আমাকে কখনও কেউ অপ্রাসঙ্গিক কয়েকটা জায়গার নাম বলতে বললে, জব্বলপুর নিশ্চিতভাবে প্রথম দশে থাকবে। যখন লোকজন জব্বলপুর ছেড়ে যায়, তারা আর ফিরে আসে না। নাগপুর, দিল্লি, ইন্দোর, এমনকী ভোপালেও তারা জায়গা জমি কিনে মা বাবা কে নিয়ে চলে যায়। যে শহরে চাকরি নেই, বাইরের দুনিয়ার প্রবেশ নেই, যেখানে সিনেমা হলে হলিউডের সিনেমা চলে শুধু প্রচন্ড জনপ্রিয়গুলো, তাও হিন্দিতে ডাব করে; এমন শহরে কে থাকতে চাইবে। এই লা লা ল্যান্ডে, লা লা ল্যান্ড দেখার লোক নেই। শহরটা থেকে শুধুই পরিযায়ী মানুষরা চলে যায়, বাকিরা পড়ে থাকে অতীতকে আঁকড়ে। সিঙ্গাপুর চলে যাওয়া এক কাকা আমাকে বলেছিল জব্বলপুর যেন একদল হাসি-খুশি মানুষ নিয়ে তৈরি ছোট্ট গ্রামের মতো। কিন্তু কথাটা একেবারেই সত্যি। বৃষ্টিতে ভিজে গেলে কিন্তু পাড়ার দোকানের কাকা ভিতরে ডেকে নিয়ে বসতে দেবে, একটু চা খাওয়াবে। কিন্তু ট্যুরিস্টদের দেখার মতো এখানে সে রকম কিছু নেই। এখানে আগত বেশিরভাগ মানুষ হয় এখানেই বড় হয়েছেন বা তাদের পরিবার এখনও এখানে থাকে। বাকিরা যায় এখানে এয়ারপোর্টে নেমে ১৬৯ কিমি দূরের বান্ধবগড় জাতীয় উদ্যানে। তাহলে আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন, আমি জব্বলপুর নিয়ে এত কথা বলছি কেন আর আপনিই বা তা শুনবেন কেন?
এক নম্বর কারণ হচ্ছে খোয়া জিলিপি, যেটা শুধুমাত্র এখানেই পাবেন, গোটা দুনিয়ায় অন্য কোথাও পাবেন না। শুকনো খাঁটি দুধ থেকে তৈরি খোয়া, চিনির রস, প্রচুর ঘি আর ঠেকুর (পূর্ব ভারতীয় আরারুট) দিয়ে তৈরি, জবলপুরের নিজস্ব মিষ্টি। অত্যন্ত মুখরোচক এই মিষ্টিটির প্রচলন করেন হরপ্রসাদ বাদকুল, যিনি ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে পার্শ্ববর্তী কোনও গ্রাম থেকে জব্বলপুরে আসেন এবং দু বস্তা তামাক বেচার টাকায় একটি মিষ্টির দোকান খোলেন। তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর তৈরি এই মিষ্টি কিন্তু বহু বছর ধরে তাঁর পরিবারের অন্ন সংস্থানের বন্দোবস্ত করে দেবে। বাদকুল পরিবারের মিষ্টির দোকান এখনও রমরমিয়ে চলছে, কিন্তু তাঁদের কে যদি এই মিষ্টির উৎপত্তির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন, তাহলে তাঁরা বলেন যে হরপ্রসাদ এবং তার স্ত্রীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেই খবরও অবলুপ্ত হয়েছে। তাই আপাতত আমাদের এই ইতিহাস হারিয়ে ফেলার ঘটনাটি মেনে নিতে হবে, তারপর মন ভরে কামড় দিতে হবে এই মুচমুচে রসে ভরা, ঘন বাদামি রঙের জিলিপিগুলোতে।
দ্বিতীয়ত, নর্মদা এবং তার বিভিন্ন ঘাটগুলো। জব্বলপুরের হৃদয়ে জীবন নিয়ে আসা নর্মদার তীরে তীরে আছে অনেকগুলো সুন্দর ঘাট, যার মধ্যে সবথেকে সুন্দর ভেদাঘাট। এখানেই আছে ধুঁয়াধার জলপ্রপাত। অনেক উঁচু থেকে নিচের নদীখাতে জলরাশি আছড়ে পড়ে যে কুয়াশা আর বাষ্প তৈরি হয়, সেই থেকেই এই নাম। আর নদীর চারপাশে যেন তাকে সঙ্গ দিচ্ছে মার্বেল পাথরের রাশি, সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য। সেখান থেকে কিছু দূরের নদীপাড়ে ইচ্ছে করলে আপনি বোটিংও করতে পারেন। দিনের বেলাতে গেলে আপনার বোটের মাঝিভাই গাইডের মতো আপনাকে দেখিয়ে দেবে কোন পাথরটা দেখতে গাড়ির মতো আর বলে দেবে যাতে জলে বেশি হাত না ডোবান; কুমীরে কামড়ে দিতে পারে। আর যদি আপনি আমার মতো বলিউড পাগল হন, তাহলে এই খবরটায় তো আপনি আনন্দে নেচে উঠবেন। খুন ভরি মাঙ্গ সিনেমায় এই নদীর পাড় থেকেই কবীর বেদী রেখাকে জলে ফেলে দিতে চান ধাক্কা মেরে এবং শেষমেষ কুমীরের পেটে বলি হন। আর অশোকা সিনেমায় শাহরুখ খানকে মনে করে করিনা কাপুর এই খানেই নেচেছিলেন রাত কা নাশা আভি গানে। পূর্ণিমার রাতে বোটে চড়লে যেন দেখতে পাবেন নদীর ঘন সবুজ জল আর নদীর পাথরগুলো যেন রাত্রের আকাশের সাথে কথা বলছে। শুধু আপনার জন্যই যেন চাঁদের মনোরম আলোয় মার্বেল পাথরগুলো চকচক করছে, নদীর জলে আকাশের তারা বিছানো নকশি কাঁথার প্রতিফলন। বলুন, ইচ্ছে করছে না দেখতে?
