‘সুজলাং সুফলাং শস্য-শ্যামলাং’ আমাদের মাতৃভূমি। এই মাতৃভূমির কোলে বেড়ে ওঠা প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠা তাঁদের পরম্পরা, ঐতিহ্য, সর্বোপরি নিজস্ব সত্ত্বাকে বহন করার জন্য কখনও কখনও কিছু আচার-অনুষ্ঠান,পার্বণ পালন করে থাকেন। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়; ভারতবর্ষের বিভিন্ন গ্রামে এই পুজো-পরব দেখা যায়। প্রতিটি সম্প্রদায় নিজের নিজের গৃহের মঙ্গল কামনার্থে এবং সংসারের সুখ ও সন্তান-সন্ততিদের রোগমুক্ত জীবনের আশায় এই সমস্ত ব্রত বা আচার পালন করে থাকেন। আর এই সমস্ত অনুষ্ঠানগুলো এক এক সময় হয়ে ওঠে আমাদের লেখনীর রসদ ও জীবন উপভোগের অন্যতম পন্থা।
গ্রাম্য সংস্কৃতির মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা বেশ কিছু ব্রত কথা:-
ইতুপুজো ষষ্ঠী:
প্রধানত কার্তিক মাসের সংক্রান্তির দিন এই পুজোর শুভ সূচনা করা হয় এবং অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবারে এই পুজো করা হয়। অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির দিন এই পুজোর আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে। কুমারি, সধবা অথবা বিধবা প্রত্যেকে এই ব্রত করতে পারেন। ধন-দৌলত এবং সন্তানের শুভ কামনায় এই পুজো করা হয়। একটি সড়ার মাঝখানে ঘট বসিয়ে তার চারপাশে ধান, গম, মাসকলাই, বিউলি, হলুদ, মান, কচু গাছ,মটর, সরষে, শুষনি,কলমি আর পাঁচটি ছোট বটের ডাল দেওয়া হয়। এছাড়াও এই পুজোয় সিঁদুর,ফল,ফুল,দূর্বা,বেলপাতা,হরতকি,নৈবেদ্য ইত্যাদিও সাজিয়ে রাখা হয়।
জানা যায়, একবার এক ব্রাহ্মণের পিঠে খেতে ইচ্ছা হলে তার স্ত্রীকে বলে পিঠে তৈরি করতে। কিন্তু সঙ্গে এটাও বলে, সেই পিঠে তাঁকে পরিবেশনের আগে কেউ যেন না পায়। এই বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে আড়ালে লুকিয়ে ব্রাহ্মণীর পিঠে তৈরি দেখতে থাকে এবং পিঠে তৈরির প্রতিটি শব্দে ব্রাহ্মণ একটি দড়িতে গিট দিতে থাকে। পিঠা তৈরি শেষ হয়ে গেলে ব্রাহ্মণ খেতে বসে দেখে সেখান থেকে দুটো পিঠে কম আছে। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায় দুটো পিঠে সে তার দুই মেয়েকে দিয়েছে। সেই শুনে ব্রাহ্মণ রেগে তার দুই মেয়েকে এক গভীর জঙ্গলে রেখে আসে। মেয়েরা ঘুরতে ঘুরতে জঙ্গল থেকে এক গৃহস্থের বাড়িতে এসে পৌঁছে দেখে তাদের বাড়ির মেয়েরা উঠোনে বসে ঘটের সামনে রাখা জিনিসপত্র দিয়ে পুজো করছে। মেয়ে দুটি সেই পুজোর কথা গৃহস্থবাড়িতে জানতে পেরে তারাও এই পুজো করে এবং তাদের পুজোয় সন্তুষ্ট হয়ে সূর্যদেব বর দেন। সেই বর দানে গরীব ব্রাহ্মণ হয়ে ওঠে ধনশালী এবং এইভাবেই ব্রাহ্মণের মেয়েরা প্রতি রবিবার ইতু পুজো করতে থাকে। এরপর থেকে বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে এই পুজোর প্রচলন শুরু হয়ে যায়।
