বাঙালি মানেই কিঞ্চিৎ ভোজনপ্রিয় আর অনেকটা অতীতবিলাসী... বাঙালির প্রায় প্রতিটি কথার পরতেই চলে আসে ইতিহাসচর্চার কথা, সেই সময় আর এই সময়ের একপ্রকারের তুলনামূলক আলোচনা ক্ষেত্র। চা-এর কাপে ঝড় তুলে কিঞ্চিত নিজের শিক্ষার গণ্ডিকে প্রমাণ করার জন্য বাঙালির যারপর নাই প্রচেষ্টা চলে, তা নিতান্ত-সাধারণ অথচ লোভনীয় সিঙ্গারা খাওয়ার ক্ষেত্রেও তার বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম চোখে পড়বে না।
সিঙ্গারা বা সামোসা যাই বলি না কেন, তার কিন্তু রয়েছে একটা আদি ইতিহাস, কেমন সে ইতিহাস? প্রতিবেদনটি পড়তে পড়তে আপনারও কি জানতে ইচ্ছে করছে, সেইসব খুঁটি নাটি বিষয়গুলো? তাহলে গরম গরম সিঙ্গারাতে কামড় দিতে দিতে, আর ঝাল ঝাল পুরের স্বাদ নিতে নিতে জেনে নেওয়া যাক, সেইসব গল্পকথা।
কোথা থেকে এল এই সিঙ্গারা?
কখনও ঝাল ঝাল আলুর পুর, কখনও আবার মাংসের কিমার পুর আবার কখনও চাউমিনের পুর ভরা ত্রিকোণ আকৃতির এবং কড়া তেলে ভাজা মচমচে স্বাদের খাবারটির নাম সিঙারা বা সিঙ্গারা, একথা আর কে না জানে। দক্ষিণ এশিয়াতে সিঙারা একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার। বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতে বিকেলের নাস্তাতে চা-এর যোগ্য জুটি যেন এই সিঙ্গারা। সাধারণত হিন্দি ভাষাভাষি মানুষদের মধ্যে খাবারটি সামোসা নামেই সুপরিচিত। তবে শুনলে মশাই আপনিও চোখ কপালে তুলবেন, সামোসা শব্দটি ফার্সি শব্দ ‘সানবোসাগ’ থেকে এসেছে। রন্ধনবিশারদরা আবার মনে করা হয়ে থাকেন মধ্যপ্রাচ্যে এটি প্রথম তৈরি হয়। বিভিন্ন প্রদেশের মানুষেরা যখন প্রাচ্যের দেশগুলোতে বাণিজ্যসূত্রে যাতায়াত করতেন তখন তাঁদের হাত ধরে এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন প্রদেশে এর প্রচলন শুরু হয়।
সে কোন হাজার বছর আগে
ত্রিকোণ আকৃতির এই তেলেভাজাটির জনপ্রিয়তা আজ নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। বৃষ্টির দিনে চা-সহযোগে বন্ধুদের সঙ্গে জমাটি আড্ডা দেওয়ার উপযুক্ত সঙ্গী হল সিঙ্গারা। অল্পসময়ের মধ্যেই সিঙারা বানিয়ে ফেলা যেতে পারে। ইসলাম শাসকদের মধ্যেও কিন্তু সামোসার জনপ্রিয়তা চোখে পড়েছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণের সাক্ষ্য রয়েছে এই প্রসঙ্গে। ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে আমির খসরু দিল্লির অভিজাত মুসলমান সম্প্রদায়ের খাবারের যে তালিকা বানিয়েছিলেন, তাতে এই সামোসার উল্লেখ ছিল।
