জৈন ভগবতী সূত্র অনুসারে ১৬ টি মহাজনপদের অন্যতম একটি জনপদ হল পুরুলিয়া; যা মেদিনীপুর বিভাগে অবস্থিত সবচেয়ে কম জনঘনত্ব বিশিষ্ট একটি অঞ্চল। প্রাচীনকালে বজ্রভূমি নামে পরিচিত এই জেলাটি পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সর্বাপেক্ষা কম বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চল হিসেবেও পরিচিত ছিল।
বিশেষ আকর্ষণ:
• সিধু কানু বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়
• অযোধ্যা, বাঘমুন্ডি, পাঞ্চেত পাহাড়
• কংসাবতী, দামোদর, সুবর্ণরেখা, কুমারী নদী
• ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা অঞ্চল
• ব্রাহ্মণী জলপ্রপাত
• সাঁওতালডিহি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র
• টুসু, ভাদু, ছৌ নাচ
পরিবহণ ব্যবস্থা:-
• হাওড়া থেকে চক্রধরপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার।
• রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস।
• আরণ্যক এক্সপ্রেস।
• পুরুলিয়া এক্সপ্রেস।
• এছাড়াও কলকাতার ধর্মতলা থেকে এসবিএসটিসি বা প্রাইভেট বাসে যাওয়া যায়।
• নিজস্ব গাড়িতে যেতে হলে প্রথমে আসানসোল থেকে দুর্গাপুর হয়ে সড়ক পথে পুরুলিয়া প্রবেশ করতে পারবেন।
থাকবার জায়গা:-
• অযোধ্যা হিলটপে ডব্লিউবিসিএসডিসি গেস্ট হাউস।
• গড়পঞ্চকোট নেচার রিসোর্ট।
• মাথা ট্রি হাউস।
• পুরুলিয়া ইয়ুথ হোস্টেল।
• জয়চন্ডী পাহাড় ইয়ুথ হোস্টেল।
• অযোধ্যা হিলটপ ইয়ুথ হোস্টেল।
উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান:-
পাহাড়:-
অযোধ্যা পাহাড়:
দলমা পাহাড় এবং পূর্বঘাট পর্বতমালার সম্প্রসারিত একটি অংশ এই অযোধ্যা পাহাড়। এই পাহাড়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গটি হল গোরগাবুরু। ঝালদা এবং সিকরাবাদ এই দুটি পথ ধরে অযোধ্যা পাহাড়ে পৌঁছনো যায়। এখানে একটি ফরেস্ট রেস্ট হাউস রয়েছে।
পাখি পাহাড়:
প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী চিত্ত দে তাঁর অসামান্য শিল্প নৈপুণ্যতার চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটিয়ে এই পাহাড়ের গায়ে পাথর কেটে গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন পাখির চিত্র, যা পর্যটকদের মনোরঞ্জনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়াও এখানে রক ক্লাইম্বিং-এর ব্যবস্থাপনাও রয়েছে।
জয়চণ্ডী পাহাড়:
এই পাহাড় থেকে আপনি আশেপাশে প্রাকৃতিক পরিবেশের সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। এছাড়াও এই পাহাড়ে রয়েছে একটি মন্দির, যা ‘জয়চণ্ডী মন্দির’ নামে পরিচিত।
এছাড়াও বিভিন্ন পাহাড়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘পাঞ্চেত’ এবং ‘বাগমুন্ডি’।
