
তোপসের বাবা একবার একটা লাখ কথার এক কথা বলেছিলেন। স্কুল অনেক থাকলেও সেখানে ফেলুর মতো মাস্টার নেই! শুধু মাস্টার কেন? ফেলুর মতো কোনও জায়গা সম্পর্কে খুঁটিয়ে পড়াশোনাই বা কে করে? জাত বাঙালি বলে কথা। ট্রিপ প্ল্যান করা হয়ে গেলেই ম্যাপ, গেজেটিয়ার আর গুচ্ছের গাইড বুক নিয়ে কি আপনিও বসে পড়েন না? এবার আর ওসবের প্রয়োজন নেই যদিও। কারণ এবারের লম্বা ছুটিতে আমরা মোটামুটি মন্দার বোসের মতো অনেকগুলো জায়গায় যাব। আর আমাদের ভ্রমণসঙ্গী হবে খোদ ফেলুদা।

বাঙালির ঘরকুনো বদনাম ঘুচিয়ে তাঁর নায়ক গোয়েন্দাকে ভারতের নানা জায়গায় নিয়ে গেছেন স্রষ্টা সত্যজিত রায়। একটা কেস বেনারসে তো আরেকটা রাজস্থানে। কখনও পুরী তো আবার কখনও নেপালের কাঠমান্ডু। গোয়েন্দাগিরিও হয়েছে আর তার সঙ্গে সঙ্গে সত্যজিৎ তাঁর পাঠকদের একদম স্পটে নিয়ে গিয়ে ফেলেছেন। আর তাই বেড়ানোটাও দিব্যি হয়েছে।

দীঘা, পুরী আর দার্জিলিং নিয়ে বাঙালির হ্যাংলামোর কথা সবাই জানে। আপনি বাঙালিকে সুইৎজারল্যান্ড ঘুরিয়ে নিয়ে আসলেও তাঁরা বলবেন যে দার্জিলিং-এর মতো পাহাড় নাকি ভূ-ভারতে নেই! আপনি মায়ামির লোভনীয় সমুদ্র সৈকত ঘুরিয়ে নিয়ে এলেও তাঁদের নাক সিটকে উত্তর হবে , না বাপু পুরীর বিচে মদনমোহন খাওয়া ঢের ভাল!

ফেলুদা যেখানে যেখানে তদন্ত করতে গেছেন সেই জায়গা বেড়ানোর জন্যও আদর্শ। আবার উল্টো করেও বলা যায়, ফেলুদা, তোপসে আর লালমোহনবাবু গেছেন নির্ভেজাল বেড়ানোর আনন্দ উপভোগ করতে। আর সেখানেই গিয়েই হয় খুন নয় চুরি, কোনও একটা গোলমাল। তবে ফেলুদার চোখ দিয়ে কিন্তু আমরা কলকাতা শহরকেও নতুন করে আবিষ্কার করেছি। যেহেতু গোয়েন্দা কলকাতার তাই অনেক কেসই কলকাতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। কৈলাস চৌধুরীর পাথর, শেয়াল দেবতা রহস্য, গোলোকধাম রহস্য, অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য, ডক্টর মুন্সীর ডায়েরি, বোসপুকুরে খুনখারাপি ও ইন্দ্রজাল রহস্য এই সবগুলো গল্পের রহস্যই দানা বেঁধেছে কলকাতাকে কেন্দ্র করে। তবে কলকাতার সৌন্দর্য সবচেয়ে বেশি ফুটে উঠেছে গোরস্থানে সাবধান গল্পে। পার্কস্ট্রিট সিমেট্রি বা গোরস্থানের দারুণ বর্ণনা আছে এখানে। কলকাতার অনেক ছোটখাটো সংস্থা পার্কস্ট্রিট সিমেট্রির ট্যুর করায়। তার মধ্যে একটি হল ইমারসিভ ট্রেলস।

‘দীপুদা’ অর্থাৎ দীঘা, পুরী আর দার্জিলিং নিয়ে বাঙালি আবেগপ্রবণ হলেও সত্যজিতের গল্পে দীঘার ছবি খুব একটা পাওয়া যায়না। খুব সামান্য একটা রেফারেন্স এসেছে ‘অপ্সরা থিয়েটারের মামলা’ গল্পে। তবে মূল গল্প কলকাতাতেই। পুরীতেও ফেলুদা একবারই গেছেন। হত্যাপুরী গল্পে যদিও পুরীর সৈকত, সমুদ্রে চানের কথা, পুরী হোটেল এবং আশেপাশের নানা টুকিটাকি সুন্দর করে বোঝানো হয়েছে।

