ভুটান ভ্রমণ মানেই জঙ্গল এবং পাহাড়কে কেন্দ্র করে একটা রোমাঞ্চকর ট্রিপ। কিন্তু এই ট্রিপের সঙ্গে এই দেশের খাবারও বিশেষভাবে জড়িয়ে আছে। দেশীয় উপকরণ এবং মশলা দ্বারা সংমিশ্রিত সমস্ত খাবার গুলি কিন্তু বেশ সুস্বাদু। সমস্ত ভোজনরসিক মানুষের জন্য ভুটানের অথেন্টিক খাদ্যের স্বাদ পেতে কয়েকটি সেরা হোটেলের সন্ধান রইলো।
বিখ্যাত ভুটানীয় খাবার
ভ্রমণকালীন সময়ে আমি ভুটানের স্থানীয় খাদ্য এমা দাৎসী (লঙ্কা এবং চিস সহযোগে নির্মিত একটি খাদ্য ) টেস্ট করার সুযোগ পাই। প্রত্যেকটা ভুটানীয় খাবারের সাথে এমা দাৎসী পরিবেশন করা হয় এবং ভুটানিরা খুব যত্ন সহযোগে এই খাবার তৈরি করেন। ভুটানের আরেকটি বিখ্যাত খাদ্য হল এগ মারও (চিস মিশ্রিত স্ক্র্যাম্বলড এগ)। আমি ভুটানের ঐতিহ্যবাহী রেড রাইসের সঙ্গে এগ মারও খেয়েছিলাম। এই স্থানীয় খাবারের মধ্যে আমি জিভে জল আনা স্বাদ পেয়েছিলাম। যারা স্যুপ ভালোবাসেন তাঁরা ভেজিটেবিল বাথুপ (এটি মূলত পালং শাকের স্যুপ) ট্রাই করে দেখতে পারেন। এই স্যুপটি সুস্বাদু এবং যথেষ্ট পুষ্টিকর। পরিশেষে, উত্তর পূর্ব ভারত থেকে তিব্বত এমনকি ভুটানেও মোমো যথেষ্ট প্রসিদ্ধ; (সিদ্ধ মোমো এবং ফ্রাইড মোমো দুইই উপলব্ধ আছে) তাই এটি টেস্ট করতে কিন্তু একদম ভুলবেন না।
পর্ক এবং বিফ রন্ধনের ক্ষেত্রে ভুটানীরা কিন্তু যথেষ্ট সুদক্ষ। তবে আমার মতো নিরামিষাশী মানুষের জন্যও ভ্রমণের দিনগুলো অতিবাহন করা খুব একটা মুশকিল না; কারণ এখানে মুশকিল-আসান হিসেবে অনেকগুলো উপাদেয় খাবার উপলব্ধ রয়েছে। এমা দাৎসী ছাড়াও স্থানীয় নিরামিষ খাদ্য হিসেবে রয়েছে কেওয়া দাৎসী (আলু এবং চিসের সংমিশ্রণে নির্মিত একটি খাদ্য ) এবং শামু দাৎসী (মাশরুম এবং চিসের সংমিশ্রণে নির্মিত একটি খাদ্য )। আপনি যদি শুধুমাত্র ভাত ও রুটি প্রিয় মানুষ হন, তাহলে ভাত বা রুটির সঙ্গে এজায় (লঙ্কার চাটনি) ট্রাই করে দেখতে পারেন।
ভুটান ভ্রমণের জন্য মানুষ সাধারণত পারো এবং রাজধানী শহর থিম্পুকেই বেছে নেন। তবে ছোট বড় শহর হোক কিংবা গ্রাম, ভুটানের যে কোনও স্থানেই আপনি খুব সহজেই রেড রাইস এবং এমা দাৎসী খেতে পারেন।
পাহাড়ি গ্রামের সন্ধান পেতে থিম্পু থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে বাবেশা পৌঁছে যেতে পারেন । এখানে স্থানীয় খাবার ছাড়াও চাইনিস, ভারতীয়, ইতালিয়ান, এমনকি ইংরেজি ব্রেকফাস্ট খাদ্য উপলব্ধ রয়েছে। কম খরচে বাবেশা রেস্তোরাঁটি খাদ্যপ্রিয় মানুষের জন্য এক্কেবারে আদৰ্শ।
