সহস্র বা লক্ষ দ্বীপের সমাহার। লাক্ষাদ্বীপের মানেই তো তাই। ভারতবর্ষের ব্যস্ত ঘিঞ্জি মূল ভূখণ্ড থেকে অনেক দূরে, কোলাহল আর গ্যাঞ্জামের গণ্ডি কাটিয়ে লাক্ষাদ্বীপ আহ্বান দেয় নির্জনে নিরিবিলিতে শান্তি খুঁজে পেতে। লাক্ষাদ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে থাকা মানে যেন গভীর মানসিক প্রশান্তির মাঝে ডুবে যাওয়া। ফিরোজা রঙের জলরাশি আর সাদা বালির সমারোহ আপনার মনের মধ্যে ফিরিয়ে আনে শান্তি। সে আপনি সপরিবারে ছুটিতেই যান, মধুচন্দ্রিমা হোক বা ব্যক্তিগতভাবে নিজের সঙ্গেই সময় কাটাতে যান, লাক্ষাদ্বীপ আপনার সৃজনশীলতা এবং প্যাশন জাগিয়ে তুলবে। আর আপনার পরিবার, বন্ধুবান্ধব বা প্রেয়সীর সঙ্গে সম্পর্কে আনবে নতুন মাত্রা।
লাক্ষাদ্বীপ আর আন্দামান যাওয়ার ইচ্ছে আমার বহুদিনের। শেষমেশ প্রিয় বন্ধু বৈশাখের (বৈশাখ একটি এডভেনচার ট্র্যাভেল কোম্পানি চালায়) কৃপায় আমার আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার স্বপ্ন সফল হল। আন্দামানে থাকাকালীনই ঠিক করি যে, যেদিন বাড়ি ফেরার কথা, সেই দিন-ই আমি লাক্ষাদ্বীপে যাওয়ার টিকিট কাটব। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, তাই করেছিলাম। এটাও জানতে পারি যে লাক্ষাদ্বীপে থাকতে গেলে পারমিটের দরকার পড়বে এবং আরও জানতে পারি যে সবকটি দ্বীপে পর্যটকদের যাওয়ার অনুমতি নেই। আর দ্বীপগুলোও একে অপরের থেকে বেশ দূরে দূরে রয়েছে। তাই যতটা সম্ভব ততটা যাতে দেখতে পারি, সেরকম অসাধারণ একটা ভ্রমণসূচী তৈরি করার দরকার হল।
আপনি হয় লাক্ষাদ্বীপের ক্রুজ প্যাকেজ নিতে পারেন অথবা বিমানপথে লাক্ষাদ্বীপের একমাত্র বাণিজ্যিক বিমানবন্দর আগাট্টি আইল্যান্ড এয়ারোডোমে নামতে পারেন। তবে সরাসরি কোনও ফ্লাইট নেই, কোচি থেকে আগাট্টির কানেকটিং ফ্লাইট নিয়েই যেতে হবে। কোচি আর আগাট্টির মধ্যে এই ছোট্ট ৫০ জনের প্লেনটি প্রতিদিনই যাওয়া আসা করে। কিন্তু বিমানে চড়ার আগেই সমস্ত পারমিট করিয়ে রাখবেন। যে যে দ্বীপে আপনি রাত কাটাতে চাইছেন, তার নাম এবং তারিখ পারমিটে দেওয়া থাকে। পারমিট নিয়ে আরও জানতে লাক্ষাদ্বীপ ট্যুরিজম স্পোর্টস ওয়েবসাইটটি দেখতে পারেন।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্রুজের থেকে বিমানপথে আগাট্টি যাওয়াই ভাল। কারণ আপনি একদিন বেশি থাকার সুযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্লেনের জানলা দিয়ে উপর থেকে লাক্ষাদ্বীপের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য দেখার সুযোগও পাবেন। আমি চার রাত্রি ছিলাম লাক্ষাদ্বীপে - কাভারাত্তি দ্বীপে দুইরাত আর আগাট্টিতে দুইরাত। বাঙ্গারাম ও থিননাক্কারা দ্বীপে একদিনের ট্রিপ ও করেছিলাম তার মধ্যে।
আগাট্টিতে নামার দিন আমি সরাসরি লাক্ষাদ্বীপের কেন্দ্রদ্বীপ কাভারাত্তি চলে যাই। চারপাশে রয়েছে ঘন নীল উপহ্রদ আর সৌন্দর্যে কোনও অংশে বাকি লাক্ষাদ্বীপের থেকে কম নয়। কাভারাত্তি, লাক্ষাদ্বীপের অন্যতম বৃহৎদ্বীপও বটে, আগাট্টি থেকে স্পিড বোটে করে পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় ২ ঘণ্টা। আমার থাকার জায়গাটিও ছিল একদম পারফেক্ট। একদম বিচের উপরেই, বন্দর থেকে মাত্র ৫ মিনিট দূরে। জানলা খুলে দিলেই চোখের সামনে ভেসে উঠছিল ফেনিল সমুদ্র, মনোরম সমুদ্রতট, পাম গাছ আর চোখে মুখে একরাশ হওয়া। আর পাতা ছিল হ্যামক, মিঠে রোদে পাম গাছের ছায়ায় সেই হ্যামকে গা এলিয়েই কাটিয়ে দেওয়া যায় দুপুরের পর দুপুর।