সম্ভবত সমুদ্রের চেয়ে ফেলুদার বেশি পছন্দ হল পাহাড়। বিশেষ করে দার্জিলিং। তাই তো ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি শুরুই হয়েছে দার্জিলিং দিয়ে।ফেলুদার দার্জিলিং প্রীতি বিশেষভাবে ধরা পড়েছে দার্জিলিং জমজমাট গল্পে। জলাপাহাড় থেকে ঘিরে আসা কুয়াশা, পাঙ্খাবাড়ির বর্ণনা বা হিলকার্ট রোড, বারবার এই জায়গাগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কলকাতাকে কেন্দ্র করে লেখা গল্পে যেমন এখানকার কিউরিও শপগুলোতে ফেলুদা যেতেন, ঠিক তেমনই দার্জিলিংয়ের কিউরিও শপের উল্লেখও আছে দার্জিলিংয়ের গল্পে। ঘুরেফিরে এসেছে ম্যালের কথা। ফেলুদা হাঁটতে ভালোবাসে একথা সব ফেলুভক্তই জানে। তাই খটখট জুতোর আওয়াজ তুলে ম্যালে হেঁটে বেড়ানোর কথা তো আসবেই।

ফেলুদা হচ্ছে এমন গোয়েন্দা যিনি শুধু পয়সার জন্য কাজ করে না। অবশ্যই তিনি কেস সমাধান করতে পারলে নিজের ‘পারিশ্রমিক’ টুকু বুঝে নেন। কিন্তু শুধু কাজ আর তার পরিবর্তে পয়সা এই ইকুয়েশনে আর যেই হোক প্রদোষচন্দ্র মিত্র বিশ্বাস করেন না। ফেলু কাজ করে তার মগজাস্ত্র চাঙ্গা রাখার জন্য। মগজের খিদে যার তীব্র সে কি শুধু হাই প্রোফাইল কেস নিয়েই থাকবে। একদম নয়। তাই শহুরে জৌলুস আর পর্যটন কেন্দ্রের আকর্ষণ ছাড়িয়ে ফেলুদার কিছু গল্প নাম না জানা গণ্ডগ্রামেও জমে উঠেছে। বামুনগাছিতে সমাদ্দারের চাবি, নদীয়ার ঘুরঘুটিয়ায় ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা, বর্ধমানে গোঁসাইপুর সরগরম, পানিহাটিতে জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা এই সব গল্প গ্রাম্য পরিবেশেই জমে উঠেছে। আর সেইজন্যই বোধহয় ফেলুদার গল্প বা ফেলুদার বিভিন্ন কেসের মধ্যে এত বৈচিত্র।

তবে ফেলুদাকে যদি সত্যি সত্যি নিজের ভ্রমণসঙ্গী করে বেড়াতে যেতে চান তাহলে তালিকার প্রথম দিকেই থাকবে রাজস্থানের নাম। কারণ রাজস্থানের এক কেল্লাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল ফেলুদার বিখ্যাত গল্প ‘সোনার কেল্লা’। বাঙালি মোটামুটি এই গল্পকে আত্মার সঙ্গী করে ফেলেছে। বিশেষ করে গল্পটি যখন ছবি হয়ে পর্দায় এল, আপামর বাঙালি যখন জাতিস্মর মুকুল আর উটের পিঠে চেপে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখল, মানে সেই থেকে আজ পর্যন্ত সেই ভালবাসায় এতটুকু ছেদ পড়েনি। অনেকেই জানেন না যে জয়সলমীরের সেই সোনালি বেলে পাথর দিয়ে তৈরি ফোর্ট বা কেল্লা এখনও ‘লিভিং’। অর্থাৎ এখানে এখনও লোকজন বাস করে। সোনার কেল্লা ছবি মুক্তি পাওয়ার পর দলে দলে বাঙালি সেখানে গিয়ে রীতিমতো পর্যটন শিল্পের খোলনলচে পাল্টে দিয়েছে। “এখানে আমরা হোলি খেলতাম” বা “ওইটা গিরিধারির বাড়ি” বলে পোজ দিয়ে যদি একটা ছবি নাই তুললেন, আপনি কেমন বাঙালি মশাই?