চাপড়া ষষ্ঠী ব্রত:
ভাদ্র মাসে ষষ্ঠীর দিন এই পুজো করা হয়। প্রধানত ছেলের মায়েরা এই ষষ্ঠী করে থাকেন তাঁদের সন্তানের মঙ্গল কামনার জন্য। পুজোর উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয় কাঁঠালি কলা, পিটুলি। খোলা বা এঁটে পুতুল তৈরি করে চাপড়া তৈরি করে তা নদীতে ভাসাতে হয়। ওইদিন পুজোর পর লুচি পরোটা খাওয়ার প্রচলন থাকে।
কথিত আছে, কোনও এক দেশে এক বণিক বাস করত। তার তিন ছেলে তিন বউ ছিল। বণিক ও বণিকের বউ তার ছোট ছেলের সন্তানকে বেশি ভালোবাসতেন। ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের একসময় চাপড়া ষষ্ঠী করবে বলে বণিকের বউ একটি পুকুর কাটলে সেই পুকুরের কোন জল দেখা গেল না। তারা মনের দুঃখে মা ষষ্ঠীর কাছে প্রার্থনা করে ঘুমিয়ে যেতেই রাত্রে স্বপ্নাদেশ পান যে ছোট নাতিকে কেটে যদি তার রক্ত ওই পুকুরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তবে জল দেখা দেবে। অনেক কান্নাকাটি পর তারা মা ষষ্ঠীর আদেশ অনুযায়ী ছোট নাতির রক্ত সেই পুকুরে ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ছোট বউ তার চাপড়া এবং পিটুলির পুতুল ভাসানোর সময় পুকুর থেকে পুনরায় তার ছেলেকে ফিরে পায় এবং এরপর থেকেই মা ষষ্ঠীর মাহাত্ম্য চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং এই ব্রত শুরু হয়।
নীল ষষ্ঠী ব্রত:
চৈত্র মাসের সংক্রান্তির আগের দিন সন্ধ্যা বেলা শিবের ঘরে বাতি জ্বালিয়ে এই ব্রত উদযাপন করা হয়। সন্তানে দীর্ঘায়ু কামনা করে এই ব্রতটি করা হয়। বাড়ির পুত্র বা কন্যা নামে মায়েদের ভগবানের সামনে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানোর প্রচলন রয়েছে এই পুজোয়। ডাবের জল, কাঁচা দুধ, গঙ্গাজল, কাঁচা আম এবং বিভিন্ন রকমের ফল সাজিয়ে শিবলিঙ্গের উপর অর্পণ করা হয়।
লোকগাথা অনুযায়ী, এক ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণীর কোনও সন্তান না থাকায় তারা বহু দিন ব্রত পালন করতেন; কিন্তু ব্যর্থ হন এবং তারপরে তারা সিদ্ধান্ত নেন বেনারসে গিয়ে বিশ্বনাথ মন্দিরের পাশে মণিকর্ণিকা ঘাটে তাদের প্রাণ বিসর্জন দেবেন। ঠিক সেইসময় মা ষষ্ঠী বয়স্ক মহিলার রূপ ধারণ করে এসে তাদেরকে বাঁচান এবং পরবর্তীতে মায়ের কৃপায় তাদের ঘরে একটি সন্তানের জন্ম হয়। এরপর থেকেই গ্রাম বাংলার মা-বোনেরা সন্তানের মনস্কামনা এই ব্রত করে আসেন।
হরিষ মঙ্গলচন্ডী ব্রত:
