পশ্চিমবঙ্গবাসীদের বেড়াতে যাওয়ার নেশার কথা কিন্তু কম বেশি আমরা সবাই জানি। উইকেন্ড এলেই পাহাড়প্রেমীরা ব্যাগপত্র গুছিয়ে শিলিগুড়ি হয়ে পাহাড়মুখো হন তাদের অনেকেই। কিন্তু যাদের মন পড়ে থাকে সমুদ্রের ওপর, তারা কিন্তু যান দক্ষিণে। পশ্চিমবঙ্গ এবং উড়িষ্যার উপকূলে, বঙ্গোপসাগর বরাবর পর পর আছে পূর্ব ভারত তথা সমগ্র ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীচগুলি - যেমন মন্দারমণি, শংকরপুর এবং আরও কত কি!
আসুন, দেখেনি এই অঞ্চলের কিছু বিখ্যাত এবং কিছু এখনও নিভৃত নির্জন বিচ ডেস্টিনেশনের কথা, যা লকডাউনের পরে হয়ে উঠতে পারে আপনার ছুটি কাটানোর পছন্দসই গন্তব্যস্থল।
বঙ্গোপসাগরের উত্তর প্রান্তে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য জুড়ে রয়েছে মন্দারমণি, যা কালক্রমে হয়ে উঠেছে বাঙালিদের অন্যতন প্রিয় ভ্রমণকেন্দ্র। কয়েকদিনের জন্যে রোমান্টিক আবেশে হারিয়ে যাওয়ার জন্যে মন্দারমণির জুড়ি নেই। সুদীর্ঘ বিচে ইচ্ছে করলে আপনি বাইকে বা গাড়িতে করে হালকা একটা ড্রাইভেও বেরিয়ে পড়তে পারেন। সমুদ্রের হওয়া খেতে খেতে উইকেন্ড কাটানোর এর থেকে ভাল উপায় আর নেই। তবে এখানে ছুটি কাটানোর আগে জোয়ার ভাটার সময় জেনে নিয়ে সেই সম্পর্কে সতর্ক থাকা উচিৎ।
কীভাবে পৌঁছবেন : কলকাতা থেকে কন্টাই হয়ে মন্দারমণি পৌঁছতে সময় লাগবে প্রায় ৩ ঘণ্টা। এছাড়া ট্রেনে করে দীঘা গিয়ে, স্টেশন থেকে গাড়ি করেও মন্দারমণি পৌঁছতে পারেন।
সুন্দরবনের এক দ্বীপে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য। সাগরদ্বীপের সুখ্যাতি কিন্তু বার্ষিক গঙ্গাসাগরের মেলা থেকেই প্রাপ্ত, যা অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বছর জানুয়ারির মাঝামাঝি। হাজার হাজার পুণ্যার্থীরা ভিড় করেন এই সময়ে। বছরের অন্যান্য সময়ে কিন্তু সাগরদ্বীপ হয়ে থাকে একান্ত নিরিবিলি, ছুটি কাটানোর জন্য আদর্শ বলতেই হবে। সাগরদ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে আলাদা মাত্রা যোগ করে বিচের উপরের লাইটহাউসটি।
কীভাবে পৌঁছাবেন : এস্প্ল্যানেড থেকে বাসে করে প্রথমে চলে আসুন কাকদ্বীপে। বোটে করে মুড়িগঙ্গা নদী পেরিয়ে নামুন কছুবেড়িয়াতে। সেখান থেকে বাসে করে ৩০ কিলোমিটার দুরত্বে সাগরদ্বীপ।
৩. শহুরে জীবন থেকে অনেকদূর - শংকরপুর
কলকাতা থেকে সিংহভাগ ট্যুরিস্ট মন্দারমণি ছুটে গেলেও, শংকরপুর থাকে সেই তুলনায় অনেক শান্ত এবং নিরিবিলি। দীঘা এবং মন্দারমণির মাঝামাঝি অবস্থিত এই ছোট্ট জেলেগ্রামটি এখনও অত্যধিক ভ্রমণ বা বাণিজ্যের চাপে ঢাকা পরে যায়নি। তাই সপরিবারে চলে আসুন শংকরপুর, আর এখানে থাকাকালীন স্থানীয় রেস্টুরেন্টগুলো থেকে খেয়ে দেখুন চিংড়ি, পমফ্রেট, রুই, কাতলা, পার্শে, ভেটকি এবং আরও কত কী।
কীভাবে পৌঁছবেন: এস্প্ল্যানেড থেকে দীঘাগামী বাসে করেই শংকরপুর পৌঁছাতে পারবেন। রামনগরের ঠিক আগে চোদ্দ মাইলের বাসস্টপে নেমে এগিয়ে যান শংকরপুরের দিকে।
৪. পা ডোবান ফলতার সমুদ্রে
দীঘা বা মন্দারমণির মতো অতটা জনমানসে বিখ্যাত না হলেও জনসমাগমের নিরিখে ফলতা কিন্তু খুবই জনপ্রিয়। ফলতার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে এখান থেকেই সিরাজউদ্দৌল্লার বাহিনী কলকাতার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল এবং পরবর্তীকালে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ইংরেজ সরকারের বাংলা দখলও শুরু হয়েছিল ফলতা থেকেই। সূর্যাস্তের সময় দামোদর এবং হুগলি নদীর মোহনার অপরূপ সৌন্দর্য ফলতার জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ।