রাজস্থান পছন্দ না হলে ফেলুকে নিয়ে বেনারস চলে যান। দু'হাত মাথায় ঠেকিয়ে বলুন জয় বাবা ফেলুনাথ! বেনারসের অলিগলি থেকে শুরু করে প্রতিটা ঘাটের এত সুন্দর দৃশ্যায়ন এই গল্পে আছে যে পড়লেই চলে যেতে ইচ্ছে করে। মগনলালের বাড়ির রাস্তা হোক বা ঘোষাল বাড়ির সেই দিগন্ত বিস্তৃত ছাদ। ঘাটের উপর ভণ্ড মছলি বাবা আর গঙ্গার ঘাটে বজরা, এসব ফেলুকে ছেড়ে একাই দেখবেন? ধ্যাত, তা কি সম্ভব? ফেলুর গোলাপি মুক্তো রহস্য গল্পেও সামান্য হলেও বেনারসের কথা এসেছে। তাহলে কি বেনারসই ফেলুর প্রিয় জায়গা? উঁহু তা কী করে হয়? লখনউ শহরও দিব্যি পছন্দ ফেলুর। আর ফেলুদার সঙ্গে কোনও শহরে বেড়াতে যাওয়া মানে সেই শহরের ইতিহাস আর ভূগোল একেবারে নখদর্পণে চলে আসা। বাদশাহী আংটি আর শকুন্তলার কণ্ঠহার গল্পে উল্লেখ আছে লখনউ শহরের। লখনউ গেলে তো ভুলভুলাইয়া যেতেই হবে। হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই। সঙ্গে ফেলু আছে না? নখ দিয়ে দেওয়ালে দাগ দিয়ে কেমন ভুলভুলাইয়ার ধাঁধা ভেদ করে বেরিয়ে এসেছিল মনে নেই?
তবে সব দিক বিচার করে দেখতে গেল বলতেই হয় পাহাড়ই ফেলুর বেশি পছন্দের। ফেলুদা কাশ্মীর গেছে (ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর), কেদারনাথ গেছে (এবার কাণ্ড কেদারনাথে), গ্যাংটক গেছে (গ্যাংটকে গণ্ডগোল) সিমলা গেছে (বাক্স রহস্য) আবার কাঠমান্ডুও গেছে (যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে)। সব পাহাড়ি জায়গা। সে বাঙালি মাত্রেই একটু পাহাড় পাগল সে কথা অস্বীকার করিই বা কী করে?
কোথাও যাওয়ার কথা হলেই ফেলুদা সেই জায়গা সম্পর্কে পড়াশোনা করে নিত, খুঁটিয়ে ম্যাপ স্টাডি করত। একদম খাঁটি বাঙালি যাকে বলে। আপনি গাল ফুলিয়ে বলবেন, এত বেড়ানোর গপ্প করে লাভ কী শুনি? কোরোনার জন্য তো কোথাও যাওয়ার উপর হাজাররকম বিধি নিষেধ। ওমা তাতে কী? একটা গাড়ি নিয়ে হাজারিবাগ তো যেতে পারেন নাকি? ছিন্নমস্তার অভিশাপ গল্পটা মনে নেই?
আর কোথাও যেতে না পারলেও মানস ভ্রমণ করতে তো দোষ নেই? তাই বোম্বাইয়ের বোম্বেটে বা লন্ডনে ফেলুদা নিয়ে বসে পড়লেই তো ল্যাটা চুকে যায় বাপু! কিন্তু ঘোরাঘুরি শেষ করার আগে একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে বড্ড খোঁচা মারছে। ফেলুর দক্ষিণ ভারতে মাত্র একখানা কেস কেন? নয়ন রহস্য গল্পে চেন্নাই ছাড়া ফেলু দক্ষিণে বিশেষ যায়নি। মনে হয় সব বাঙালির মতোই ফেলুরও ইডলি দোসায় একটু ইয়ে আছে! আপনার কী মনে হয়?