ষাট সত্তরের দশকে আটলান্টিকের এপার ওপার মেতে উঠেছিল জন, পল, রিংগো আর জর্জের সুরের তালে তালে, বিটলস হয়ে উঠেছিল বিশ্বের সবথেকে জনপ্রিয় মিউজিক ব্যান্ড। পৃথিবীব্যাপি খ্যাতির মধ্যে বিক্রি হয়েছিল কোটি কোটি রেকর্ডস এবং তাদের গানের প্রতি ক্রেজ এখনও তাদের ফ্যানেদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে।
দার্জিলিংয়ের ভিকাশ প্রধান এমনি এক আদ্যোপান্ত বিটলস ফ্যান। তাই দার্জিলিংয়ের ম্যাল থেকে ৮০০ মিটার দূরে এম.জি.রোডের নিজের বাড়িটির একটি অংশে যখন ভিকাশ তাঁর স্ত্রী আসেনলাকে সঙ্গে নিয়ে একটি হোটেল খোলার পরিকল্পনা করেন, আসতে আসতে হোটেলটি সেজে ওঠে বিটলস ব্যান্ড এবং বিটলস মেম্বারদের নিয়ে তৈরি নানা মেমরিবিলিয়ায়। ২০১০ সালে স্থাপিত এই বাজেট হোটেল রিভলভার হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ থিম হোটেল।
গত কয়েক বছরে আমি যতবার দার্জিলিংয়ে গেছি, প্রত্যেকবারই কয়েকদিনের জন্যে রিভলভারে থেকেছি। জেনে নেই তার পিছনে বিভিন্ন কারণ, কেন দার্জিলিংয়ে থাকতে চাইলে রিভলভার হয়ে উঠতে পারে আপনার জন্যে আদর্শ।
লোকেশন :
রিভলভার দার্জিলিংয়ের প্রাণকেন্দ্র ম্যাল থেকে মাত্র ৮০০ মিটার, অর্থাৎ ১০-১২ মিনিটের হাঁটা পথের দুরত্বে। হোটেলটিও অবস্থিত রাস্তা থেকে ভিতরদিকে। এর ফলে পর্যটকদের ভিড়ে দার্জিলিংয়ে মূল দ্রষ্টব্য জায়গাগুলোতে শান্তি খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে উঠলেও, রিভলভারের ভিতরে কিন্ত পাবেন নিশ্ছিদ্র নিরিবিলি এবং শান্তির সন্ধান।
ম্যাল থেকে রিভলভারের দিকে হেঁটে আসার পথেই পরবে দার্জিলিংয়ের একের পর এক সেরা খাবার জায়গা, গ্লেনারিস, কেভেন্টার্স, কুঙ্গা, শংরী-লা এবং আরও অনেক কিছু। তাই আপনি কখনওই দার্জিলিংয়ের বিশ্ববিখ্যাত খাবারগুলোর থেকে খুব একটা দূরে থাকবেন না।
রুমস :
বর্তমানে দুইটি ফ্লোর মিলিয়ে রিভলভারে আছে থাকার মতো অনেকটা জায়গা। উপরের ফ্লোরে আছে পাঁচটি ঘর, তাদের নাম যথাক্রমে পল, জন, জর্জ, রিংগো আর ব্র্যায়ান, ৫ বিটলসের নাম অনুসারে (হ্যাঁ, ফিফথ বিটল ব্র্যায়ানকেও এখানে আপন করে নেওয়া হয়েছে)। কোনও ঘর থেকে আপনি পাবেন কাঞ্চনজঙ্ঘার সরাসরি ভিউ, কোনও ঘর থেকে আপনার ঘুম ভাঙবে পাখিদের কলতান শুনে, কোনও ঘরে পড়বে শীতের সকালে সূর্যের প্রথম কিরণ। প্রতিটি ঘরেই স্বচ্ছন্দে দু'জন করে থাকতে পারেন। ঘরগুলোর বাইরে কমন এরিয়াতে আছে একটি অত্যাধুনিক ফায়ারপ্লেস, যা গভীর শীতেও দেয় উষ্ণতার ওম।
