দু'দিনের ছুটিতে বেড়িয়ে আসুন সবুজে ঘেরা বেলপাহাড়ির দেশে

Tripoto

কাছে না দূরে, দূরে না কাছে... করোনার ভয় এড়িয়ে কোথায় যাওয়া যেতে পারে ভাবতে ভাবতেই বেলপাহাড়ি যাওয়া ঠিক হল। তবে এখানকার মূল আকর্ষণ হল থাকার জায়গাটি। ঠিক করলাম থাকব রিমিল লজে। থাকার জায়গার কথা শুরুতেই আলাদা করে বলার কারণটা খোলসা করে বলার আগে ছবিটা দেখে নিন।

Photo of দু'দিনের ছুটিতে বেড়িয়ে আসুন সবুজে ঘেরা বেলপাহাড়ির দেশে 1/10 by Doyel Banerjee
রিমিল লজের গাছ বাড়ি

হ্যাঁ, এই হল রিমিল লজের সেই গাছবাড়ি। যদিও প্রকৃত অর্থে গাছবাড়ি বা ট্রি হাউজ বলতে যা বোঝায় এটা সেটা নয়। কিন্তু তাও উঁচু উঁচু গাছের গুঁড়ির উপর এই কাঠের বাড়িতে থাকতে বেশ লাগে। এখানে মাত্র দুটো গাছবাড়ি আছে। আমরা যেটায় ছিলাম সেটার নাম ছিল বাহা। অপর গাছবাড়ির নাম এদোল। গাছবাড়ি বলেই বোধহয় এর ভাড়া একটু হলেও বেশি। এখানে থাকতে গেলে লাগবে ৩৫০০/ প্রতিদিন। তবে অন্যান্য থাকার জায়গাও এখানে আছে। সেগুলো অপেক্ষাকৃত সস্তা।

দুপুরের মধ্যে রিসোর্টে পৌঁছে গেলাম। রিসোর্টের নিজস্ব রেস্তোরাঁ আছে। সেখানে ডাল ভাত মাছের ঝোল থেকে শুরু করে চাইনিজ সবই পাওয়া যায়। তবে দু'তিন দিন এখানে কাটালে আপনাকে এই রেস্তরাঁতেই খাওয়া দাওয়া করতে হবে। কারণ আসেপাশে আর কোনও খাওয়ার জায়গা নেই। পথশ্রমে ক্লান্ত ছিলাম বলে বিকেলটা রিসোর্টের মধ্যেই ঘুরে কাটিয়ে দিলাম। এখানে একটি প্লে জোন আছে যা শিশুদের কথা ভেবে তৈরি, আছে দোলনা, হ্যামক, ঢেঁকি এবং স্লাইড। তাছাড়া বিকেলবেলা এক কাপ গরম চা নিয়ে বারান্দায় বসতেও বেশ লাগে। শোনা যায় পাখির ডাক আর দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ।

পরের দিন গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম লালজল গুহা। তবে তার আগে রিসোর্ট থেকেই একজন স্থানীয় কর্মচারীকে গাইড হিসেবে নিয়ে নিলাম। আপনাদেরও এটাই করার পরামর্শ দিচ্ছি। কারণ কলকাতা থেকে ড্রাইভার নিলে তাঁর পক্ষে এই জঙ্গলের রাস্তা চেনা সম্ভব নয়।

সুন্দর জঙ্গুলে রাস্তা দিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় লালজল গুহা। চোখ টেনে নেয় দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ আর হলুদে মেশানো ধানখেত। পাহাড়ের ২০০ মিটার উচ্চতায় পাথর কেটে গুহাটি একদা নির্মিত হয়েছিল । অনুমান করা হয় প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে এটা ছিলো আদিম মানুষের আবাসস্থল । গুহার মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষায় প্রস্তরায়ূধ পাওয়া গেছে, যা কোলকাতার জাদুঘরে সংরক্ষিত । গুহাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয় । বর্তমানে সজারু ও বন্য জন্তুর বাস । তবে স্থানীয়রা বারণ করলেন গুহার মধ্যে ঢুকতে। শোনা গেল গুহায় দীর্ঘদিন বাস করেছেন এক সাধু। শুকনো ফল আর গাছের মূল ছাড়া আর তিনি কিছুই খেতেন না। তাঁর স্মৃতি বিজড়িত ছোট্ট একটি মন্দিরও আছে গুহার নীচে।

Photo of দু'দিনের ছুটিতে বেড়িয়ে আসুন সবুজে ঘেরা বেলপাহাড়ির দেশে 2/10 by Doyel Banerjee
লালজল গুহা