এক্ষেত্রে খাবারটি তৈরি করার ক্ষেত্রে আলুর পুরের বদলে মাংস এবং পেঁয়াজের ব্যবহার লক্ষ করা যায়… একইসঙ্গে তেলের পরিবর্তে ঘিয়ে ভাজার একটা চল ছিল ওই সময়ে। আমির খসরুর প্রায় বেশ কিছু বছর পরে ইবন বতুতা যে খাবারটির নাম করেছিলেন তা হল ‘সামসুক’। মাংসের কিমার মধ্যে আখরোট, বাদাম, পেস্তা এবং পেঁয়াজ, মশলা দিয়ে ভাল করে পুর বানিয়ে ময়দার মধ্যে ঢেকে ঘিয়ে কড়া করে ভাজার মাধ্যমে খাবারটি প্রস্তুত করা হত। এখনকার সামোসার সঙ্গে সম্পূর্ণ মিল না থাকলেও সাদৃশ্য যে অবশ্যই রয়েছে তা অস্বীকার করা যায় না। মোঘল সম্রাট আকবরের শাসনকালে রচিত ‘আইন-ই-আকবরী’তে এই একই পদ্ধতিতে তৈরি হওয়া খাবারটির নাম হল ‘সানবুসা’। সুতরাং, বুঝতেই তো পারছেন, সকালের ব্রেকফাস্টে কিংবা বিকেলের আড্ডায় আপনার চা-এর সঙ্গে যোগ্য সহযোগী এই সিঙ্গারাটি কোনও মামুলি খাবার নয় বরং মধ্য প্রাচ্যের সঙ্গে রয়েছে এর গভীর সম্পর্ক।
কলকাতার কিছু বিখ্যাত সিঙ্গারার দোকান
শর্মা স্ন্যাক্স সেন্টার
দক্ষিণ কলকাতার কোনও ব্যক্তি এই দোকানটি সম্পর্কে জানেন না, এমনটা হতেই পারে না। ভবানীপুরের সুবিখ্যাত এই দোকানটিতে আপনি পেয়ে যাবেন কলকাতার অন্যতম জনপ্রিয় বোমা সিঙ্গারা, হ্যাঁ! বোম আকৃতির চেহারাই বটে তার, তবে স্বাদের ক্ষেত্রে কোনও কথাই হবে না। বোমা সিঙ্গারা ছাড়াও রয়েছে এখানে অন্যতম জনপ্রিয় সিঙ্গারার চাট, যা ছোলা-মটরের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়ে থাকে।
মহারাণী
আবারও সেই দক্ষিণ কলকাতার নাম। শরত বোস রোড ধরে যেতে যেতে আপনি দেখতে পাবেন রাস্তার ধারে এই দোকানটি, আর একান্তই যদি রাস্তার নামে চিনতে অসুবিধা হয়, তাহলে আপনাদের জন্য রইল একটা উপযুক্ত ল্যান্ডমার্কের কথা, তা হল লেক মার্কেট। তাহলে বিকেলে একদিন ঢুঁ মারবেন নাকি?
শ্রী কৃষ্ণ সুইটস
দোকানটির নামে হিন্দুয়ানি ভরপুর মাত্রাতে থাকলেও আপনি মোটেই ভাববেন না, ভবানীপুরের এই দোকানটি ছা-পোষা বাঙালি দোকান. চুপিচুপি বলে রাখি এখানেই আপনি পাবেন চাইনিজ সিঙ্গারা, মানে আলুর বদলে চাউমিনের পুর ভরা সিঙ্গারা। তাহলে একবার যাবেন নাকি?
তিওয়ারি ব্রাদার্স
তিওয়ারি ব্রাদার্স নামের সঙ্গে অনেকেই কমবেশি পরিচিত। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে তাঁদের বিভিন্ন শাখা। তিওয়ারি ব্রাদার্সের সিঙ্গারাটি বিশেষভাবেই পপুলার বলতে হবে, দামের দিক থেকে সামান্য বেশি হলেও আপনার মুখে এর স্বাদ লেগে থাকতে বাধ্য। তিওয়ারি ব্রাদার্সের বিভিন্ন শাখা রয়েছে বড়বাজার, কাঁকুড়গাছি এবং নিউ আলিপুরে।
আপনজন
আপনজনের সঙ্গে হৃদ্যতা বাড়াতে অবশ্যই চলে আসুন সদানন্দ রোডের কাছে অবস্থিত এই দোকানটিতে, বলে রাখা ভাল কালীঘাট মেট্রোস্টেশনের খুব কাছেই এটি অবস্থিত।
দক্ষিণ কলকাতায় বড় হয়ে ওঠার দরুণ আমার লেখার সিংহভাগ জুড়েই জায়গা করে নিয়েছে দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন দোকানের নাম, আপনি চাইলে অবশ্যই জানাতে পারেন উত্তর কলকাতার বিখ্যাত কিছু দোকানের নাম, তা নিয়ে অবশ্যই প্রতিবেদন তৈরি করে ফেলা যাবে।