ড্যাম
পুরুলিয়া জেলায় পাহাড়ের সারি এবং শান্ত জলধারার মধ্যস্থলে অবস্থিত ড্যামগুলো হল- লোয়ার ড্যাম, আপার ড্যাম, মুরগুমা ড্যাম, বারানতি ড্যাম ইত্যাদি। এর মধ্যে কিছু কিছু ড্যামের পাশে বিভিন্ন রিসোর্ট রয়েছে। যেখানে থাকার বন্দোবস্ত আছে। ড্যামগুলোর যাত্রাপথে পর্বত শৃঙ্গ ও বিভিন্ন লেকের পাশে অবস্থিত সুন্দর রাস্তার সঙ্গে পরিচয় ঘটবে। লোয়ার ড্যামে পিকনিক স্পট রয়েছে এবং আপার ড্যামের মধ্যেখানে পাওয়ার হাউজ অবস্থিত।
জলপ্রপাতএবং বিভিন্ন মন্দির
জেলেপাড়া দুর্গা মন্দির, লহরিয়া শিব মন্দির, লহরী রাম মন্দির, লহরী হরি মন্দির প্রভৃতি। কিছু উল্লেখযোগ্য জলপ্রপাত হল ব্রাহ্মণী জলপ্রপাত, তুর্গ জলপ্রপাত।
চড়িদা গ্রাম
পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষে বিখ্যাত ছৌ নাচের মুখোশ তৈরির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হল এই গ্রামটি। বাগমুন্ডি থানা অন্তর্গত চরিতা গ্রামের চল্লিশটি সূত্রধর পরিবার এবং জয়পুর থানার ডুমুরডি গ্রামের পাঁচটি পরিবার ছৌ নাচের মুখোশ তৈরি করেন।
গড়পঞ্চকোট
বর্গী আক্রমণের ফলে এখানকার সমস্ত স্থাপত্য ভাস্কর্যের প্রায় ভগ্নপ্রায় অবস্থা। তবে এসবের মধ্যেও একটি মন্দির এখনও অবশিষ্ট রয়েছে, যা পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় বিষয়বস্তু।
সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন:
ছৌ নৃত্য:
পুরুলিয়া জেলা ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রাম মহাকুমার অন্যতম একটি আকর্ষণীয় বিষয় হল পুরুলিয়া ছৌ। এই ভারতীয় আদিবাসী যুদ্ধনৃত্যের উৎপত্তিস্থল পুরুলিয়া জেলা। পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়খন্ড, ওড়িশা জেলাতেও এর ব্যাপকতা লক্ষ করা যায়। তাই ছৌ নৃত্যকে তিনটি উপবর্গে ভাগ করা হয়েছে যেমন - পুরুলিয়া ছৌ, সরাইকেল্লা ছৌ এবং ময়ূরভঞ্জ ছৌ। ১৯৯৫ সালের নিউ দিল্লিতে প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের তরফ থেকে ট্যাবলোর থিম ছিল ছৌ নাচ। ছৌ নৃত্যের নামকরণ নিয়ে বহু মতভেদ রয়েছে। বলা হয়, কুর্মালী ও ওড়িয়া ভাষায় ‘ছুয়া’ শব্দের অর্থ ‘ছেলে’। তাই এই নৃত্য ছেলেরা পরিবেশন করে বলেই এর নাম ছৌ নাচ। অপরদিকে, রাজেশ্বর মিত্রের মতে এটি তিব্বতী সংস্কৃতির ‘ছাম’ নৃত্য থেকে এসেছে। তবে ডক্টর সুকুমার সেন বলেছেন যেহেতু এই নৃত্যে মুখোশ একটি অপরিহার্য অংশ তাই মুখোশ থেকেই এরকম নামের আবির্ভাব হয়। এই নাচে বান্দোয়ান ও বাগমুন্ডি দুটি ধারা দেখা যায়।