লালজল গুহা থেকে চলে গেলাম খান্দারানি লেক। বিশাল একটি লেক যার মধ্যে প্রচুর শালুক ফুটেছে। এ হচ্ছে অনেকটা ফিল গুড ট্রিপ। তাই যারা অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন বা দুর্দান্ত সেলফি তোলার মতো কোনও জায়গার খোঁজে এখানে আসবেন তাঁরা কিন্তু হতাশ হবেন। কিন্তু যারা কিছুটা সময় একান্তে কাটাতে চান আর যারা প্রকৃতির হাতছানি উপেক্ষা করতে পারেন না তাঁরা অবশ্যই এখানে একবার আসবেন। ভাল হয় এখানে বিকেলের দিকে আসলে। তবে সঙ্গে স্থানীয় কোনও ব্যক্তিকে নিয়ে আসা বাঞ্ছনীয়।

Photo of দু'দিনের ছুটিতে বেড়িয়ে আসুন সবুজে ঘেরা বেলপাহাড়ির দেশে 3/10 by Doyel Banerjee
চারপাশের প্রকৃতি

খান্দারনি থেকে এবার আমার পরবর্তী গন্তব্য হল ঘাঘরা জলপ্রপাত। শীতকালে এখানে জল কম থাকে বলে জলপ্রপাতের শোভা অতটা বোঝা গেল না। তবে বর্ষায় এই অঞ্চল কানায় কানায় পরিপূর্ণ থাকে। তবে জলের স্রোতের চেয়েও এখানে যেটা বেশি আকর্ষণীয় সেটা হল জলপ্রপাত সংলগ্ন প্রস্তর খণ্ডের আকার। দেখলাম বড় বড় গর্ত হয়ে আছে। সম্ভবত জল আর হাওয়ার ঘর্ষণে এরকম আকার হয়েছে। বর্ষাকালে এই গর্তগুলোও মুখ পর্যন্ত জল ভরে থাকে। দেখে মনে হয় জল ভর্তি ঘড়া। আর এই থেকেই ঘাঘরা জলপ্রপাতের নামকরণ হয়েছে।

Photo of দু'দিনের ছুটিতে বেড়িয়ে আসুন সবুজে ঘেরা বেলপাহাড়ির দেশে 4/10 by Doyel Banerjee
ঘাঘরা জলপ্রপাত

এবার ফেরার পালা। ঠিক করলাম কাঁকড়াঝোড় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ফিরব। কিছুই না, শুধু দু দিকে শাল পিয়ালের জঙ্গল আর তার মাঝখান দিয়ে কালো পিচের রাস্তা দিয়ে যেতে বেশ লাগে। ফেরার সময় গাড়ি অন্য রাস্তা নিল। আসেপাশের ছোট ছোট শবর অধ্যুষিত গ্রামগুলিও নয়নাভিরাম।

Photo of দু'দিনের ছুটিতে বেড়িয়ে আসুন সবুজে ঘেরা বেলপাহাড়ির দেশে 5/10 by Doyel Banerjee
কাঁকড়াঝোড় জঙ্গল

দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে চলে গেলাম তালবেড়া লেক। এই হ্রদকে স্থানীয়রা বলেন ঝিলিমিলি লেক। এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখতে বেশ লাগে। বিশাল হ্রদের মাঝখানে একটি ছোট্ট একটি বাতাসার মতো দ্বীপ আছে। আগে নৌকা বিহারের অনুমতি ছিল এখানে। কিন্তু করোনার পর আপাতত সেটি স্থগিত আছে।

Photo of দু'দিনের ছুটিতে বেড়িয়ে আসুন সবুজে ঘেরা বেলপাহাড়ির দেশে 6/10 by Doyel Banerjee
তালবেড়া লেক

পরের দিন আমাদের গন্তব্য বুরুডি ড্যাম। এটি ঝাড়খণ্ড অঞ্চলে পড়ছে। তাই নিজের পরিচয় পত্র সঙ্গে রাখা ভাল। বুরুডি একটি বিশাল ড্যাম। এর শোভা অপরূপ। চারদিকে পাহাড় আর জঙ্গল ঘেরা। লালরঙা মাটির ঢিপি মনে করিয়ে দেয় পুরুলিয়ার গনগনির কথা। খানিকক্ষণ এখানে কাটিয়ে একটু চা পান করা গেল। এখানে এখন অনেক স্থানীয় হস্তশিল্পের দোকান হয়েছে। এগুলো স্থানীয় শিল্পীদের অনেকটাই সহায়তা করে।

Photo of দু'দিনের ছুটিতে বেড়িয়ে আসুন সবুজে ঘেরা বেলপাহাড়ির দেশে 7/10 by Doyel Banerjee
এমন সুন্দর প্রকৃতি সত্যিই অভাবনীয়

