বাঙালি প্রথা এবং হিন্দু ধর্মানুসারে বিদ্যা এবং সঙ্গীতের দেবী সরস্বতীর আরাধনা হয় মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে। তবে আধুনিক কালের দেবী সরস্বতীর এই অবতারের আরও আগে রয়েছে বৈদিক আমলের দেবী বাগেশ্বরীর। তবে কালক্রমেই সেই প্রথা আপন হয়ে উঠেছে বাঙালি সমাজে। আমের মুকুল, দোয়াত কলম, বই খাতা আর বাদ্যযন্ত্র দিয়ে এই পূজার আচার উপাচার নিছক নিরস অনুষ্ঠানের বাইরে বেরিয়ে হয়ে উঠেছে শুভকাজে মনোনিবেশ করার অঙ্গীকার নতুন করে করার দিন।
আবার পুণ্য লগ্নে প্রেম করার মজাই আলাদা। হয়তো বা শুভ কাজে দেব দেবীদের আশীর্বাদ থাকলে তা অচিরেই পায় পরিণতি। এই কারণেই বোধয় সরস্বতী পূজা বাঙালিদের জন্যে নিছক একটি ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলার গুরুগম্ভীর কোনও দিন নয়। শীতের শেষ পরশের আমেজ মেখে তাই বসন্তকে আবাহন করা এই দিনটিতে পশ্চিমী ভ্যালেন্টাইন্স-ডে কে হেলায়ে হারিয়ে হয়ে ওঠে নিজস্ব প্রেমের দিন।
সরস্বতী পূজা বা বসন্ত পঞ্চমীর সাথে বাঙালি জড়িয়ে অঙ্গাঙ্গিভাবে। ছোটবেলায় আমাদের অনেকেরই আঁকাবাঁকা হাতে অ আ ক খ-তে হাতেখড়ি হয়েছে কোনও এক সরস্বতী পূজার সকালেই। সরস্বতী বন্দনার সঙ্গে মিশে গিয়েছে বই খাতা মায়ের পায়ে জমা দিয়ে ভালো রেজাল্ট প্রার্থনা করা, আর তারপর সারাদিন হৈ হুল্লোড় করে খেলে বেলানোর। হয়তো আমাদের মধ্যে কারও কারও বয়েজ স্কুল বা গার্লস স্কুলের ঘেরাটোপ কাটিয়ে প্রথম প্রেমের হাতেখড়িও হয়েছে কোনও এক সরস্বতী পূজার দিনেই!
তাই দিন শুরু হোক একটুখানি শৈশবকে স্বরণ করে। প্রিয়জনকে নিয়ে রেডি থাকুন সকাল সকাল, দুজনে মিলে ট্র্যাডিশনাল বাঙালি সাজে হয়ে উঠুন অন্যন্য, আর তাতে যদি থাকে একটু হলুদ রঙের আভাস তাহলে তো সোনায় সোহাগা। এর মাঝে কিন্তু অঞ্জলিটা দিয়ে নিতে ভুলবেন না। আর হ্যাঁ, উপোসে ফাঁকি একদিন না হয় নাই দিলেন, ধরে নিন এটা সারপ্রাইজ ডায়েটিং। তবে যদি বাড়িতে বা পাড়ার পুজো মণ্ডপে অঞ্জলি না দেওয়া হয়, তাহলে চলে আসুন আপনার স্কুল বা কলেজে। মনে করে নিন স্কুল জীবনের সরস্বতী পুজোর স্মৃতি, সবাই মিলে চাঁদা তোলা, প্রতিমা আনতে যাওয়া, একসাথে মণ্ডপের মতো করে সাজিয়ে তোলা মনে করে সেই পুরনো স্বর্ণালী দিনগুলোতে ফিরে যাওয়ার জন্যে কিন্তু সরস্বতী পূজার জুড়ি নেই।
অঞ্জলি দেওয়া হয়ে গেলে এবার উপোস ভাঙার পালা। আজ পাতে থাক শুধুই বাঙালি খাবার, কন্টিনেন্টাল আর চাইনিজের প্রলোভন এড়িয়ে। আজ হয়ে যাক একটু ওহ ক্যালকাটা, বা ভজহরি মান্না বা সিক্স বালিগঞ্জ প্লেস। চেটেপুটে খান বাসন্তী পোলাও, পাতে থাক শীত শেষের নানা সবজির ছোঁয়া। আর চাটনি পাঁপড় পেরিয়ে শেষ পাতে একটু নতুন গুড়ের কাঁচাগোল্লা।
তারপর একসঙ্গে উঠে পড়ুন কোনো একটা বিকেলের ট্রামে। কলেজস্ট্রিটের কফি হাউসে জমুক আড্ডা বা হাতিবাগানের ফুটপাথের দোকানগুলো হয়ে উঠুক আজকের সুপারমার্কেট। ঘুরে দেখুন নিউ মার্কেট। হয়ে যাক ভিক্টরিয়ার বাইরে অনেকগুলো ফুচকা। তারপর হাতে হাত ধরে বসে পড়ুন শেষ বিকেলের ময়দানে। তবে খুব সাবধান, প্রেম করার ফাঁকে অন্য কারও দিকে ঝাড়ি মারতে গিয়ে ধরা পড়লে কিন্তু আপনাকে বাঁচানোর কেউ থাকবে না।
আসলে বাঙালি মননে উৎসবের মধ্যে দিয়ে সবাইকে আপন করে নেওয়ার যে একান্ত আন্তরিক দিকটা রয়েছে, তার থেকেই কিন্তু শাস্ত্রীয় একটি অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে শৈশবের বেড়ে ওঠার সাথী, কৈশোরের ভালোলাগার সঙ্গী। তাই এত বছর পরেও কিন্তু আমাদের মনে সরস্বতী পুজোর টান আমাদের মনে সর্বদা বিরাজমান। পশ্চিমী ভ্যালেন্টাইন্স ডের জাঁক জমক তাই কখনই সরস্বতী পূজার চিরাচরিত শাশ্বত আবেগকে ভুলিয়ে দিয়ে তার জায়গা নিয়ে উঠতে পারেনি। সরস্বতী পূজোই হয়ে উঠেছে বঙ্গসমাজের অকৃত্রিম প্রেম দিবস।