নিজের ভ্রমণ স্বভাবের সঙ্গে পরিচিত হওয়ায় আমি জানতাম যে এম.বি.এ শেষ করার পর, আমি যত ইচ্ছে ঘুরতে যাব। কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিনি শেষে আমার নতুন কর্মস্থল হবে ছত্তিশগঢ় - যেখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তাছাড়া আমার কাজ ছিল সপ্তাহে ৬ দিন। তাই উইকেন্ডে ঘুরতে যাওয়ায় হয়ে উঠেছিল প্রায় অসম্ভব। তাই নিজের মন বুঝতে পেরে আমি চাকরিতে ইস্তফা দিই, এমনকি সিনিয়র এইচ.আর কেও জানাই যে ঘুরতে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলেই চাকরি ছাড়ছি। না, আমি ডিজিটাল নোমাড হয়ে উঠিনি, কিন্তু তার বদলে আমি একটি ভ্রমণ কোম্পানিতেই যোগদান করি, তাদের হয়ে মার্কেটিং করতে। আর এখন আমি নিজের ইচ্ছে মতো ঘুরতে পারি।
পরিকল্পনা : ২০১৮ সালের প্রতিটি প্রতি দ্বিতীয় উইকেন্ডে কোথাও না কোথাও ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান আমি করেই ফেলেছিলাম।
আমি কি সফল হয়েছিলাম : না। তবে তার বদলে আমি সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের প্রতিটি উইকেন্ডেই ঘুরতে বেরিয়েছিলাম।
বাজেট : এই সময়ে আমি আমার স্টুডেন্ট লোন শোধ করছিলাম। তাই অন্যেরা যে টাকা নতুন জামাকাপড় বা নেশাদ্রব্যের ওপর খরচ করে সেই টাকায় আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম।
লিভ : আমি সিক লিভ বা ব্যাড মুড লিভ নেওয়া বন্ধ করি। তার বদলে শুধুই ভ্রমণের জন্য লিভ নিতাম।
চলুন, দেখে নি, তাহলে কীভাবে এক বছরে আমি ২৬টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ঘুরে এসেছিলাম।
জানুয়ারি
১. গুজরাত (প্রজাতন্ত্র দিবসে, ছুটি নিয়েছিলাম : ২ দিন)
ছত্তিশগঢ় থেকে ৩৩ ঘণ্টার ট্রেন সফর করে আমি আহমেদাবাদ পৌঁছেছিলাম। জেনে আশ্চর্য হবেন যে যদি আমি ফ্লাইট করতাম, তাহলে আমার সময় বেশি লাগত, প্রাথমিক উদ্দেশ্য কলেজ প্রাক্তনীদের সম্মেলন হলেও, আমি ঘুরে এসেছিলাম গুজরাটের আরও অনেকটা জায়গা থেকে।
ফেব্রুয়ারি - মার্চ (ছুটি নিয়েছিলাম : ৭ দিন)
ফেব্রুয়ারির উইকেন্ডগুলোতে আমি ছত্তিশগঢ়ের আনাচে কানাচে ঘুরে বেরিয়েছিলাম, আর হোলির ছুটি, উইকেন্ড আর একটা লম্বা ছুটি নিয়ে আমি ১১ দিনের লম্বা একটানা ছুটি নিয়ে ছুটে গেছিলাম দক্ষিণ ভারতে। বিমানপথে কোচি গিয়ে সেখান থেকে সড়ক ও রেলপথে আমি আলেপ্পি, ভারকালা, কন্যাকুমারী, ত্রিচি, পণ্ডিচেরি, মহাবলিপুরম এবং চেন্নাই দেখে এসেছিলাম।
