হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত পাশ্চাত্য শিল্পের অনুকরণে স্বাধীন রাজ্য হিসাবে কোচবিহার ভারতবর্ষের অন্যতম রাজ্য, যার রাজধানী ছিল বিহার ফোর্ট। অতীতে বৃহত্তর কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল এই কোচবিহার জেলা। বলা হয়, এই স্থানে কোচ বংশ প্রায় ৫০০ বছর শাসনকার্য চালায়। ১৫৩০ সালে কোচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ এই কোচবিহারে এসে শাসন শুরু করেন। তারপর তাঁর ছেলে নরনারায়ণ এই রাজ্যকে বহুদূর বিস্তৃতি দেন। ১৭৭২ সালে ভুটানের সঙ্গে যুদ্ধের ফলে কোচবিহার রাজ ধৈর্জেন্দ্র নারায়ণ ও ওয়ারেন হেস্টিংস-এর মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে কোচবিহার ব্রিটিশদের ‘করদ’ রাজ্যে পরিণত হয়। অতঃপর শর্ত মতো কোচবিহারের অর্ধেক রাজস্ব ব্রিটিশদের দখলে আসতে শুরু করে।
১৭৭৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে এই স্থানের নতুন নামকরণ করা হয় ‘কোচবিহার’। কোচ জাতির বাসস্থান হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সময় কোচবিহার ভারত ও পাকিস্তান কোন দেশের সঙ্গে যুক্ত না হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এরপর ১৯৪৯ সালের ২৮শে আগস্ট জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভারতের সঙ্গে ‘ইন্সট্রুমেন্ট অফ আক্সেশন’ স্বাক্ষর করেন। ফলে, ওই বছর ১২ই সেপ্টেম্বর থেকে কোচবিহার ভারতে কমিশনার শাসিত প্রদেশে পরিণত হয়। ১৯৫০ সালের ১লা জানুয়ারি ভারত সরকার ব্রিটিশ আমলের ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ২৯০-এর ক ধারায় প্রাদেশিক আইনের দ্বারা কোচবিহার রাজ্যটিকে পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলায় পরিণত করে। তবে কোচবিহার গেজেট অনুযায়ী, মহারাজার নির্দেশে এই রাজ্যের সর্বশেষ নামকরণ হয় কোচবিহার। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রচিত ‘শাহজাহাননামা’ গ্রন্থে কোচবিহার নামটি উল্লেখ রয়েছে। জয়পুরের বিখ্যাত মহারানী গায়েত্রী দেবী এই কোচ রাজবংশের কন্যা।
‘ভিক্টর জুবিলী প্যালেস’ নামে পরিচিত কোচবিহার রাজবাড়ি ১৮৮৭ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ-এর রাজত্বকালে তৈরি হয়। লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসের আদলে এই রাজবাড়িটি নির্মিত। ইষ্টক নির্মিত, ক্লাসিক্যাল ওয়েস্টার্ন শৈলী দ্বারা গঠিত দোতলা ভবনটি আয়তনের প্রায় ৫১৩০৯ বর্গফুট। রাজবাড়ির সামনে রয়েছে এক প্রশস্ত চওড়া রাজপথ; যার দুই ধারে নানা রকমের গাছের সম্ভার দেখতে পাওয়া যায়। ভিতরে একটি ছোট্ট সুন্দর সুসজ্জিত উদ্যান রয়েছে এবং একটি পুকুর রয়েছে। যেখানে মাছ ছাড়াও কচ্ছপ দেখা যায়।
১৮৯৭ সালে আসামের ভূমিকম্পের প্রভাবে এই রাজবাড়ির কিছুটা অংশ প্রায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
রাজবাড়ির অন্দরমহলের ইতিকথা:
• কোচবিহার বাস স্ট্যান্ড থেকে মাত্র ২ মিনিট পথ পায়ে হেঁটে কোচবিহার রাজবাড়ি সিংহদুয়ার এসে উপস্থিত হওয়া যায়।
• এই সিংহদুয়ারে রয়েছে কোচ রাজাদের রাজ প্রতীকের চিহ্ন।
• রাজবাড়িতে প্রবেশের পূর্বেই টিকিটের ব্যবস্থা রয়েছে, যা বর্তমানে অনলাইন থেকে কাটতে হয়।
• রেনেসাঁ শৈলীতে দরবার হল নির্মিত হয়েছে।
• প্রধান গম্বুজের নীচে রয়েছে রাজসভার কক্ষ।
• তা ঠিক সামনে মেঝেতে রয়েছে একটি অদ্ভুত নকশা, যার অর্থ সত্যের জয় হোক।
• গম্বুজের নীচে কোচ রাজা-মহারাণীদের মূর্তি এবং বেশ কিছু পুরনো ছবি দেখতে পাওয়া যায়।
• রাজবাড়িতে রয়েছে একটি হাতির মাথা, যা মনে করিয়ে দেয় শিকারি রাজাদের কথা। এর সঙ্গে বেশ কিছু শিকারের চিত্র দেখতে পাওয়া যায়।
• দোতালায় রয়েছে বিলিয়ার্ড খেলার বোর্ড এবং রাজাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন আসবাবপত্র।
• শাহী শীলমোহর, সোনা ও রুপোর পত্র দিয়ে সজ্জিত রয়েছে আর একটি কক্ষ।
• হাতিয়ার কক্ষে রয়েছে তীর, বর্শা, যুদ্ধের দামামা, ঢোল, মহারাজা তলোয়ার।
• আগ্নেয় অস্ত্র কক্ষে রয়েছে আমেরিকা এবং লন্ডন থেকে তৈরি করে নিয়ে আসা বিভিন্ন কোম্পানির বন্দুক, যা শুধু কোচবিহারের রাজন্যবর্গরা নন ব্রিটিশরাও শিকারের কাজে ব্যবহার করতেন।
• দেবী কক্ষে রয়েছে বিভিন্ন দেবী মূর্তি।
• আরেকটি কক্ষে রয়েছে কোচবিহারের ভাষালিপি,জনবসতির ছোঁয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ, গয়না, তাদের নিয়মিত ব্যবহারিক দ্রব্যসামগ্রীর নিদর্শন।
• এছাড়াও রয়েছে ড্রেসিংরুম, শয়নকক্ষ, বৈঠকখানা, ডাইনিংরুম, গ্রন্থাগার, তোষাখানা, লেডিজ গ্যালারি ও ভেস্টিবিউল।
পথনির্দেশ:
ট্রেনে করে নিউ কোচবিহার রেলষ্টেশনে নেমে সেখান থেকে টোটো করে আপনি কোচবিহার রাজবাড়িতে পৌঁছাতে পারবেন।
অথবা, শিলিগুড়ি থেকে বাস করেও আপনি কোচবিহারে পৌঁছে এই রাজবাড়ি দর্শন করতে পারেন ।
খরচ খরচাদি:
যাতায়াত খরচ ছাড়া রাজবাড়িতে প্রবেশের জন্য মাত্র ২০ টাকার একটি টিকিট কাটতে হয়। এছাড়া বিশেষ কোনও খরচ নেই।