বৈশাখ মাসের কৃষ্ণ ও শুক্লপক্ষের প্রতি মঙ্গলবার কুমারী, সধবা বিধবা সকল মহিলারাই এই ব্রত পালন করে থাকেন। ফুল, বেলপাতা, দূর্বা, আতপ চাল, কাঁঠালিকলা,মালা, ঘট,নৈবেদ্য, সিঁদুর ইত্যাদি দ্রব্য সামগ্রীর দ্বারা এই পুজো সম্পন্ন করা হয়। সংসারের মঙ্গল কামনা এবং ধনসম্পত্তি প্রাপ্তি জন্য এই ব্রত পালন করা হয়।
প্রচলিত আছে, কোনও এক গ্রামের গোয়ালা বউয়ের সঙ্গে এক ব্রাহ্মণীর খুব বন্ধুত্ব ছিল। ব্রাহ্মণীর ব্রত করা দেখে গোয়ালা বউয়ের ইচ্ছে হয় এই ব্রত করতে। এই ব্রত করার পর গোয়ালা বউয়ের সংসারের কোন দুঃখ কষ্টের ছায়া থাকে না। তার সংসার সুখে আনন্দে ভরে ওঠে। এই দেখে গোয়ালা বউ বেশি বিচলিত হয়ে পড়ে এবং ব্রাহ্মণীর কাছে এসে মনের দুঃখের কথা জানিয়ে সে কাঁদবার অনুরোধ রাখে। ব্রাহ্মণী তখন তাকে অপরের ক্ষতি করা, নাড়ুতে বিষ মেশানো, হাতি মেরে ফেলা এইসব বুদ্ধি দেন। যাতে সেই অপরাধ থেকে লাঞ্ছিত হয়ে তার কান্না আসে। কিন্তু মা ষষ্ঠীর কৃপায় এগুলো সব বিফল হয়ে যায়। সবাই তাকে আরও বেশি করে আশীর্বাদ করতে শুরু করে। শেষে কোনও উপায় না পেয়ে গোয়ালা বউ ব্রত করা বন্ধ করে দেয়, ফলে তার সমস্ত সুখ দুঃখে পরিণত হয়। আনন্দ কান্নায় রূপান্তরিত হয়। পরবর্তীতে সে তার ভুল বুঝতে পেরে পুনরায় আবার সংসারের সুখের জন্য এই ব্রত শুরু করে এবং আস্তে আস্তে তা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
চম্পার চতুর্দশী ব্রত:
জ্যৈষ্ঠ মাসে এই ব্রত পালন করা হয়। সকলেই এই ব্রত পালন করতে পারেন। ৬৪ টি কনকচাঁপা ফুল, গঙ্গামাটি, সাদা চন্দন, দুধ, মধু দিয়ে প্রতিষ্ঠিত শিবের অভিষেক করে এই পুজো সূচনা করা হয়। পুরাকালে একসময় ব্রহ্মার ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল থেকে জন্ম হয় প্রজাপতি দক্ষের। দক্ষের ছোট মেয়ে সতী অন্যান্য সব ব্রতের মত চাঁপা চন্দনের ব্রত পালন করে বাড়ি ফেরার সময় ছদ্মরূপী এক ভিখারির সঙ্গে দেখা হয়। ভিখারি তার কাছে খাবার চাইলে সতী তাঁকে দক্ষরাজের বাড়িতে নিয়ে আসে এবং দক্ষরাজের স্ত্রী ভিখারিকে খাবার দেয়।
কিন্তু ভিখারি বলেন তিনি তার মেয়ে অর্থাৎ সতীর হাত থেকেই অন্ন গ্রহণ করবেন। সতী খাবার পরিবেশন করতে গেলে তিনি বলেন তিনি কোনও কুমারী মেয়ের হাত থেকে খাবার খান না। বিবাহিত মেয়ে না হলে তিনি এই খাবার গ্রহণ করতে পারবেন না। তাই অতিথি নারায়ণ এবং তিনি না খেয়ে গৃহত্যাগ করবেন, এই অমঙ্গলের আশঙ্কায় সতী সেই ভিক্ষুককে বিয়ে করবেন বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। তারপরেই মহাদেব তাঁর স্বরূপ ধারণ করে সতীকে বিয়ে করেন। কিন্তু দক্ষরাজ শিবকে অপছন্দ করায় তাঁকে অপমান করার জন্য এক যজ্ঞের ব্যবস্থা করেন। সেখানে সতী তাঁর স্বামীর অপমান দেখে দেহত্যাগ করেন এবং শিব সেই দেহ নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেন। শিবকে থামানোর জন্য নারায়ন তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ড বিখণ্ড করে দেন এবং শিবকে আশ্বস্ত করে বলেন হিমালয় রাজের ঘরে জন্ম নেবে গৌরী নামে একটি কন্যা সন্তান। পরবর্তীতে এই গৌরীর সঙ্গেই শিবের বিবাহ সম্পন্ন হয় এবং এই ব্রত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