২. ছত্তিশগঢ়
৩. কেরালা
৪. তামিলনাড়ু
৫. পণ্ডীচেরী
এপ্রিল
এপ্রিলে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পরে আমি এক সপ্তাহের সময় নিয়ে জম্মু কাশ্মীর ঘুরে এসেছিলাম। দিল্লি থেকে ট্রেনে করে জম্মু যাওয়ার পরে সড়ক ও রেলপথে বাকি কাশ্মীর উপত্যকা আমি ঘুরে দেখি।
৬. জম্মু ও কাশ্মীর (একটা চাকরি ছেড়ে অন্যটা ধরার মধ্যে, তাই লিভের প্রয়োজন হয়নি)
মে (উইকেন্ডেই শুধু বেড়াতে গেছিলাম, কোন লিভের প্রয়োজন হয়নি)
যেহেতু মে মাসে নতুন চাকরি জয়েন করেছিলাম, তাই দিল্লি-এন.সি.আরের বাইরে ওই মাসে আমি আর কোথাও যায়নি। কিন্তু বিভিন্ন ইভেন্ট আর এক্টিভিটি মিলিয়ে দিল্লি-এন.সি.আরে করার ছিল অনেক কিছু।
৭. দিল্লি
৮. হরিয়ানা
জুন (লং উইকেন্ডে বেড়াতে গেছিলাম, তাই ছুটির প্রয়োজন হয়নি)
জুনের লং উইকেন্ড গুলোতে চুটিয়ে ঘুরে আগের মাসের কমতি পুষিয়ে নিয়েছিলাম। দুবার ঘুরে আসি উত্তরাখণ্ড থেকে - একবার ল্যান্সডাউন, আরেকবার লং উইকেন্ডে নৈনিতাল, আলমড়া এবং রানিক্ষেত।
৯. উত্তরাখণ্ড
জুলাই (ছুটি নিয়েছিলাম : ৩ দিন)
জুলাই মাসে অল্প ছুটি নিয়ে ঘুরে এসেছিলাম বিহার থেকে, যেখানে বর্তমানে আমার বাবা এবং মা শিক্ষকতা করেন। আমরা সপরিবারে কিছু কাছাকাছি জায়গা এবং ঝাড়খণ্ড ও বিহারের কিছু পবিত্র স্থান থেকে ঘুরে আসি।
১০. বিহার
১১. ঝাড়খণ্ড
অগস্ট (উইকেন্ডে বেরিয়েছিলাম, ছুটির প্রয়োজন হয়নি)
জুলাইয়ের শেষটুকু থেকে শুরু করে অগস্টের প্রথমদিকের উইকেন্ডে ঘুরে এসেছিলাম ওরছা আর খাজুরাহো থেকে।
১২. মধ্যপ্রদেশ
সেপ্টেম্বর ( ছুটি নিয়েছিলাম : ৫ দিন)
সেপ্টেম্বরে ঠিক করেছিলাম একটা দেশের বাইরে ট্রিপ করব, ভুটানে। সেই ভুটান ট্রিপের আগে ছোট্ট একটা ভারতীয় অংশ ছিল, যেখানে আমি দার্জিলিং আর কার্শিয়াং বেড়িয়ে এসেছিলাম। এই ট্রিপের ফলে মনের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে আরও বেড়ে উঠল, তাই ভুটান থেকে ফিরে আসার পর প্রতি উইকেন্ডে সময় বের করে ঘুরে এলাম আগ্রা, ফতেপুর সিক্রি, অমৃতসর এবং চণ্ডীগড়।
১৩. পশ্চিমবঙ্গ
ভুটান (আন্তর্জাতিক)
১৪. উত্তরপ্রদেশ
১৫. পঞ্জাব
১৬. চণ্ডীগড়
অক্টোবর (দশেরা আর উইকেন্ড মিলিয়েই ঘুরে এসেছিলাম, ছুটি নিয়েছিলাম : ১ দিন )
অক্টোবর মানেই দশেরা, তাই মুম্বই গিয়েছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে প্ল্যান করে গেছিলাম মুম্বইয়ের নিকটবর্তী দাদরা ও নগর হাভেলি (সিলভাসা) এবং দমন ও দিউ (দমন) নামক ছোট্ট দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে।