কীভাবে পৌঁছবেন : কলকাতা থেকে ট্রেনে করে ফলতার নিকটবর্তী রেলস্টেশন মহিষাদহরী প্রায় ১ ঘণ্টার পথ। তাছাড়াও কলকাতা থেকে সরাসরি ট্যাক্সি করেও যাওয়া যায়।
৫. চলুন দীঘা - কলকাতার প্রিয় সমুদ্র উপকূলে
ফ্যামিলি হোক বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে, বাঙালিদের কাছে ছুটি মানেই দীঘার বিচে ছুটে যাওয়া। অসাধারণ বিচ ছাড়াও দীঘার শিবমন্দির এবং ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ সায়েন্স মিউজিয়াম দ্বারা প্রতিষ্টিত সায়েন্স সেন্টারটিও পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সমুদ্রের পার্শ্ববর্তী ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্রতটটি সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের অপরূপ রূপ দেখার পক্ষে আদর্শ।
কীভাবে পৌঁছবেন : কলকাতা থেকে ট্রেনে করে দীঘা যেতে সময় নেয় ৩ ঘণ্টা। তবে অনেকেই কিন্তু এস্প্ল্যানেড থেকে বাস ধরেও দীঘার উদ্দ্যেশে যাত্রা করেন।
৬. হয়ে উঠুন জুনপুটের নোনা হওয়ায় মাতোয়ারা
জুনপুটের খ্যাতির পিছনে অন্যতম অবদান ব্র্যাকিশ ওয়াটার ফিস কালটিভেশন এন্ড রিসার্চ সেন্টার মিউজিয়ামের। মৎস্যবিভাগের দ্বারা পরিচালিত এই মিউজিয়ামে দেখা পাবেন প্রচুর পরিমাণে বিরল প্রজাতির মাছ, সাপ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর। জুনপুট বিচে ক্যাসুরিনা গাছ দ্বারা সজ্জিত মায়াবী আবহে পর্যটকরা বিশ্রাম খুঁজে নিতে পারেন। কাছের দরিয়াপুরের লাইটহাউস এবং কপালকুণ্ডলা মন্দিরটিও দেখে আসতে পারেন।
কীভাবে পৌঁছবেন : কলকাতা থেকে দীঘার ট্রেনে উঠে নেমে পরুন কন্টাই-এ। শেয়ার জিপে চেপে ৯ কিলোমিটার দুরত্বে অবস্থিত জুনপুটে চলে আসুন। এছাড়া কলকাতা থেকে বিদ্যাসাগর সেতু হয়ে গাড়ি করেও জুনপুট যাওয়া যায়।
পশ্চিমবঙ্গের উপকূলরেখার দক্ষিণ প্রান্তে, সুন্দরবনের ব-দ্বীপ অঞ্চলের গা ঘেঁষে অবস্থিত চন্দ্রকলা আকৃতির এই বীচটি। এই ব-দ্বীপ অঞ্চলের বিভিন্ন দ্বীপগুলো নিজেদের মধ্যে ব্রিজ দিয়ে সংযুক্ত। এখানকার তটের শক্ত মাটির উপর দিয়ে সাইকেল চালানোর মজাই আলাদা। পরিষ্কার মসৃণ নির্জন বিচ, মনমাতানো সামুদ্রিক হওয়া এবং অসীমে বিস্তৃত নীল আকাশের তলায় বকখালিতে কাটানো সময় হয়ে থাকবে চিরস্মরণীয়।
কীভাবে পৌঁছবেন : কলকাতা থেকে বকখালির দূরত্ব ১২৫ কিলোমিটার। গাড়ি করে সময় লাগে ৪ ঘণ্টা।
মন্দারমণি এবং শংকরপুরের মধ্যবর্তী অংশে অবস্থিত তাজপুর বিচ কিন্তু তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোর তুলনায় অনেকটাই শান্ত। পশ্চিমবঙ্গের সমুদ্রপ্রেমীদের মনে তাজপুর কিন্তু খুব কম সময়েই প্রিয় জায়গা করে নিয়েছে। তাজপুরের বালিয়াড়িতে গড়ে ওঠা নানা ডোবা বা পুকুরে মাছ ধরা পর্যটকদের নতুনভাবে আকর্ষণ করছে। এই অঞ্চলের প্রায় ১৪০০০ একর জমি মৎস্যচাষ এবং মৎস্য গবেষণায় নিয়োজিত। তাজপুরের ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়ার বাহুল্য এই অঞ্চলের আরেক দর্শনীয় ব্যাপার।
কীভাবে পৌঁছবেন : কলকাতা থেকে তাজপুরের দূরত্ব ১৮৫ কিলোমিটার, গাড়ি করে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টার রাস্তা। নিজের গাড়ি বা শেয়ার ট্যাক্সি চেপে সহজেই তাজপুর পৌঁছে যেতে পারেন।