বাবেশা এবং থিম্পু হাইওয়ের মধ্যবর্তী স্থানে বাবেশা ভিলেজ রেস্টুরেন্টটি অবস্থিত। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, এই রেস্তোরাঁটির সঠিক ঠিকানা স্থানীয় মানুষের কাছেও আজ অজানা। তাই সরাসরি রেস্তোরাঁতে ফোন করে তাঁদের সঠিক ঠিকানাটি জেনে নেওয়াই ভাল হবে।
এই রেস্তোরাঁটি মূলত স্থানীয় মানুষের বাসস্থান। আর পরিবারের সদস্যরা সকলে মিলেই এই রেস্তোরাঁটি পরিচালনা করেন। সিঁড়ি দিয়ে একটু উপরে গেলেই এই বাড়িটির সন্ধান পাবেন। আপনি রেস্তোরাঁর ডাইনিং-এ বসেও খাবার খেতে পারেন, আবার কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে একাকী নিলিবিলিতে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতেও রেস্তোরাঁর সুস্বাদু খাবার খেতে পারেন।
একটি গৃহের রেস্তোরাঁতে পরিবর্তন -
সিঁড়ি দিয়ে একটু উপরে উঠে গেলেই আপনি দেখা পেয়ে যাবেন কাঠের ছাউনি দিয়ে ঘেরা ছোট ছোট জানলার সমাহারে নির্মিত একটা ডাইনিং রুম। ডাইনিং রুমের ভিতরে রয়েছে কাঠের পাটাতন দ্বারা নির্মাণ করা আছে কয়েকটা নিচু টেবিল এবং কাঠের মেঝের উপর অতিথিদের আরামের জন্য ছড়ানো রয়েছে অনেকগুলো কুশান।
প্রাচীন পরম্পরা অনুসরণ করে এখানে মেঝেতে বসে খাওয়ার মজাটা কিন্তু এক্কেবারেই আলাদা। প্রসঙ্গত, কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরই ওয়েটার এসে প্রথমেই আমাদের স্যুপ পরিবেশন করেছিলেন।
ভুটানের বিখ্যাত স্যুপ - যাজু -
এই স্যুপ টি একটি বড় কাঠের তৈরি বাটি এবং চামচ সহযোগে পরিবেশন করা হয়। যাজু স্যুপ-টি দুধ, নারকেল এবং টার্নিপ পাতা সহযোগে যত্ন সহকারে বানানো হয়। এই গ্রামে ভ্রমণের জন্য আমি খুবই এক্সসাইটেড ছিলাম কারণ শুধুমাত্র এই গ্রামেই এই টার্নিপ পাতা উপলব্ধ রয়েছে। ভুটানের অন্যান্য স্থানে টার্নিপ পাতার পরিবর্তে পালং শাকের স্যুপ পরিবেশন করা হয়।
এই রেস্তোরাঁর প্রধান আকর্ষণ হল এখানকার প্রত্যেকটা খাবারই খুবই বিশুদ্ধ, সতেজ এবং অবশ্যই সুস্বাদু। আর হয়তো সেই কারণেই খাবার অর্ডার দেওয়ার ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পরে খাবার পরিবেশনের করা হয়। তবে এই সময়ে আপনি রেস্তোরাঁর অন্দরমহলের শিল্পকলা, মডেল কিচেন, এবং রেস্তোরাঁর চারপাশের পরিবেশকে উপভোগ করতে পারেন কিংবা এই সব কিছুকে ভ্রমণের স্মৃতি হিসেবে ক্যামেরাবন্দি করে রাখতে পারেন।
ভুটানীয় রন্ধনাগার দর্শন
