সরস্বতী পুজো এই নিয়ে আলোচনা শুরু করলে প্রথমেই মনে পড়ে যায় স্কুল জীবনের কথা। বসন্ত পঞ্চমী শুভ তিথিতে সকাল সকাল পরিশুদ্ধ হয়ে দেবীর আরাধনায় নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে নিয়োজিত করা। কারণ সেই সময় শিশু মনের মধ্যে একটা মিথ কাজ করত দেবীর আরাধনায় কোনও রকম বিঘ্ন হলে পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে না। আমার মনে হয় এই ছাত্রজীবনে সকলেরই এইরকম একটা ভয় মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করত। তাই নয় কি?
আবার অন্যদিকে এই পুজোকে ঘিরে ছোটবেলায় অনেক রকম প্রত্যাশাও ছিল । এই একটা দিনই শাড়ি পড়ার সুযোগ, রাত জেগে প্যান্ডেল তৈরি করা, পুজোকে কেন্দ্র করে কোনও প্রদর্শনী বা কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা, এই সব কিছুর জন্য প্রায় এক বছর আগে থেকেই পরিকল্পনা শুরু হয়ে যেত।
হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী দেবী সরস্বতী শিক্ষা, সঙ্গীত, জ্ঞানের দেবী হিসেবে পরিচিত। সর্বপ্রথম ঋকবেদে দেবী সরস্বতীর উল্লেখ পাওয়া যায় এবং বৈদিক যুগে এই দেবীর গুরুত্ব বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ ছাড়াও বৌদ্ধ এবং ভারতের কিছু অঞ্চলের জৈন ধর্মাবলম্বী মানুষরাও এই দেবীর আরাধনা করে থাকেন।
কিন্তু দেবী সরস্বতীর আরাধনা শুধুমাত্র ভারতকেন্দ্রিক নয়। বিশ্বব্যাপী মানুষ বাগদেবীর আরাধনায় ব্রতী হন । শুধু তাই নয়, বিভিন্ন দেশে এই দেবী বিভিন্ন নামে এবং রূপে পূজিত হন।
ইন্দোনেশিয়ার পাউকন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বছরের শেষ দিনটি সরস্বতী পূজার দিন হিসেবে পরিগণিত হয়। দেবী সরস্বতী শিক্ষার দেবী রূপে পূজিত হন। কথিত আছে, ভারতীয় হিন্দুরাই ইন্দোনেশিয়ায় এই পূজার প্রচলন করেন। ভারতের মতো এখানেও পুজোর দিন ফুল, পবিত্র গ্রন্থের মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে দেবীকে অর্চনা করা হয়। তবে এখানে হিন্দুরা কোনও সমুদ্রের তীরে বা কোনও পবিত্র জলাধারের কাছেই এই পূজা সম্পাদন করেন। ভারতীয় প্রথা অনুসারে এখানেও পূজার শেষে কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
থাইল্যান্ড
প্রাচীন থাই শাস্ত্র অনুসারে দেবী সরস্বতী ভগবান ব্রহ্মার স্ত্রী হিসেবে পরিচিত। এখানে হিন্দু এবং বৌদ্ধ এই দুই ধর্মের একটা মিশ্র ধারণা মিলিয়ে দেবীর রূপ নির্মাণ করা হয়েছে। দেবী সরস্বতী এখানে বাকশক্তি এবং শিক্ষার দেবী হিসেবে পূজিত হন, আর দেবীর সঙ্গী হিসেবে ময়ূর বিরাজমান আছে। আপনি কখনও থাইল্যান্ড ভ্রমণে গেলে প্রাচীন থাই ওয়াট গুলোতে হিন্দু দেব দেবীদের মূর্তি বিশেষত দেবী সরস্বতীর মূর্তি পরিলক্ষণ করা যায়।
নেপাল
নেপালে ও হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মাঘ মাসের বসন্ত পঞ্চমী দিনেই দেবী সরস্বতীর আরাধনা করা হয় ।এখানেও দেবী জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা, এবং শিক্ষার দেবী হিসেবে পূজিত হন । তবে এখানে অভিভাবকরা তাদের শিশুদের প্রথম স্কুলে ভর্তি করার জন্য এই দিনটিকে বেছে নেন । ভারতের মতো নেপালেও প্রতিটি স্কুলে সরস্বতী পূজার আয়োজন করা হয়।এখানেও ছাত্ররা সরস্বতী বন্দনা ও প্রার্থনার সাহায্যেই এই পূজা সম্পাদন করেন ।