আর সূর্যাস্তের সময় তাই সূর্যাস্তের শ্রেষ্ঠ রূপ দেখার জন্য একেবারে সঠিক জায়গাটা খুঁজে বের করার সময় এসে গেল। যে কোনও নতুন জায়গায় গেলে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত দেখার সময় এটাই আমার এক নম্বর নিয়ম। তাই বিকেল ৪.২০ নাগাদ আমি ফোন করলাম সমীরকে। আগাট্টি দ্বীপের রেড কোরাল হোটেলের মালিকদের মধ্যে একজন সমীর। একলা লাক্ষাদ্বীপের কোথায় কীভাবে ঘুরব, সেই সব খুঁটিনাটির জন্যে আমি সমীরের পরামর্শই নিচ্ছিলাম। সমীরের কথামতো আমি কাবার্ত্তি দ্বীপের লাইটহাউসে চলে আসি। লাইটহাউসের উপর থেকে সূর্যাস্ত দেখার ভাবনাটার মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে রোমান্টিক কিছু।
বছরখানেক আগে কাভারাত্তি দ্বীপের বিচে একটি জাহাজ ভেসে আসে। দেখে মনে হয় বেশ কিছু বছর ধরে জাহাজটি পরিত্যক্ত। জাহাজের ভগ্নাবশেষের কিছু অংশ বিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সৃষ্টি করছিল কিছু অসাধারণ ফটোগ্রাফিক ফ্রেম। এরকম জায়গার সন্ধান দেওয়ার জন্যে আমি সমীরের তারিফ না করে পারলাম না। আর যেহেতু এই ধ্বংসাবশেষগুলো দ্বীপের পূর্ব দিকে, তাই সূর্যোদয়ের সময় ফটোগ্রাফি করার জন্যে এই জায়গাটি একেবারে মোক্ষম। আবার যদি একা একা আনমনে নীল সমুদ্রের মাঝ থেকে সূর্যোদয় দেখতে চান, তাহলেও জায়গাটি একেবারে আদর্শ। এখনো ইচ্ছে করে যদি আরেকদিন এখানে ভোরবেলা সেই সূর্যোদয় দেখতে পারতাম। সকাল সকাল উঠে পরে একদম ঠিক জায়গায় গিয়ে একটা পারফেক্ট সূর্যোদয় দেখার থেকে দিন শুরু করার পারফেক্ট উপায় বোধহয় আর কিছু নেই।
যেহেতু ভারতবর্ষের তিনদিকেই জল, তাই বরাবরই আমার মনে হয়েছে যে এমন জায়গা বা বিচের প্রয়োজন আছে যেখানে সার্ফিং করার মতো ঠিকঠাক ঢেউ আর আবহাওয়া যাবে। আর কি বলুন তো, সূর্যোদয় দেখতে দেখতে চোখের সামনে দেখলাম কিছু স্থানীয় মানুষজন বিশাল বিশাল ঢেউয়ের ওপর সার্ফিং করছেন। যদি আমার পিঠের হাড় না ভাঙা থাকত, তাহলে আমিও হয়তো তখনই ওই জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রথমবার সার্ফিং করার স্বাদ পেতাম এই ভারতের জলেই। সেইদিন বিকেলে সূর্যাস্ত দেখার জন্যে স্পট খুঁজতে গিয়ে পৌঁছে গেলাম কভারাত্তির পূর্ব বন্দরের দিকে। যেহেতু খুব একটা ক্রুজ শিপ ছিল না তখন, তাই প্রচুর স্থানীয় বাচ্ছারা বন্দরে জড়ো হয়েছিল, আর ব্রিজ থেকে জলে ঝাঁপ দিচ্ছিল। সার্ফিং আর সানসেট, দুটোর জন্যেই আদর্শ।
মনের আনন্দে এখানে দু'দিন কাটানোর পর, এবার আগাট্টি দ্বীপে যাওয়ার পালা। সকাল ৬টার সময় বোটে চড়ে আগাট্টি পৌঁছালাম ৮টার সময়, আর এবারও আমার হোটেলটি ছিল কল্পনাতীত ভালো লোকেশনে। ভাবুন, সাদা ধবধবে বীচের ওপর সূর্যোদয় হচ্ছে, আর আপনি সেটা দেখছেন বিছানায় শুয়ে শুয়ে। হ্যাঁ, ঠিক, একেবারে বিছানা থেকেই। আরও আছে। এবার ভাবুন ঠিক ওই বিছানা থেকেই আপনি সূর্যাস্তও দেখতে পাচ্ছেন। কি, ভাবছেন তো এটা ভৌগোলিক ভাবে কী করে সম্ভব? আসলে রেড কোরাল হোটেল অবস্থিত দ্বীপের সবচেয়ে সরু ক্ষীণ অংশে; যার মানে মধ্যে রয়েছে শুধু একটাই রাস্তা, যার ডাইনে বাঁয়ে বিচ, একবারে পূর্ব আর পশ্চিম বরাবর। তাই এক জানলা দিয়ে সূর্যোদয়, আর একই ঘরের অন্য জানলা দিয়ে সূর্যাস্ত দৃশ্যমান।