১৭. দাদরা ও নগর হাভেলি
১৮. দমন ও দিউ
১৯. মহারাষ্ট্র
নভেম্বর (দিওয়ালির ছুটি ছাড়াও ছুটি নিয়েছিলাম ২ দিন)
দিওয়ালিতে বাবা মা এবং ভাইয়ের সঙ্গে দিওয়ালি উদযাপন করতে গেছিলাম ব্যাঙ্গালোর। কিন্তু স্বভাব যায় কোথায়, বেরিয়ে পড়েছিলাম চিকমাঙ্গালুরের কফি এস্টেটের উদ্দেশ্যে। ওই মাসের শেষের দিকে আরেকটি উইকেন্ডে পুষ্করের উঠমেলা থেকে ঘুরে এসেছিলাম।
২০. কর্ণাটক
২১. রাজস্থান
ডিসেম্বর (বেড়াতে গিয়েছিলাম উইকেন্ড আর খ্রিস্টমাস থেকে নিউ ইয়ারের ছুটিতে, ছুটি নিয়েছিলাম : ৫ দিন)
জমানো ছুটিগুলো ব্যবহার করে ডিসেম্বরের শেষে নর্থ ইস্টে ১১ দিনের লম্বা ব্যাকপ্যাকিং ট্রিপ করি। কিন্তু তার আগের তিনটি উইকেন্ডে আমি ঘুরে এসেছিলাম হিমাচল প্রদেশের রোহরু, রাজস্থানর বিকানের আর উত্তরাখণ্ডের ধানৌলটি থেকে।
২২. হিমাচলপ্রদেশ
২৩. অরুণাচল প্রদেশ
২৪. অসম
২৫. ত্রিপুরা
২৬. মিজোরাম
যে চারটে লম্বা ছুটি নিয়েছিলাম তা বাদে বাকি প্রতিটি ট্রিপ ছিল উইকেন্ডে, আর আমার মোটামুটি খরচ হয়েছিল ৩০০০ টাকা করে (থাকা, খাওয়া আর যাতায়াত মিলিয়ে)। আমি সরকারি পরিবহণ ব্যবস্থার বাসে চড়ে যাতায়াত করতাম আর থাকতাম হোস্টেলে বা বাজেট থাকার জায়গায়। বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে আমি সর্বাধিক ডিসকাউন্ট পাওয়ারও চেষ্টা করতাম।
লম্বা ট্রিপগুলোতে আমি রাতের বেলা একজায়গা থেকে একজায়গা যেতাম যাতে একরাতের থাকার খরচ বেঁচে যায়। আর অফ সিজনে ট্র্যাভেল করার জন্যে আমি সবসময়ই অনলাইনের বদলে নিজে যোগাযোগ করে সব বুকিং করতাম, এতে খরচ অনেকটাই কম হয়।
যদি আপনার মনোবাসনা শুধুমাত্রই ভ্রমণ হয়, আর আমি সোশ্যাল মিডিয়াতে কোথায় গিয়েছি কি খেয়েছি টাইপ লোক দেখানো ভ্রমণের কথা বলছি না, তাহলে ভ্রমণ একেবারেই খরচসাপেক্ষ নয়। আমাদের দেশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য মনোগ্রাহী আর সুন্দর সুন্দর জায়গা। হয়তো আপনার মনপসন্দ জায়গাটি কোনো জনপ্রিয় ট্র্যাভেল লিস্টে জায়গা করে নিতে পারেনি, কিন্ত আপনার মনের মুক্তির আর শান্তির জন্যে ওটাই সেরা উপায়। ঘুরুন, দেখুন, আর আরও অনেক এরকম জায়গা খুঁজে বের করুন। কারণ ভ্রমণ মানেই তো দৈনন্দিনকে ছাড়িয়ে নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে হারিয়ে যাওয়া!