গ্রামের সর্বত্র কাঠের উনুনে এবং মাটির পাত্রে মাংস রান্না করা হয়। রান্নাঘরে অনেক সাজ-সরঞ্জাম উপলব্ধ রয়েছে যেগুলির সাহায্যে চাল, গম, বাজরা ইত্যাদি শস্যর সঙ্গে কিছু পরিমাণে অ্যালকোহল মিশিয়ে একধরণের সুরা তৈরি করা হয়; স্থানীয় চাল থেকে নির্মিত সুরা, যা এখানে আরা নামে পরিচিত। এক কাপ আরার স্বাদ টেস্ট করতে খরচ পড়বে ২০ ঙ্গুলত্রুমস । এছাড়াও আপনি এখানে জুমজিম (পিচ ওয়াইন ) এবং চ্যাংকেই ( চালের তৈরি ওয়াইন ) টেস্ট করে দেখতে পারেন। তবে এই ওয়াইনের মধ্যে অনেক সময় নেশার উপকরণ ছাড়া ডিম ও ব্যবহার করা হয় ।
অন্যান্য সুস্বাদু খাবার -
এবার অপেক্ষার অবসানের পালা । আমাদের সামনে এসে পৌঁছলো অনেকগুলো সুস্বাদু খাবার… আমরা যে খাবার গুলি অর্ডার করেছিলাম সেইগুলি হল -
১. কাকুড়ুকম পা - স্টার্টার হিসেবে আমাদের প্রথম ভুটানীয় এবং নিরামিষ খাবার ছিল কাকুড়ুকম পা। এটি মূলত কুমড়োর চিপস।
২. নেকই দাৎসী - ফিডডলেহেড ফার্ন ভুটানের একটি শাক এবং চিস দ্বারা মিশ্রিত খাদ্য।
৩. খুলায় - এটি বাজরার ময়দা দ্বারা নির্মিত একটি প্যানকেক। স্থানীয় মানুষরা অনেকসময় ভাতের পরিবর্তে এই প্যানকেকও খেয়ে থাকেন ।
৪. মেঙ্গায় - এটি চালের গুঁড়ো, ডিম, মাখন, পেরিল্লা বীজ এবং রসুনের সংমিশ্রণে তৈরি একটি প্যানকেক।
৫. লোয়াম পা - শুকনো টার্নিপ পাতা, পেঁয়াজ, টমেটো, গোলমরিচ গুঁড়ো এবং লঙ্কা গুঁড়োর মিশিয়ে তৈরি হয়েছে এই বিশেষ ফ্রাইড ডিশ ।
৬. যাজু - এই স্যুপটি এই অঞ্চলের কমপ্লিমেন্টারি ডিশ হিসেবে পরিচিত। আপনি আপনার ইচ্ছা মতো যতবার ইচ্ছা এই স্যুপ এর সাহায্যে গলা ভিজিয়ে নিতে পারেন ।
এই এতো গুলো খাবারের জন্য আমাদের খরচ পড়েছিল মাত্র ৫০০ ঙ্গুলত্রুমস, ভারতীয় মুদ্রায় যার খরচ মাত্র ৫০০ টাকা ।সত্যি বলতে কী, এই সুস্বাদু খাবার এত কম খরচে পাওয়ার জন্য আমারও একটু অবাক হয়েছিলাম ।
টাইগার নেস্ট ট্রেক ছাড়াও ভুটানের অনেক অজানা কথা
ভুটানে মানুষ সাধারণত টাইগার নেস্ট ট্রেকের জন্যই বারবার ছুটে যান। ঠান্ডা পাহাড় বেষ্ঠিত দেশের নজরকাড়া সৌন্দর্য্য ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ। তবে বাবেশা ভিলেজ রেস্টুরেন্টটির আকর্ষণ এবং জিভে জল আনা খাবার আপনাকে মুগ্ধ করবেই। সকলের সুবিধার্থে আমি রেস্তোরাঁর ফোন নম্বর গুলি দিয়ে রাখলাম - ল্যান্ড নম্বর #০২-৩৫১২২৯
মোবাইল নম্বর - #৯৭৫-১৭১৬৬০/ ৭৭১৭১২১৩.
ভুটানের প্রকৃতি থেকে হিমালয় দর্শন, সর্বোপরি, বাবেশা ভিলেজ রেস্টুরেন্টের চমকপ্রদ খাবারের স্বাদ আপনাদের কেমন লাগলো আমাদের লিখে জানাতে ভুলবেন না কিন্তু ।