আপনি নিজের ঘরের বাইরের বিচে বসে নিশ্চিন্তে রিল্যাক্স করতে পারেন। কিন্তু আমার মতো যদি আপনি চির কৌতূহলী হন, তাহলে হেঁটে বা অটো করে আপনি দ্বীপের এদিক ওদিক থেকে ঘুরে আসতে পারেন। আগাট্টি দ্বীপের নিজস্ব অনেক লুকানো বিচ আর স্পট আছে। লাগুন ক্যাফে এখানকার অন্যতম জনপ্রিয় জায়গা। কিন্তু আমার সবথেকে ভাল লেগেছিল প্রধান জাহাজবন্দর এলাকাটা। শূন্য থেকে গোটা জাহাজ হয়ে ওঠার গোটা প্রক্রিয়াটা আমার কাছে খুবই ইন্টারেস্টিং।
লাক্ষাদ্বীপে শেষ দিনটি, মানে আইল্যান্ড হপিংয়ের দিনটিই আমার পক্ষে সবচেয়ে ব্যস্ততম দিন ছিল। আইল্যান্ড ট্যুরে যেতে হলে আপনাকে গোটা একটা বোট বুক করতে হবে। কিন্তু আমি আমাদের হোটেলের আর এক দম্পতির সঙ্গে একই বোটে ওঠার সুযোগ পেয়েছিলাম। যেহেতু ওরাও কাছাকাছি বিভিন্ন দ্বীপগুলোকেই দেখতে চাইছিল, তাই একসঙ্গেই বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে আমরা গেলাম থিননাক্কারা, একটা ছোট্ট সাদা বালির বিচ। গোটা দ্বীপে একটাই রিসর্ট আছে, কিন্তু সেটাই যেন স্বর্গসম। কটেজগুলো, গোটা এলাকাটা, ভিউটা, সব যেন পারফেক্ট ছিল। একলা একলা খানিকক্ষণ ঘুরে এলাম, কিছু সুন্দর ছবি তুললাম, তবে যা বহুবার বলেছি, গোটা দ্বীপে আর একটাও মানুষকে দেখতে পেলাম না
এখান থেকে মাত্র ১৫ মিনিট দূরে অবস্থিত বাঙ্গারাম দ্বীপ ছিল আমাদের পরবর্তী গন্তব্য। আয়তনে বড় হলেও, এখানেও সেই একটিমাত্র রিসর্ট, তবে এখানে বহু স্থানীয় মানুষজনও থাকেন। সকালে আগাট্টি থেকে থিননাক্কারা থেকে বাঙ্গারাম হয়ে সময় প্রায় ১২.৩০টা, সূর্য তখন মধ্যগগনে। আর ভারতবর্ষের এই প্রান্তিকে দ্বীপে সূর্যদেবের উষ্ণতা সামলানো কিন্তু খুব একটা সহজ কাজ নয়। বাঙ্গারামে প্রচুর পাম গাছ থাকলেও, আমি বলব মাঝদুপুরে লাক্ষাদ্বীপে ঘুরে না বেড়ানোই উচিৎ। যত তাড়াতাড়ি পারবেন দিন শুরু করুন। গোটা দ্বীপে একটিমাত্র রেস্টুরেন্ট আছে। কিন্তু চিন্তা করবেন না, এদের ভেজ বা নন-ভেজ, দুটিতেই কোনো খামতি নেই। দ্বীপের মাঝের একটি ছোট লেকেও গেছিলাম, কিন্তু তারপর সূর্যের তাপে পরিশ্রান্ত হয়ে দ্বীপটির পশ্চিমদিকে আর এগোনো হয়নি। আর তাছাড়া সূর্যাস্তের আগেই আমাদের আগাট্টিতে ফিরে আসতে হত।
আগাট্টি থেকে বাঙ্গারাম, থিননাক্কারা আর কাভারাত্তির গোটা সফরটা খুবই সুন্দর। স্বচ্ছ নীল জলের দিকে একটু মন দিয়ে তাকালে ৩০ ফুট নীচের কোরালও দেখতে পাবেন। আর ভাগ্য ভাল থাকলে সামুদ্রিক কচ্ছপ বা অন্য রং বেরঙের জলজ প্রাণীও দেখতে পাবেন। আর এখানকার নীলচে জলের রঙের খেলার কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। লাক্ষাদ্বীপের সৌন্দর্যের সঠিক বর্ণনা দেওয়ার ভাষা আমার নেই।
খুব তাড়াতাড়ি আমি আবার লাক্ষাদ্বীপে ফিরে যাব। এবারে অপেক্ষা করছে আরও নতুন নতুন দ্বীপ, সমুদ্রে সাঁতারের অভিজ্ঞতা, আর সার্ফিংয়ে হাতেখড়ি।