বুরুডি থেকে সোজা চলে গেলাম ঘাটশিলা। ঘাটশিলা অন্যান্য শহরের মতোই ঘিঞ্জি ও কংক্রিটে ভরা একটি শহর। তবে তার মিধ্যেই এক টুকরো মরুদ্যানের মতো আছে পথের পাঁচালির স্রষ্টা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি গৌরিকুঞ্জ। লেখকের প্রয়াতা প্রথমা স্ত্রীর নামে এই বাড়ি। বিভূতিভূষণ মানেই বাঙালির একরাশ নস্টালজিয়া তাই এখানে প্রায়শই পর্যটকরা আসেন। তবে লেখকের বাড়ির রাস্তায় ঢুকতেই হিন্দি ভাষায় লেখা সাইনবোর্ড একটু বিসদৃশ লাগল।

Photo of দু'দিনের ছুটিতে বেড়িয়ে আসুন সবুজে ঘেরা বেলপাহাড়ির দেশে 8/10 by Doyel Banerjee
গৌরিকুঞ্জ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি

লেখকের বাড়ি থেকে সুবর্ণরেখা নদীর কাছে কিছুটা সময় কাটালাম। তবে নদীর দেখভাল যে সেভাবে হয়না সেটা কাছে গেলে বোঝা যায়। দূষণ গ্রাস করেছে সুন্দরী সুবর্ণরেখাকে।

Photo of দু'দিনের ছুটিতে বেড়িয়ে আসুন সবুজে ঘেরা বেলপাহাড়ির দেশে 9/10 by Doyel Banerjee
সুবর্ণরেখা নদী

সুবর্ণরেখা নদী দেখে চলে গেলাম দুয়ারসিনি বলে একটি জায়গায়। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন বিভাগ এই অঞ্চলটিকে পর্যটকদের উপযোগী করে তোলার প্রয়াস নিয়েছেন। এখানে তাঁরা একটি সরকারি পর্যটন নিবাস তৈরি করেছেন। তবে ভাইরাস সংক্রমণের জন্য এটি বন্ধ আছে। এখানে মা দুয়ারসিনির মন্দির আছে।

Photo of দু'দিনের ছুটিতে বেড়িয়ে আসুন সবুজে ঘেরা বেলপাহাড়ির দেশে 10/10 by Doyel Banerjee
দুয়ারসিনি

বাংলায় মধুরেণ সমাপয়েত বলে একটি কথা আছে। কিন্তু এই ট্রিপে যে সেটা এত মধুর হবে ভাবিনি। ক্লান্ত হয়ে গাড়িতে গা এলিয়ে দিয়েছি, আচমকা চোখে পড়ল একটি সবুজ গেট দেওয়া বাড়ি। গেটের গায়ে লেখা আছে ভালোপাহাড়। মনে পড়ল এই সেই ভালোপাহাড় যা তৈরি করেছেন কমল চক্রবর্তী। তিনি লক্ষাধিক গাছ লাগিয়ে পুরুলিয়ার রুখু জমিকে সবুজ করে তুলেছেন। তার সাথে সাথে যুক্ত হয়েছেন নানা রকম সমাজকল্যাণ মূলক কাজেও। দেখা করলাম তাঁর সঙ্গে। তাঁর বিশাল কর্মকাণ্ডের কিছুটা দেখে ফিরে এলাম রিসোর্টে।

আমাদের ট্রিপ ছিল দুদিনের। কিন্তু চাইলে এখান থেকে, খোয়াবগাঁও,নোয়াডিহি, মুকুটমণিপুর, জয়রামবাটি কামারপুকুর, বিষ্ণুপুর ও ঝাড়গ্রামও ঘুরে আসা যায়।

কীভাবে যাবেন: গাড়িতে গেলে সময় লাগে ঘণ্টা ছয়েক। খড়গপুর থেকে এগিয়ে গিয়ে লোধাশুলির জঙ্গল পেরিয়ে যেতে হবে বেলপাহাড়ি। স্থানীয়রা বলে দেবেন রিমলি রিসোর্টের রাস্তা। ট্রেনে গেলে বিষ্ণুপুরে বা পুরুলিয়াতে নামতে হবে।

কোথায় থাকবেন: রিমিল রিসোর্ট ছাড়া ঝিলিমিলিতে ভাল থাকার জায়গার অভাব আছে।

খাওয়া দাওয়া: রিসোর্টে বাঙালি খাবার সব পাওয়া যায়। নতুন কিছু ট্রাই না করাই ভাল।

কখন যাবেন: গরমের ঋতু বাদ দিয়ে শীত, বর্ষা ও হেমন্ত সব ঋতুতেই যাওয়া যায়।

নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।

বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যবহার করুন।

Further Reads