প্রতিটি ঘরে, প্যাসেজে, কমন এরিয়াতে সুন্দরভাবে বাঁধানো আছে, নানা বিটলস মেমরিবিলিয়া, ফটো, পোস্টার, কার্টুন, তাঁদের ব্যবহার করা গিটার পিক, লাইটার, মাগস ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়াও প্রতিটি ঘরের টেলিভিশনে লোড করে রাখা আছে বিটলসদের বিভিন্ন এলবামের সমস্ত গান এবং নানা শোয়ের লাইভ রেকর্ডিং। ইচ্ছে করলে পরে দেখতে পারেন বিটলসদের সম্পর্কে রচিত বিশ্ববিখ্যাত নানান বই।
নীচের সম্পূর্ণ ফ্লোরটি অ্যাপার্টমেন্ট হিসাবে একসাথে ভাড়া দেওয়া হয়, ফলে একসঙ্গে অনেক বন্ধুবান্ধব মিলে থাকতে চাইলে এই ফ্লোরটি নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
খাবার দাবার :
রিভলভারের অন্যতম আকর্ষণ হল নাগা কুইজিন চেখে দেখার সুযোগ। নর্থ ইস্টে না গিয়েও পশ্চিমবঙ্গের কুইন অফ হিলস দার্জিলিংয়ে বসে নাগাল্যান্ডের খাবারের খাঁটি স্বাদ নিতে গেলে আসতেই হবে রিভলভারে। অর্ডার করতে পারেন নাগা প্ল্যাটার বা নিতে পারেন পর্ক, চিকেন বা মাছের ডিশ, যেগুলো নাগা পদ্ধতিতে রান্না করা হয় ফার্মেন্টেড বা শুকনো বাম্বু শুট, অথবা ফার্মেন্টেড সোয়াবিন, বা স্মোকড ইয়াম পাতা দিয়ে।
এছাড়াও পাবেন থাই এবং চাইনিজ খাবার। আছে মোমো, থুকপা এমনকি সসেজ বেকন হ্যাম দিয়ে ফুল ইংলিশ ব্রেকফাস্ট টেস্ট করার সুযোগ-ও।
রিভলভারে থাকাকালীন আমি সুযোগ পেয়েছিলাম এখানকার ডাললে খুরসানী লঙ্কার তৈরি আচার খাওয়ার। তীব্র ঝাল এই আচারটি খেতে কিন্তু খুবই সুস্বাদু। ইচ্ছে করলে এই আচার সঙ্গে করে বাড়ি-ও নিয়ে আসতে পারেন। আনতে পারেন টাটকা কফি গ্রাউন্ডস বা খাঁটি দার্জিলিং পাতা চা। আর এখানে থাকাকালীন ফ্রেঞ্চ প্রেস বা ড্রিপ কফি অথবা দার্জিলিং চা, যা চাইবেন তাই পাবেন, ধোঁয়া ওঠা গরম গরম মোমোর প্লেটের সঙ্গে।
সার্ভিস :
যে কোনও হোটেলের সাফল্য নির্ভর করে অথিতিদের কীরকম সার্ভিস প্রদান করা হয়। রিভলভারের আন্তরিকতা এঁদের অন্যতম সম্বল। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে রিভলভার বুটিক থিম হোটেল না হয়ে হয়ে উঠেছে হোম-স্টের মতো, যেখানে প্রধান পরিবারের অতিথি হিসেবে আপনি ছুটি কাটাচ্ছেন।
আর এনাদের বেড ওয়ারমারের কথা না বললে নয়। বিছানার চাদরের তলায় বিছানো রয়েছে এই ইলেকট্রিক চাদর জাতীয় যন্ত্রটি। ফলে তীব্র শীতের মধ্যেও বেড ওয়ারমার-টি আপনাকে সারা রাত রাখবে একদম মনের মতো উষ্ণতায়।
আমার কাছে দার্জিলিংয়ে ছুটি কাটানো সমার্থক হয়ে উঠেছে রিভলভারের সঙ্গে। কেভেন্টার্স, ম্যাল, টাইগার হিলের মতো রিভলভারেও আমি বার বার ফিরে যাই পাহাড় চূড়ায় এক টুকরো আন্তরিক উষ্ণতার খোঁজে। আশা করি, আপনাদেরও ভবিষ্যতের ছুটিতে রিভলভার হয়ে উঠবে সুলভ কিন্তু বিশেষ একটি প্রতিষ্ঠান।