কালের নিয়মে ইতিহাস কখনও বিস্মৃত হয়, আবার কখনও বা নতুনরূপে জেগে ওঠে বহু যুগ পরে। হুগলি জেলার পাণ্ডুয়ায় অবস্থিত ইটাচুনা রাজবাড়ির কাহিনিও কিছুটা সেইরকমই। এককালে যা ছিল ভয়ানক বর্গীদের সঙ্গে জড়িত আজ একবিংশ শতাব্দীতে তা আমার আপনার জন্যে অবারিত দ্বারের হেরিটেজ হোটেল। কিন্তু তার চৌহদ্দিতে কান পাতলেই শোনা যায় অতীতের সেই ঘটনাপ্রবাহ।
বর্গীডাঙা ইটাচুনা
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি বাংলা জর্জরিত মারাঠা বর্গীদের আক্রমণে। নবাব আলিবর্দি খানের সাহসী রুখে দাঁড়ানোকে পাত্তা না দিয়ে দুর্ধর্ষ দস্যুরা তখন ব্যস্ত বিপুলা শস্য শ্যামলা বাংলার সম্পদ লুণ্ঠনে। মুঘল শাসনের অবসান এবং মারাঠা শাসনের শুরুর সন্ধিক্ষণের এই দশকে, বার বার ঘুরে ফিরে বর্গীদের ফিরে আসতে দেখা গেছে বাংলায়।
তবে তারা সবাই কিন্তু নিজদেশে ফিরে যায়নি। বহু বর্গী তখনকার বাংলার সৌন্দর্য এবং সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে নতুন জীবন শুরু করেছিলেন এখানেই। দস্যুজীবন বিসর্জন দিয়ে তাদের পরিবার বংশানুক্রমে হয়ে উঠেছিল বাংলার আপন। সেরকমও এক বর্গী পরিবারের উন্নতির প্রতিফলন এই ইটাচুনা রাজবাড়ি, যার অন্য নাম আজও বর্গীডাঙা।
ইটাচুনা আজকে
মারাঠা বর্গী কুন্দন পরিবার বাংলায় থাকতে থাকতে হয়ে উঠেছিল কুণ্ডু। কথিত আছে শ্রী সাফল্য নারায়ণ কুণ্ডুর পূর্বপুরুষেরা ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে ইটাচুনা রাজবাড়ি স্থাপন করেছিলেন। পাণ্ডুয়ার খন্যানের কাছে অবস্থিত এই বাড়ি সেদিন থেকেই আক্ষরিক ভাবেই রাজবাড়ি। কালক্রমে বিভিন্ন সংস্থার হাত ধরে রাজবাড়ির দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে পর্যটকদের জন্যে। কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত ইটাচুনা রাজবাড়ি নতুনভাবে সেজে উঠেছে হেরিটেজ উইকেন্ড ডেস্টিনেশন হিসেবে।
ইটাচুনার অন্দরমহল
বিশাল এই রাজবাড়িটি ৫টি অংশে বা মহলে বিভক্ত। বাড়ির মহিলাদের জন্যে অন্দরমহল, গেস্ট হাউস, রান্নাবান্নার জন্যে কিচেন হাউস বা রান্না মহল, নাচমহল এবং দরবার। এই পাঁচটি মহলের বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন ঘর বর্তমানে গেস্টদের জন্যে খুলে দেওয়া হয়েছে।
ঘরগুলির নামগুলিও খুবই আকর্ষণীয়। বড় বৌদির ঘর, ঠাকুমার ঘর নামগুলির মধ্যে দিয়ে যেন ভেসে আসে শৈশবের হারিয়ে যাওয়া একান্নবর্তী আটপৌরে পরিবারগুলির কথা। প্রতিটি ঘরেই হয়েছে নবীন ও প্রবীণের সংমিশ্রণ, একদিকে যেমন আছে ভিন্টেজ ফার্নিচার, তেমনি আছে বর্তমান জীবনযাপনের জন্যে প্রয়োজনীয় সমস্ত সুবিধা।
ইটাচুনার খাওয়াদাওয়া
পর্যটকদের মধ্যে প্রচন্ড জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ইটাচুনার সাবেকি খাওয়াদাওয়া। পাত পেরে কাঁসার থালায় সাজিয়ে একে একে আপনার সামনে থাকবে লুচি, বেগুন ভাজা, শুক্তো, সোনা মুগের ডাল, মাছের কালীয়া বা মটন কষা। নিরামিষভোজীদের জন্যেও রয়েছে যথেষ্ট আয়োজন। আর শেষ পাতে? রাজবাড়ির রাজভোগ।
রহস্যময়ী ইটাচুনা
এক ঝলকে রাজবাড়ির নানা অংশ যদি আপনাকে মনে করিয়ে দেয় চেনা কিছুর কথা, তাহলে কিন্তু ঘাবড়ে যাবেন না। বহু ফিল্ম, টেলিফিল্ম এবং সিরিয়ালের শুটিং হয়েছে এখানে। লুটেরা ছবিতে খুব ভাল করে দেখা গিয়েছিল ইটাচুনার ঐতিহ্যময়ী রূপ।
তবে সাবধানে, ভূতুড়ে বলেও কিন্তু কুখ্যাত ইটাচুনা কারও কারও মতে। রাত বাড়লে নাকি নাচমহল থেকে ভেসে আসে নর্তকীদের কণ্ঠস্বর আর তাদের পায়ের ঝুমুরের রিনিঝিনি আওয়াজ।
ইটাচুনা রাজবাড়িতে থাকার খরচ
বিভিন্ন ঘর অনুযায়ী দুই জনের দিন প্রতি থাকার খরচ ভিন্ন ভিন্ন। এ+ ক্যাটাগরি রুমের ভাড়া ৪৫০০-৪৮০০ টাকা। বিলাসবহুল আয়োজনের উপর নির্ভর করে ৩০০০ টাকা থেকে ৮০০০ টাকা, বিভিন্ন দামের ঘর এখানে আপনি পাবেন। মূল বাড়িতে না থেকে আপনি বাইরের মাটির কুটিরেও থাকতে পারেন, সেক্ষেত্রে লাগবে ১৯০০ থেকে ২৪০০ টাকা। প্রতি ক্ষেত্রেই ১২% জি.এস.টি চার্জ যোগ করতে হবে।
কীভাবে পৌঁছাবেন
কলকাতা থেকে ইটাচুনা পৌঁছানোর সবথেকে নির্ঝঞ্ঝাট উপায় হচ্ছে গাড়ি করে একটি ৩/৪ ঘণ্টার ড্রাইভের মাধ্যমে। পোলবা - খন্যান রাস্তা ধরে জি.টি.রোড থেকে দুই কিলোমিটার ভেতরে এগিয়ে যান পাণ্ডুয়া গ্রামের দিকে। পাণ্ডুয়া হুগলী জেলার চুঁচুড়া সাব-ডিভিসনের অন্তর্ভুক্ত। ট্রেনে করে আসতে চাইলে আসতে হবে খন্যান স্টেশন ধরে।
কখন আসবেন
ইটাচুনা আদর্শ রাজকীয় আবেশে দিন দুয়েকের ছুটি কাটানোর জন্য। তাই শনি রবিবারের ছুটিতে এখানে বহু পর্যটক উইকেন্ড কাটাতে আসেন। বর্ষা এবং তীব্র গ্রীষ্মকাল বাদ দিয়ে বছরের যেকোনো সময় এখানে আসতে পারেন। তবে আগে থেকে রিসার্ভেশন করিয়ে রাখা বাঞ্ছনীয়।