কোভিড পরিস্থিতির জন্য আমাদের অনেকেরই দূরপাল্লার ভ্রমণের প্ল্যান বুকে পাথর চাপা দিয়ে ক্যান্সেল করতে হয়েছে। বন্ধুদের সঙ্গে গোয়া বা গোকার্নার বিচে হুল্লোড় করার স্বপ্ন আপাতত যেন স্বপ্নই থেকে গেছে। তবে, হাতের কাছে আমাদের নিজেদের মন্দারমণি থাকতে এত দুঃখ কীসের। চিরকালই আমরা যেন কাছের মাণিকটিকে অবজ্ঞা করে দূরের মরীচিকার পিছনে ছুটে যাই। তার চেয়ে বরং আসুন, দেখে নি কীভাবে এই পরিস্থিতিতে গোয়া যাওয়ার থেকে মন্দারমণি যাওয়া অনেক বেশি সুরক্ষিত, ঝামেলাহীন এবং সুলভ।
যাওয়া আসায় কোথায় সুবিধে
এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ থেকে গোয়া যাওয়ার উপায়ে হয় দূরপাল্লার ট্রেনে অথবা বিমানপথে। দেশের একদিক থেকে অন্যদিকে এই সময়সাপেক্ষ যাতায়াত শুধু মাত্র যে অনেকটা খরচসাপেক্ষ তাই নয়, করোনা পরিস্থিতিতে বিপদজনকও বটে। অন্যদিকে কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের অন্য যেকোনো বড় শহর থেকে প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে সহজেই কম খরচে পৌঁছে যেতে পারেন মন্দারমণি। না হল অনেক খরচ, না যেতে হল একগাদা মানুষের ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি করে।
খরচাটাও তো দেখতে হবে!
ঘুরতে যাওয়ার সময় আমাদের সবার নানারকম প্রায়োরিটিস থাকে, কিন্তু সবাই চায় যাতে কোনও রকম বাড়তি বাজে খরচ না করে যাতে সুষ্ঠু ভাবে গোটা ট্যুরটা ঘুরে আসা যায়। সেদিক থেকে দেখলে গোয়ার থেকে মন্দারমণি ঢের ভাল। গোয়া যেতে আসতে, সেখানে গিয়ে গাড়ি বা স্কুটার ভাড়া নিতে এবং দামি হোটেলে থাকতে কয়েকদিনের জন্যে আপনার একার যা খরচ হবে, সেই টাকার অর্ধেকই হয়তো আপনি এবং আপনার গোটা পরিবার বা ফ্রেন্ড সার্কেল একটা গোটা উইকেন্ড মন্দারমণিতে কাটিয়ে আসতে পারবেন। তুলনামূলকভাবে এখানে খাওয়ার দাম, হোটেল ভাড়া, যানবাহনের খরচ, সবই অনেক কম।
বাঙালির নজর কিন্তু খাওয়াদাওয়ায়
বাঙালি মানেই জম্পেশ করে মাছ ভাত, আর তারপর জমিয়ে কয়েক ঘণ্টা একটু ঘুমিয়ে নেওয়া। কিন্তু মনের মতো খাবার না হলে কি সেটা সম্ভব? যদি ঘুরতে গিয়ে আপনার পছন্দ মতো খাবারের সঙ্গে আপোষ করতে হয়, তাহলে আর ঘুরতে যাওয়ার মজাটা কই? আর ঠিক এই জায়গাতেই মন্দারমণি দশ গোল দেবে গোয়াকে। মন্দারমণি তে আপনি পাবেন আপনার মনের মতো রুই, কাতলা, ভেটকি, কাঁকড়া, চিংড়ি এবং আরও কত কি। নিজের হাতে দেখে, যাচাই করে কিনে নিয়ে যেতে পারবেন। ইচ্ছে হলে বিচের উপরেই আপনার পছন্দের মাছ ভেজে বা কষিয়ে ঝাল করে পরিবেশন করা হবে। গোয়ার ফ্যান্সি হোটেলের বমবিল মাছের রাওয়া ফ্রায়ের থেকে আমাদের দিশি চিংড়ি ভাজা অনেক পরিতৃপ্তির। তাছাড়া সাধের আলু পোস্ত, বা শেষ পাতে যদি একটু চাটনি, পাঁপড় আর মিষ্টি দইয়ের জন্যে মনটা আনচান করে, তাহলে তার সন্ধান একমাত্র ঘরের কাছের মন্দারমণিতেই।
আর যদি ড্রিংক্সের কথাই বলেন, তাহলে কিন্তু সাবধানে, গোয়া ক্যাবিনেটের নতুন নিয়ম অনুযায়ী কিন্তু গোয়ার বিচে ড্রিংকস পান করতে গিয়ে ধরা পড়লে হতে পারে ২০০০ টাকা জরিমানা থেকে ৩ মাসের জেল। কিন্তু মন্দারমণির বিভিন্ন রিসোর্টে বসে, সমুদ্র থেকে দশ হাত দূরে বসে একটু বিয়ার আপনি খেতেই পারেন, পুলিশ ধরবে না।
ভাষা বিভ্রাট
দক্ষিণের ভাষা বোঝেন? কোঙ্কনি? নিদেনপক্ষে মারাঠি? আচ্ছা ভাঙা হিন্দি আর ইংরিজিই সম্বল? কোই বাত নেহি! মন্দারমণিতে কথা বলতে গেলে লাগবে শুধু আমাদের আদি এবং অকৃত্রিম মাতৃভাষা, বাংলা। বিদেশ বিভুঁইয়ে অচেনা ভাষায় ভেঙে ভেঙে হাত নেড়ে কথা বলার থেকে যদি মন্দারমণিতে আপনার প্রতিবেশী পর্যটকের মুখে শুনতে পান "কি দাদা, কেমন ঘুরছেন?", কোনটা বেশি ভাল লাগবে বলুন তো? আসলে যতই আপনি হিল্লি দিল্লি ঘুরে আসুন, নিজের ভাষায় নিজের মানুষের সঙ্গে কথা বলার যে আমেজটা আছে, সেই মানসিক প্রশান্তিটাই তো আমরা জীবনের প্রতি বাঁকে খুঁজে বেড়াই।
এ কি! এতো ভিড় কেন?