দূর্বাষ্টমী ব্রত কথা:
ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষে অষ্টমী তিথিতে স্ত্রীলোকেরা এই ব্রত পালন করেন। বিশেষত, বংশ বৃদ্ধির কারণে এই ব্রত করা হয়। ৮টি ফল, ধূপধুনো, প্রদীপ, নৈবেদ্য, হরতকি, মিষ্টান্ন, খেঁজুর, নারকেল, আঙুর, বেদানা, কমলালেবু প্রভৃতি ফল সহযোগে এই ব্রত সম্পন্ন করা হয়। পুজোয় আগত ব্রাহ্মণকে পয়সা, পৈতে, হরতকি দিতে হয়।
পুরাণকথা অনুযায়ী, একসময় শ্রীকৃষ্ণ রাজা যুধিষ্ঠিরের কাছে এই ব্রত কথার কথা বলেছিলেন। সমুদ্র মন্থনের সময় নারায়ণ তাঁর হাত এবং জানু সাহায্যে মন্দর পর্বত ধরে সমুদ্র মন্থন করেন। সেই সময় মন্দর পর্বতের গায়ে ঘষা লেগে তাঁর দেহের লোমগুলো খসে পরে যায় এবং সেগুলি ভাসতে-ভাসতে তীরে গিয়ে পৌঁছালে দূর্বা ঘাসের জন্ম হয়। পরবর্তীতে দেবতা ও অসুররা পুনরায় সমুদ্র মন্থন করলে সেখান থেকে অমৃত এসে দূর্বা ঘাসের উপর পরে এবং দূর্বা অমরত্ব লাভ করে। সন্তানের অমরত্ব লাভের জন্য পুরাকাল থেকে পার্বতী, রতি, সরস্বতী, গঙ্গা, দিতি, অদিতি, মন্দোদরী, দীপ্তি, মায়া, রেবতী, দময়ন্তী, মেনকা, রম্ভা এবং ঋষিদের মেয়েরা পুজো করেন। পুজো শেষে বাড়ির লোকদের খাবার পরিবেশন করার পরেই বাড়ি উপোসী মহিলারা তাদের ব্রত ভাঙ্গেন।
জামাই ষষ্ঠী:
জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে পালিত হওয়া ষষ্ঠীকে বলা হয় অরণ্য ষষ্ঠী। যার প্রচলিত নাম হল জামাইষষ্ঠী। এইদিন শাশুড়ি তার জামাতার মঙ্গল কামনায় এবং জনসম্পদ বৃদ্ধির কারণে এই ব্রত করে থাকেন। ব্রতের দ্রব্য সামগ্রী হল তালপাতার পাখা ৭টি, বাঁশের নতুন বের হওয়া শীষ, ৬০ গাছি দূর্বা, ৬০টি ধান। ধানগুলি পুঁটুলি করে বাঁশের শীষের সঙ্গে বেঁধে দেয়া হয়। সঙ্গে দেওয়া হয় বোটা সহ জোড়া করমচা। গাছের ডালটি মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। জামাইষষ্ঠীর দিন সকালে জামাইকে প্রথমে হলুদ মাখানো হয় এবং কপালে চন্দনের টিকা দেওয়া হয়। সর্বসিদ্ধি, অহলা ইত্যাদি সংমিশ্রিত তেল দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা করা হয় এবং তারপর জামাইয়ের জন্য শাশুড়িরা বিভিন্ন পঞ্চব্যঞ্জন রান্না করে আপ্যায়ন করে। শ্বশুর শাশুড়ি মেয়ে জামাই প্রত্যেকের মিলন পর্ব হিসেবে এই ষষ্ঠীকে দেখা হয়।
শীতল ষষ্ঠী:
