প্রথিতযশা যে সমস্ত বাঙালিদের আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে তাঁদের শীর্ষস্থানে রয়েছে ঠাকুর পরিবার। তবে ঠাকুর পরিবারের বাসস্থানের প্রসঙ্গ এলে আমাদের মাথায় যে নামগুলো উঁকি দেয়, সেগুলো হয় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি অথবা শান্তিনিকেতন। খুব বেশি হলে কলকাতার বুকে ঠাকুর বাড়ি প্রসঙ্গে পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর বংশের castle কিংবা রামনাথ ঠাকুরের কয়লাঘাটার বাড়ির কথা আপনার মাথায় আসতে পারে। তাই তো? কিন্তু আপনি কি জানেন যে, ঠাকুর পরিবারের আরেকটি ভিলা রয়েছে কলকাতা শহরের খুব কাছেই? বাংলার ঐতিহ্য সংবলিত এই ভিলা একদিনের ভ্রমণের জন্য কিন্তু বেশ আকর্ষণীয়।
"আমাদের শান্তিনিকেতন আমাদের সব হতে আপন।
তার আকাশ ভরা কোলে মোদের দোলে হৃদয় দোলে,
মোরা বারে বারে দেখি তারে নিত্যই নূতন। "
এই প্রসঙ্গে আপনার মনে হতেই পারে, তাহলে এই ভিলাটিও কি শান্তিনিকেতনেই অবস্থিত? না না, এই এই বাগানবাড়িটি হুগলি জেলার কোন্ননগরে অবস্থিত। কথিত আছে,চিত্রশিল্পী এবং শিশু সাহিত্যিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ছেলেবেলার প্রথম অঙ্কন শিক্ষা পেয়েছিলেন এই বাড়িতে বসেই।
শুধু তাই নয় এই বাড়িতে একসময় ঠাকুর পরিবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের যাতায়াত ছিল এবং স্বয়ং অবন ঠাকুরও তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছিলেন এই বাগান বাড়িতে। ১৯৪৪ সালে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'জোড়াসাঁকোর ধারে' গ্রন্থে উল্লেখিত আছে যে, তিনি এই বাগানবাড়িতে বসেই জীবনে প্রথম কুঁড়েঘর আঁকতে শেখেন। এমনকি রবি ঠাকুরের আত্মজীবনীতেও এই বাড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি নিজের আত্মজীবনীতে বলেছিলেন,
"কোন্নগরে কি আনন্দেই কাটাতুম।…
সেই সেবার কোন্নগরে আমি কুঁড়েঘর আঁকতে শিখি।…"
- জোড়াসাঁকোর ধারে, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
প্রায় ১৩বিঘা জমির উপর নির্মিত এই বাগান বাড়িটির মধ্যে আপনি খুঁজে পাবেন শান্তিনিকেতনের আভাস। গঙ্গা নদীর তীরে, চারিদিকে বড় বড় গাছপালায় ঘেরা রাজবাড়ির আদলে নির্মিত এই বাগানবাড়িটি ২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন দ্বারা হেরিটেজ বিল্ডিং-এর আখ্যায় ভূষিত হয়।
বাগানবাড়ি নির্মাণ প্রসঙ্গে কয়েকটি তথ্য
১৮৭০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাগানবাড়িটি নির্মাণ করেন। পিতার উত্তরাধিকার সূত্রেই পরবর্তী কালে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাড়ির মালিক ছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠিপত্র এবং স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় তাঁর পিতা গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাড়ি নির্মাণের উদ্দেশ্যে সেই সময় প্রচুর অর্থব্যয় করেছিলেন। শুধু তাই নয়, বাড়ির অন্দরসজ্জা এবং আসবাবপত্রের মধ্যে শৈল্পিক নৈপুণ্য ছিল। বাগান বাড়ির রাজকীয়তা এবং প্রকৃতির অত্যাশ্চর্য সৌন্দর্য দ্বারা পরিপূর্ণ থাকায় শিশু সাহিত্যিকের মনে হত তিনি যেন আলাদা জগতেই তাঁর শৈশব কাটিয়ে ছিলেন। তাঁর লেখনী থেকে এও জানা যায়, এই বাগান বাড়িতে উইকএন্ড পার্টিরও আয়োজন করা হত।
অবন ঠাকুরের মৃত্যুর পর এই ঐতিহ্যবাহী বাগান বাড়ির তেমন কোনো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। এছাড়াও বাড়িটির অংশীদার নিয়েও বিভিন্ন ধরণের মতভেদের কারণে এই বাড়িটি প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে চলেছিল। তবে কোন্ননগর মিউনিসিপালিটি সমস্ত রকম বিতর্ককে এক্কেবারে নসাৎ করে বাংলা তথা ভারতের ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধারের জন্য সমস্ত রকম ব্যাবস্থা গ্রহণ করেছেন। আর এই কাজের জন্য কোন্ননগর মিউনিসিপালিটি একটা কুর্নিশ-এর প্রাপক । এই মিউনিসিপালিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে পরবর্তীকালে এখানে অবন ঠাকুরের সংরক্ষিত স্মৃতিচিহ্ন সহযোগে একটি মিউজিয়াম এবং আর্ট কলেজ স্থাপন করা হবে।
কী কী করবেন
১. এই বাগান বাড়ির সৌন্দর্য তথা বাংলার ঐতিহ্য ঘুরে দেখতে পারেন।
২. এখানে আপনি রেনেসাঁ যুগের ইতিহাসকে খুঁজে পাবেন।
৩. অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রশিল্প কিন্তু আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
৪. সবুজে মোড়া বাগানবাড়ির পাখীর কলকাকলির মূর্ছনায় মোহিত হতে পারেন।
৫. শান্তিনিকেতনের মতো পরিবেশকে উপভোগ করতে পারেন ।
৬. বাগানের কোনও কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে বসে গেয়ে নিতে পারেন 'আজি দক্ষিণপবনে / দোলা লাগিল বনে বনে'…
৭.কিংবা একান্তে গঙ্গাপাড়ে বসে নদীর বহমানতাকে উপভোগ করতে পারেন।
৮. বিকেলের সূর্যাস্ত কে ক্যামেরাবন্দী করতে কিন্তু একদম ভুলবেন না।
সময়সীমা
পর্যটনের উদ্দেশ্যে এই বাগানবাড়িটি প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত দর্শকদের জন্য খোলা থাকে। প্রবেশেমূল্য ২৫ টাকা।
ঠিকানা
অবন ঠাকুরের বাগানবাড়ির ঠিকানা হলো - ২ মীরপাড়া লেন, কোন্ননগর, পশ্চিমবঙ্গ,৭১২২৩৫
পথনির্দেশ
ট্রেনে - হাওড়া থেকে ট্রেনে চেপে মাত্র ২৫ মিনিটের দূরত্বে পৌঁছে যান কোন্নগর স্টেশন। স্টেশন থেকে একটা টোটো ভাড়া করে পৌঁছে যান গন্তব্যে।
সড়কপথে - কলকাতা থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে বালি ব্রিজ পেড়িয়ে মাত্র ২০ মিনিটের দূরত্বে পৌঁছে যেতে পারেন অবন ঠাকুরের বাগানবাড়ি।