নেপাল সিকিম সীমানার মধ্যবর্তী উপত্যকায় দাঁড়িয়ে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা - বহু দশক ধরে যা বহু মানুষের কাছে ঈশ্বরতুল্য প্রতীক, আবার কারও কাছে নানান কারণে বিতর্কের বিষয়।
কাঞ্চনজঙ্ঘা নামের আক্ষরিক মানে বরফ ঢাকা পাঁচটি গুপ্তধন, যা কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জের ৫টি চূড়ার পরিচয়। তিব্বতি ভাষায় কাঙ (বরফ), চেন (সুবিশাল), জ (ধন সম্পদের আধার) এবং ঙ্গা (পাঁচ) নামটি দিয়ে প্রকাশ পায় এখানকার গুপ্ত সম্পদের প্রতি মানুষজনের শ্রদ্ধা। আর সেই পঞ্চসম্পদ হল - নুন, সোনা, বহুমূল্য রত্ন, পবিত্র ধার্মিক পুঁথি এবং অপরাজেয় রক্ষাকারী বর্ম।
যাঁরা কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণ করেছেন এবং স্বচক্ষে সেই রূপ দেখেছেন, সবাই জানিয়েছেন যে কাঞ্চনজঙ্ঘা শুধুমাত্র পৃথিবীর অন্যতম উচ্চ পর্বতশৃঙ্গ তাই নয় (৮৫৮৬ মিটার), অন্যতম বিপদজনকও বটে। তাই অন্নপূর্ণা শৃঙ্গের পরেই দ্বিতীয় দুরূহতম শৃঙ্গ হিসেবে কাঞ্চনজঙ্ঘার পরিচয়।
তবে তা শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত কারণে নয়, শোনা যায় নানা রকম লোকগাথা এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা ঘিরে ঘটে যাওয়া কিছু অদ্ভুত অনির্ণনীয় ঘটনার। আসুন দেখেনি কী সেই সকল ঘটনা যার মনে আজও খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
কাঞ্চনজঙ্ঘা সম্পর্কিত নানা মিথ
কাঞ্চনজঙ্ঘার পাদদেশে সিকিমে বসবাসকারী জনজাতি লেপচারা মনে করেন পৃথিবীর আদিমতম মানব ও মানবী, যাদের থেকে সমগ্র মানবসমাজের সৃষ্টি, তাদের উৎপত্তি হয়েছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গ হতে। তাই নিজেদের ভাষায় লেপচারা নিজেদের বরফ চূড়ার সন্তান বলে অভিহিত করে থাকেন।
পবিত্র সামিট : আজ পর্যন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় কেউ পা রাখেনি। মনে করা হয় এই পর্বতমালার চূড়ায় নানা আত্মা এবং শক্তির বসবাস। তাদের সম্মানার্থে চগ্যাল কে ( প্রাক্তন সিকিম সাম্রাজ্যের রাজাধিপতি) কথা দেওয়া হয় যে ভবিষ্যতেও এই চূড়ায় কেউ আরোহণ করবে না।
তাই পর্বতারোহীদের দল সামিটের প্রান্তদেশে এসেই থেমে যান। আজ অবধি প্রায় ২০০ আরোহী চূড়ার কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছেন। তবে তাঁদের এক চতুর্থাংশ এই আরোহণ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।
কাঞ্চনজঙ্ঘার রাক্ষস : কথিত আছে, কাঞ্চনজঙ্ঘা আসলে পার্বত্য ঈশ্বর জ-ঙ্গার বাসস্থান। ১৯২৫ সালে, এক ব্রিটিশ জিওলজিক্যাল অভিযান এক দ্বীপদ প্রাণীর দেখা পায়। তাঁরা যখন স্থানীয়দের থেকে এই ব্যাপারে জানতে চান তখন তাদেরকে বলা হয় প্রাণীটি কাঞ্চনজঙ্ঘার রাক্ষস।
ভূতুড়ে গল্প : নানা প্রাকৃতিক কারণে, যেমন প্রচন্ড দুর্গম আবহাওয়া, অক্সিজেনের স্বল্পতায় আরোহীদের দৃষ্টিবিভ্রম হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই সওয়ারীদের অনেকেই নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস করেন যে তারা আত্মা বা রাক্ষস বা ভৌতিক কোনো কিছু দেখেছেন, শুনেছেন এবং অনুভব করেছেন।