মূলত ডোম, মুন্ডা, মাহাতো সম্প্রদায় এই নাচ পরিবেশন করে থাকে। ছৌ নৃত্যের বিষয়বস্তু হিসেবে মহাকাব্যিক বিষয় যেমন- রামায়ণ-মহাভারতের বিভিন্ন উপাখ্যান অভিনয় করা হয়। এছাড়াও কোথাও কোথাও পৌরাণিক কাহিনীও পরিবেশন করা হয়। নাচের মূল রস হল বীর ও রুদ্র। নৃত্যের শুভ সূচনা হয় ঢাকের বাদ্যর সঙ্গে। তারপর গীতিকার গণেশ বন্দনা করেন এবং সবশেষে বাজনা বাজাতে বাজাতে দুষ্টের দমন এবং ধর্মের জয় দেখানো হয়। ছৌ নৃত্যে ঝুমুর গানের প্রভাব দেখা যায়। এই নৃত্যের মাধ্যমে মুখে মুখোশ পরে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কম্পন, সংকোচন-প্রসারনের মধ্যে দিয়ে চরিত্র অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটায় শিল্পীরা। ছৌ নাচের মধ্যে দেবচাল,বীরচাল,রাক্ষসচাল,পশুচাল প্রভৃতি বিভিন্ন রকমের চাল দেখা যায়।
করম পুজো:
ঝাড়খণ্ড, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ছত্তিশগঢ়, অসম. ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলায় এই ফসল কাটার উৎসব পালিত হয়ে থাকে। এটি প্রধানত কোন দেবতার উপাসনা উৎসব বাগদী মুন্ডা খাসি সাঁওতাল মাহাতো রাজপুত সম্প্রদায় মূলত এই আরণ্যক ও কৃষিভিত্তিক লোক উৎসব পালন করে থাকে। ভাদ্র মাসের শুক্ল একাদশী তিথিতে এই করম পরবঅনুষ্ঠিত হয়।
টুসু উৎসব:
পুরুলিয়া জেলার এক অন্যতম কৃষিভিত্তিক উৎসব হল এই টুসু। অগ্রহায়ণের শেষ দিনে শুরু হয় এই উৎসব আর শেষ হয় পৌষ সংক্রান্তির শেষ বেলায়। লৌকিক দেবী কুমারী পুজো করা হয়। এই টুসু পরব শেষে নদীতে দেবীকে বিসর্জন দিয়ে পরা হয় নতুন বস্ত্র। পুরুলিয়া ছাড়াও বাঁকুড়া,বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমা এবং ঝাড়খণ্ডের রাঁচি, হাজারীবাগ এই সমস্ত জায়গায় গিয়ে টুসু পরব দেখতে পাওয়া যায়।
ভাদু পুজো:
ভাদ্র মাসের পয়লা তারিখে এই পুজো করা হয়। প্রধানত কুমারী মেয়েরা এই পুজো করে থাকে। ভাদু পুজো নির্দিষ্ট কোনও মূর্তি হয় না। এই সময় বাড়ির মেয়েটা ভাদু গান গায়। প্রধানত ভাদু গান রাধা- কৃষ্ণর প্রেম ও বারো মাস জীবনের সুখ-দুঃখের কথা নিয়ে গানগুলো তৈরি করা হয়। বীরভূম জেলায় উৎসব পালিত হয়।
ছাতা পরব:
পুরুলিয়া জেলার অন্যতম প্রাচীন জনপ্রিয় একটি লোক উৎসব হল ছাতা পরব। প্রায় পাঁচশো বছর ধরে এই অনুষ্ঠান এখানে হয়ে আসছে। ভাদ্র মাসের শেষ দিনে পঞ্চকোট রাজবাড়ি সদস্যদের হাতে এক বিশাল সাদা ছাতা দেওয়া হয় এবং তারা সেই ছাতা খোলার মধ্যে দিয়ে উদ্বোধন করা হয় এই অনুষ্ঠানের। এছাড়াও এখানে বিভিন্ন গান-বাজনা এবং আঞ্চলিক রীতি মেনে এই অনুষ্ঠান পালিত হয়।
পুরুলিয়া ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্ত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠানগুলোরও দর্শন মেলে। তাই বলা ভাল, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং প্রাচীন সংস্কারের মেলবন্ধনে গড়ে উঠেছে এই পুরুলিয়া জেলা।