জাপানের সরস্বতী পূজার ধারণার উদ্ভব হয়েছে ভারত থেকেই ।কথিত আছে, প্রায় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতক থেকেই এই পূজার প্রচলন শুরু হয় । এখানে দেবী সরস্বতী বেনযাইতেন নামে পরিচিত। দেবীর দুই হস্তে ধারণ করে আছেন বিওয়া( জাপানের একটি ঐতিহ্যবাহী যন্ত্র, যা মূলত সঙ্গীতের জন্য ব্যবহৃত হয় )। বেনযাইতেন এখানে সঙ্গীতের দেবী হিসেবে পরিচিত। জাপানের এনসীমা দ্বীপপুঞ্জের সাগামী বে, চিকুবু দ্বীপপুঞ্জের লেদ বিওয়া এবং ইতসুকুসীমা দ্বীপপুঞ্জের সেতো ইনল্যাণ্ড সমুদ্র নিকটবর্তী অঞ্চলে দেবী বেনযাইতেন এর বিশাল মূর্তি রয়েছে এবং প্রত্যেকদিন নিত্য পূজা সহযোগে দেবীকে অর্চনা করা হয় ।
কম্বোডিয়া
কম্বোডিয়াতে দেবী সরস্বতীর উৎপত্তি নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে । সপ্তম শতকের শাস্ত্রগুলোতে বিশেষত খেমের কবিদের রচনায় প্রথম এই দেবীর ধারণা পাওয়া যায় । তবে কম্বোডিয়ার দশম এবং একাদশ শতকের শাস্ত্রগুলো মতানুসারে অঙ্করিয়ান হিন্দুরাই প্রথম কম্বোডিয়ায় দেবী সরস্বতীর আবাহণ করেন ।এখানে দেবী সঙ্গীত, লেখনী এবং অলঙ্কারশাস্ত্রের দেবী হিসেবে পরিচিত । এখানে দেবী সরস্বতী এবং ভগবান ব্রহ্মাকে একই সঙ্গে পূজা করা হয় ।
মায়ানমার
মায়ানমারে দেবী সরস্বতীর রূপের ধারণাটা বৌদ্ধ আদলে নির্মিত । তবে ভারতীয় শাস্ত্র অনুসারে এখানেও তিনি শিক্ষার দেবী হিসেবে পূজিত হন । মায়ানমারে দেবী সরস্বতী থুরাঠাদি নামে পরিচিত, দেবীর দুই হস্তে রয়েছে পুস্তক এবং তিনি মায়ানমারের হাঁস জাতীয় কোনো পাখির উপর বিরাজমান আছেন । ভারতের মতো এখানেও ছাত্ররা পরীক্ষার আগে এই দেবীর আরাধনা করেন ।
তিব্বত
তিব্বতে দেবী সরস্বতী ইয়াং চেন মা নামে পরিচিত । এখানে তিনি সঙ্গীতের দেবতা হিসেবে পরিচিত । এছাড়াও তিব্বতে এই দেবীর ধারণা বৌদ্ধ পরিমণ্ডলে গঠিত।
বাংলাদেশ একটি মুসলিম ধর্মালম্বী দেশ হলেও, বসন্ত পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজার আয়োজন আড়ম্বর সহকারেই পালন করা হয় । এখানেও ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের মতো সমস্ত রীতি- নীতি এবং পবিত্র সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণের সাহায্যেই পূজা সম্পন্ন করা হয় ।এখানে পূজা সম্পাদন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ময়দান চত্বরে প্রত্যেক কমিটি একটি করে পূজার আয়োজন করে থাকেন। একই জায়গায় অনেক গুলি পুজো একসঙ্গে সম্পন্ন হওয়ায় আপনার মনে হতেই পারে এখানে যেন সরস্বতী দেবী মূর্তির প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে । একটি মুসলিম দেশ ও কত সুন্দর করে হিন্দু ধর্মের স্বীকৃতি রক্ষা করেন এর জন্য এই দেশের কাছে ভারতীয় হিসেবে অসংখ্য ধন্যবাদ ।