তৃতীয়ত, এবং সবচেয়ে মজাদার কারণ বোধহয় জব্বলপুরের একদম নিজস্ব একটি ব্র্যান্ডের সোডা। সিমলেক্স মশলা সোডার স্বাদে জিরের আভাস যেন এটিকে বাকিদের থেকে একেবারে আলাদা করে দেয়। একটু মিষ্টি, কিন্তু হজমের জন্যে একদম ফার্স্ট ক্লাস। শহরের প্রায় সমস্ত দোকানেই লোকাল এই সোডাটি দেখতে পাবেন। কিন্তু যেহেতু বাকি আর কোথাও পাবেন না, তাই খেতে হলে সেই শুধু জব্বলপুরেই আসতে হবে। এর টেস্টটা কেমন জানেন? একদম ছোটবেলার মতো।
আপনি জবলপুরে গিয়ে দেখার জিনিস খুঁজলে, লোকজন আপনাকে বলবে আশ্চর্য ব্যালেন্সিং পাথরটা দেখে আসতে। ১৯৯৭ সালের ২২ মে এক জোরদার ভূমিকম্পে, পাথুরে এই শহরের বহু বড় বড় পাথর নড়ে যায়, শুধুমাত্র একটি ছাড়া। সেই একটি পাথর যেন আরেকটি পাথরের ওপর আলতো করে ভর দিয়ে নিজের ব্যালেন্স খুঁজে পেয়েছে, হয়ে উঠেছে স্থানীয়দের আশ্চর্যের কারণ। কিন্তু পাথর বালি এসব আপনার ভাল না লাগলে এখানে গিয়ে কাজ নেই। তার থেকে বরং চলুন বর্গী ড্যাম রিজারভারে এবং চড়ুন এখানকার ফেরি বোটে। একেবারে স্বচ্ছ নীলচে স্ফটিক জল আর মহাসাগরের মতো আওয়াজ মিলিয়ে জায়গাটি সত্যিই অপূর্ব। আর এর সাথে ফেরি করে চলে যেতে পারেন মান্ডালা। সেখানে নেমে সোজা কানহা কিসলি জাতীয় উদ্যান। ভারতবর্ষের হৃদয়ে এসেছেন আর একটু বন জঙ্গল ঘুরে দেখবেন না?
জব্বলপুরে কিন্তু আছে আর বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। যারা এখনও খাজুরাহোর মন্দির স্বচক্ষে দেখতে পাননি, কিন্তু এরকম পুরাতাত্ত্বিক ব্যাপারে আছে প্রচন্ড আগ্রহ, তাঁরা এসে দেখতে পারেন চৌসাট যোগিনী মন্দির এবং এই মন্দিরের দেওয়ালে খোদাই করা চৌষট্টি যোগিনীদের। দশম শতকে কুলচুরি সাম্রাজ্যের শাসনকালে তৈরি এই হেরিটেজ সাইটটি অবশ্যই দেখে আসার মতো।
হয়তো কারোরই বাকেট লিস্টে জব্বলপুরের নাম থাকবে না। আর সত্যি বলতে আপনি যদি মারা যাওয়ার আগে জব্বলপুরে ঘুরে যেতে না পারেন, কেউ দোষও দেবে না। কিন্তু যদি আপনি আসেন, আর আমি সত্যিই চাই যে আপনি আসুন, তাহলে আপনকে হয়তো এমন এক ছোট্ট মফস্সল খুঁজে পাবেন যেখানকার লোকেরা আপনার শহুরে চলনবলন আর পালিশ করা ইংলিশ দেখে অবাক হয়ে যাবে, যেখানে এখনো রমরমিয়ে চলছে ৯০ দশকের বলিউডের গানগুলো, আর যেখানের মানুষের মনের আর বাড়ির, দুই দরজাই আপনার জন্যে সারাক্ষণ খোলা। জব্বলপুর এমন এক জায়গা যাকে পাশ কাটিয়ে সবাই অন্য কোনও আরও সুন্দর আরও জনপ্রিয় ডেস্টিনেশনে চলে যায়। তাই জব্বলপুর রয়ে যায় পর্যটকদের জন্য ওয়েটিং রুম হয়ে। তবে এমন এক ওয়েটিং রুম, যা অন্যন্যসুন্দর, আপনার যেখানে একবার অন্তত ঘুরে আসা উচিত।