে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় কোনও ভাষা-সংস্কৃতির বিকাশ তখনই সম্ভব যখন তার মধ্যে দিয়ে যথার্থ জ্ঞান চর্চার প্রকাশ হয়। সুতরাং ২১শে ফেব্রুয়ারি কেবলমাত্র বাংলা ভাষা চর্চা দিবস নয়, এই দিনটির তাৎপর্য অন্য ক্ষেত্রে।
২১ শে ফেব্রুয়ারি একরকমভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, তাই আমরা যারা বাঙালি, যাঁরা একরকমভাবে কোনও বাঙালির নোবেল প্রাপ্তির সংবাদে একরকমভাবে গর্ব অনুভব করে থাকি, সেই গর্বের পরিসরটুকুও যেন বজায় থাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই। বাঙালির বৌদ্ধিক জ্ঞান চর্চার প্রবণতা বজায় থাকুক আন্তর্জাতিক ভাষাচর্চার পাশাপাশি বাংলা ভাষাতেও। ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!’-এই আপ্তবাক্যের যেন যথোপযুক্ত মান বজায় থাকে আমাদের সার্বিক প্রকাশে। বিকাশে। প্রতিবেশী দেশের বাংলা ভাষার প্রতি যে টান, যে সম্মান, সেই সমমর্যাদার মান যেন বজায় থাকে এপার বাংলার সারস্বত জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও। বহুমুখী হয়ে উঠুক আমাদের চিন্তা পরিসর।
( আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এ এক সাধারণ নিবেদন, দিনটিকে স্মরণের উদ্দেশ্যে...)