মাঘ মাসে শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীর দিন এই ব্রত পালন করা। পুজোর উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয় দই, হলুদ, কলাই এবং বিভিন্ন রকমের ফল মিষ্টি। মা ষষ্ঠী দেবীর পুজো করার পর সুতোর মধ্যে দই এবং হলুদ মাখিয়ে সেটি সন্তানের হাতে মায়েরা বেঁধে দেন। এই ব্রতের দিন রান্না করা নিষিদ্ধ। তাই আগের দিন গোটা কলাই এবং ভাত রান্না করে রাখতে হয়। গরম খাবার খাওয়া যায় না।
পুরাণ কথা অনুযায়ী, দেশে এক ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণীর ৭ ছেলে আর ৭ বউ ছিল। কিন্তু তাদের কোন নাতি-নাতনি ছিল না। মনের দুঃখে তারা একদিন গল্প করার সময় তাদের গৃহের দ্বারে এসে উপস্থিত হয় এক ভিক্ষুক এবং তিনি বলেন যে এই দুঃখ থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য শুক্লা ষষ্ঠীতে মা ষষ্ঠীর পুজো করে কোন রকম গরম খাবার না খেয়ে শুধুমাত্র গোটা কলাই সিদ্ধ, পান্তা এবং দই খেয়ে এই ব্রত পালন করতে হবে এবং রাতে শীলনোড়ার শীলের উপর হলুদ ন্যাকড়া দিয়ে তার মাথার উপরে সিঁদুর ও শ্বেত চন্দনের ফোঁটা দিতে হবে। শীলের কোলে নোড়া রেখে তার কাছে কলা, কুল, সিম, কড়াইশুঁটি জোড়ায় দিয়ে পরের দিন শীলের গায়ে তেল হলুদ দই দিয়ে পুজো করতে হবে। এরপরেই মা ষষ্ঠীর কৃপায় সাত বউয়ের কোলে সন্তান এল এবং পরবর্তীতে এই ব্রত প্রচলিত হল।
গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া কিছু পার্বণ ও উৎসব:
টুসু উৎসব:
পুরুলিয়া জেলার এক অন্যতম কৃষিভিত্তিক উৎসব হল এই টুসু, যার অন্য নাম মকর পরব। অগ্রহায়ণের শেষ দিনে শুরু হয় এই উৎসব আর শেষ হয় পৌষ সংক্রান্তির শেষ বেলায়। লৌকিক দেবী কুমারী হিসাবে এই পুজো করা হয়। ধানক্ষেত থেকে একগোছা নতুন আমন ধান নিয়ে এসে প্রথমে ধানের গোলার পিড়িতে রাখা হয়। অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির দিন সন্ধ্যাবেলা কুমারী মেয়েরা চালের গুঁড়োর সঙ্গে তুষ রাখে। তারপর তুষের উপর ধান, কারুলি, বাছুরের গোবরের মন্ড, গাঁদা ফুলের মালা, দূর্বা, আতপ চাল, আকন্দ, বাসক ফুল, কাচফুল প্রভৃতি রেখে পাত্রটির গায়ে হলুদ দেওয়া হয়। সন্ধ্যার সময় বাড়ির পুজো করে ব্যক্তিগত সামাজিক অভিজ্ঞতা সুর করে তারা গান করে এবং চিড়ে, গুড়, বাতাসা, মুড়ি, ছোলা প্রভৃতি সহযোগে এই অনুষ্ঠান পালন করা হয়।
পৌষ মাসের শেষ চার দিন এই অনুষ্ঠান পালনের দিনগুলোকে চাওড়ি, বাউরী, মকর এবং আখানা বলা হয়। উক্ত দিনগুলোতে প্রথমে উঠোনে গোবর লেপা হয় এবং চালের গুঁড়ো দিয়ে অর্ধচন্দ্রাকৃতি, চতুষ্কোণ, ত্রিকোণ পিঠে তৈরি করে তার মধ্যে দেওয়া হয় তিল, ছাঁচি নারকেল, মিষ্টির পুর। এই টুসু পরব শেষের পরে নদীতে দেবীকে বিসর্জন দিয়ে পরা হয় নতুন বস্ত্র আর বিসর্জনের সময় প্রত্যেক দল তাদের নিজস্ব টুসু সংগীত গাইতে গাইতে নদীর দিকে এগিয়ে চলে। প্রধানত বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমা এবং ঝাড়খণ্ডের রাঁচি, হাজারিবাগ এই সমস্ত জায়গায় টুসু পরব দেখতে পাওয়া যায়।