এমনই এক ঘটনায় শোনা যায় এক পর্বতারোহী হিমবাহের বিভিন্ন খাতের মধ্যে থেকে বাক বিতণ্ডার আওয়াজ শুনেছিলেন। কিছু কিছু কণ্ঠস্বর চাইছিল তার নিরাপদে এগিয়ে যাওয়া, কেউ চাইছিল তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে। এর পরে ওই পর্বতআরোহী তৃতীয় কোনও আত্মার সংস্পর্শ পান (সেই আত্মা হয়তো বা মৃত কোনো প্রাক্তন আরোহীর) এবং তাঁর সাহায্যে নিরাপদে নিজের তাঁবুর পথ খুঁজে পান।
কৌতূহল উদ্রেগকারী কিছু ঘটনা
১৯৬৩ সাল : তুলশূক লিংপা নামক এক তিব্বতী সন্ন্যাসী ১২ জন অনগামী নিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে যাত্রা করেন। তাঁরা খুঁজছিলেন কোনও এক এমন অতিপ্রাকৃত প্রবেশদ্বার যার মাধ্যমে তারা জাগতিক জীবন অতিক্রম করে রূপকথার স্বর্গোদ্যানে প্রবেশ করতে পারেন। কথিত আছে তুলশূক নানা পবিত্র পুঁথি নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে উপরে উঠছিলেন। হঠাৎ করে তাঁদের সামনের সবকিছু মিলিয়ে যেতে থাকে প্রচন্ড বরফের মধ্যে। হয়েছিল হিমবাহের ধস।
এবং সেই হিমবাহের নীচে চিরতরে হারিয়ে যান তুলশূক।
১৯৯২ সাল : ওয়ান্ডা রুতকিউইকজ নামক এক পোলিশ আরোহী কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণের পথে নামেন। প্রথম মহিলা হিসাবে তিনি হিমালয়ের এই অঞ্চলের শীর্ষে উঠতে চান। তাঁর লক্ষ্য ছিল ৮০০০ মিটারের উপর উচ্চতা বিশিষ্ট পৃথিবীর সকল ১৪টি চূড়ায় আরোহণ করে বিশ্ব রেকর্ড স্থাপন করা। ওয়ান্ডাও নিখোঁজ হন এবং তার কোনও চিহ্ন আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
মনে করা হয় ঠান্ডায় জমে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।
কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানের উপর নিষেধাজ্ঞা
২০০০ সালে এক অস্ট্রিয়ান পর্বতারোহীদের দল ২০০০০ ডলারের পরিবর্তে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় ওঠার চেষ্টা করেন। বৌদ্ধ ভাবাবেগে এর ফলে গভীর আঘাত লাগে এবং ভারত সরকার কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
পরবর্তীকালে জানা যায় সিকিমের শেষ চোগ্যাল পালদেন ঠোনদুপ নামগ্যাল কোনওপ্রকার অনুমতি প্রদান করেননি। তারপরেই এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়।
"ট্যুরিজমের নামে আমাদের ধর্মের প্রতি কোনও আঘাত হতে আমরা দেব না" ধাম্মাপা নামক এক স্থানীয় সন্ন্যাসী এ ব্যাপারে মতামত রাখেন।
সিকিমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বি.বি গুরুং এ ব্যাপারে অভিমত দেন "পাহাড়ি মানুষজন যারা পর্বতমালাকে ঈশ্বররূপে পূজা করেন, তাদের ধর্মীয় ভাবাবেগেরর প্রতি সম্মান জানানোর জন্যেই এই পদক্ষেপ"।
এখনো অবধি সিকিমের এই উত্তরপূর্ব পাহাড়পথে মাত্র তিনটি সফল অভিযান করা সম্ভব হয়েছে। যদিও বর্তমানে কাঞ্চনজঙ্ঘা অঞ্চলের পাদদেশে অনেকগুলি নতুন ট্রেক রুট জনসাধারণের জন্যে খুলে দেওয়া হয়েছে - যেমন গোচে লা ট্রেক, গ্রীন লেক বেসিন ট্রেক ইত্যাদি, যার মাধ্যমে আপনি কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রকৃত সৌন্দর্যের আরেকটু কাছাকাছি আসতে পারবেন।
তাহলে, আপনার কি কাঞ্চনজঙ্ঘার এই বিপদজনক কিন্তু রোমাঞ্চকর ট্রেকগুলো করার ইচ্ছে আছে? পেলেও পেতে পারেন কোনও ইয়েতিকে হ্যালো বলার সুযোগ!