যদি আপনি নাগরিক কোলাহল থেকে দূরে গিয়ে একটু নিরিবিলি আর শান্তি চাইছেন, সেই দিক থেকেও মন্দারমণি রয়েছে বেশ খানিকটা এগিয়ে। প্রশস্ত, সুদীর্ঘ বিচে আছে সকলের জন্যে অফুরান জায়গা। নিজের ইচ্ছে মতো আপনি এই বালুকাবেলায় হেঁটে আসতে পারবেন, পারবেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সূর্যাস্ত দেখতে। কিন্তু অন্যদিকে এই কোভিড পরিস্থিতিতেও গোয়ায় নেমেছে ট্যুরিস্টদের ঢল। কোঙ্কন উপকূল, মহারাষ্ট্র, হায়দ্রাবাদ, ব্যাঙ্গালোর, দক্ষিণের সমস্ত বড় শহর থেকেই বহু মানুষ ভিড় করে ছুটি কাটাতে গোয়া যাচ্ছেন এবং যাবেন। তাই লোকারণ্য গোয়ার বাগা বা ক্যালাঙ্গুটে বিচে যাওয়ার রিস্ক এই মুহূর্তে না নেওয়াই ভাল।
সূর্যোদয় দেখতে চান বেড়াতে গিয়ে?
কথায় আছে গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। সেরমই আমরাও হাতের কাছে মহার্ঘ্য সম্পদ থাকা সত্ত্বেও ছুটে যাই দুরদুরান্তে। ভারতের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত গোয়ার বিভিন্ন বিচগুলো থেকে আপনি কখনওই ভোরের সূর্যোদয় দেখতে পাবেন না। ভোর কেটে প্রথম সকালে স্নিগ্ধ সূর্যের উষ্ণ পরশ পেতে গেলে তাই আপনাকে আসতে হবে আমাদের আপন পূর্ব উপকূলে। ভোরবেলা মন্দারমণির সমুদ্রতটে, আগের রাতের কুয়াশায় ভেজা বালির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পাবেন কীভাবে সারা আকাশ ছেয়ে যাচ্ছে গাঢ় রক্তিম আভায়, দিনের প্রথম সূর্যকিরণে।
সুপর্যটক হিসেবে কিছু দায়িত্বও তো আছে
সুদীর্ঘ লকডাউনের পর আসতে আসতে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। যদিও আমরা বিপদ থেকে মুক্ত হইনি, এবং প্রতিপদে সতর্ক হয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, তাও পর্যটকদের মধ্যে আসতে আসতে ভ্রমণের উন্মাদনা এবং মাদকতা ফিরে আসছে। আমরা যতটা ঘুরতে পারব, এবং স্থানীয় অঞ্চলে যতটা টাকা খরচ করতে পারব, তা সরাসরি পশ্চিমবঙ্গের পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল অসংখ্য মানুষের জীবন আর একটু হলেও ভালো করে তুলতে সাহায্য করবে। মন্দারমণির হোটেলে থাকলে, বিচের ধারে কোনো দাদা বৌদির দোকানে ডিম পোচ আর চা খেলে, বা টোটো করে কাঁকড়া বিচ থেকে ঘুরে এলে, আপনার খরচ করা সেই টাকা সরাসরি স্থানীয় অর্থনীতিকে মজবুত করবে। এবং যার ফলে সরাসরি ভবিষ্যতে আমরা আরও ভালো পরিষেবা লাভ করবে। সুপর্যটক হিসেবে হয়তো আমাদের দায়িত্ব, নিজেদের বাড়ির কাছের, মনের কাছের এই পর্যটনকেন্দ্রটিকে পোক্ত করার, যাতে ভবিষ্যতে গর্ব করে আমরা বলতে পারি, "রাখুন ওসব গোয়া, গোকার্না; আসুন মন্দারমণি ঘুরে দেখে যান সি বীচ কাকে বলে!"