ভাদু পুজো:
ভাদ্র মাসের পয়লা তারিখে এই পুজো করা হয়। প্রধানত কুমারী মেয়েরা এই পুজো করে থাকে। ভাদু পুজো নির্দিষ্ট কোনও মূর্তি না থাকায় একটি পাত্রে মধ্যে ফুল ও গোবর রেখে তার উপর ধান ছিটিয়ে দিয়ে দিয়ে তাকে মূর্তি কল্পনা করে পুজো করা হয়। সেই সময় বাড়ির মেয়েরা বউরা ভাদু গান গায়। প্রধানত ভাদু গান রাধা- কৃষ্ণর প্রেম ও বারো মাস জীবনের সুখ-দুঃখের কথা নিয়ে গানগুলি তৈরি করা হয়। ভাদু মূলত বীরভূম জেলার অন্যতম আঞ্চলিক অনুষ্ঠানে হিসেবে পরিচিত। এইসময় গ্রামের ছেলেরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে নাচ এবং গানের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। এই পরব চলাকালীন গ্রামের প্রতিটি বাড়ির মেয়েরা অতিথি আপ্যায়নের জন্য মিষ্টান্নর ব্যবস্থা করে।
ছাতা পরব:
পুরুলিয়ার জনপ্রিয় একটি লোক উৎসব হল ছাতা পরব। প্রায় পাঁচশো বছর ধরে এই অনুষ্ঠান এখানে হয়ে আসছে। কথিত আছে, ভাদ্র মাসের শেষ দিনে পঞ্চকোট রাজবাড়ী সদস্যদের হাতে এক বিশাল সাদা ছাতা দেওয়া হয় এবং তারা সেই ছাতা খোলার মধ্যে দিয়ে উদ্বোধন করা হয় এই অনুষ্ঠানের। উক্ত অনুষ্ঠানে গ্রামের যুবক যুবতীরা এক বিশাল শাল গাছের নিচে ছাতা রেখে তাদের জীবনে শুভ সূচনা করে। এছাড়াও এখানে বিভিন্ন গান-বাজনা এবং আঞ্চলিক রীতি মেনে এই অনুষ্ঠান পালিত হয়।
নবান্ন উৎসব:
অগ্রহায়ণ মাসে এই কৃষিজ ফসল কাটার লৌকিক প্রথাটি অনুষ্ঠিত হয়। নতুন ধান কাটার পরে ঢেঁকিতে ধান ভাঙ্গা হয় এবং সেই চালের গুঁড়োর সাথে বিভিন্ন রকমের ফল দুধ গুড় মিশিয়ে নৈবেদ্য তৈরি করা হয়, যা গৃহে অধিষ্ঠিত লক্ষ্মীনারায়ণের সামনে ভোগ হিসাবে নিবেদন করে, পরবর্তীতে বাড়ির আগত অতিথিদের কাছে তা পরিবেশন করা হয়। প্রধানত মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমান জেলায় এই উৎসব পালন করা হয়।
এগুলো ছাড়াও শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা, কাটোয়ার কার্তিক লড়াই, নবদ্বীপের রাস উৎসব বিভিন্ন কীর্তন অনুষ্ঠান দেখতে পাওয়া যায়। পরিশেষে বলা যায়, আধুনিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে ধ্বংস হচ্ছে এই সমস্ত আবেগ-অনুভূতিপূর্ণ আনন্দদায়ক অনুষ্ঠানগুলো। যা ক্রমেই জীবাশ্মরূপ ধারনের পথে হাঁটছে আর যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে মঙ্গল কামনায় পালন করা ব্রতগুলো।