প্রখ্যাত ফরাসি লেখক আর্দ্রে গিদ বলেছিলেন "কূলের সীমানা না হারিয়ে ফেললে, মানুষ নতুন সমুদ্র খুঁজে পায় না"। সত্যিই তো, ভ্রমণ আমাদের কত কিছু শেখায়। কিন্তু কখনও কখনও অভিজ্ঞতাগুলো এতোটাই জোরালো হয় যে সেগুলো আমাদের অন্তরে ধাক্কা দিয়ে যায়।
বছর পাঁচেক আগে, নৈনিতালে বেড়াতে গিয়ে এমনই এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এই ট্রিপটির আগে পর্যন্ত কিন্তু আমার ঠাকুর ভগবান বা ভূত প্রেত, কোনও কিছুতেই তেমন বিশ্বাস ছিল না। এখন যদিও আমি নিজেকে নাস্তিক বলে মনে করি, তবে অশুভ শক্তি সম্পর্কে আমার মনোভাব পাল্টাতে বাধ্য হয়েছি। হ্যাঁ, নৈনিতালে বেড়াতে গিয়ে কিভাবে আমার ভূতে বিশ্বাস জন্মাল, এ তারই কাহিনি।
নৈনিতাল কবরস্থানের ইতিহাস ও লোকগাথা
নৈনিতাল থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে ভোয়ালি রোডের উপরে অবস্থিত এই কবরস্থানের ইতিহাস কিন্তু বেশ জটিল। এই কবরস্থানের প্রথম কবরের সময়নামা অনুযায়ী নৈনিতালের নাম তখন ছিল নাইনী-তাল। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চলে বসবাসকারী ব্রিটিশ সৈন্যরাই ছিল এই কবরস্থানের মূল ব্যবহারকারী। কথিত আছে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের দুর্ঘটনার পরেই কবরস্থানটি আসতে আসতে ভূতুড়ে হিসেবে কুখ্যাত হয়ে ওঠে।
নৈনিতালের ইতিহাসে ১৮৮০ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর ছিল এক অভিশপ্ত দিন। ওই দিনে শহরের ওপর নামে এক মারাত্মক ধস। সরকারি গণনা অনুযায়ী প্রায় ১৫০ মানুষ প্রাণ হারান এবং শহরটির একটি বড় অংশ চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়। বলা হয়, দুর্ঘটনার পরে বেশ কিছু মাস ধরে উদ্ধারকারীরা মৃতদেহ উদ্ধার করতে থাকেন, পরিশেষে তাঁদের সবার জায়গা হয় তৎকালীন অনামী সেই কবরস্থানে।
কবরস্থানে আমার অভিজ্ঞতা
দুর্ভাগ্যবশত, আমি যখন কবরস্থানে গেছিলাম, এসব গল্পের কিছুই আমি জানতাম না। আমরা ছিলাম শুধুই একদল কমবয়সী উচ্ছ্বল ছেলের দল, যেখানে আমাদের অনুসন্ধিৎসু মন চাইছিল, সেখানেই আমরা দাঁড়িয়ে পড়ছিলাম। এরমই এক সন্ধ্যায়, নৈনিতালে পেট ভরে দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে গাড়ি করে ফিরছিলাম। সূর্য ডুবতে তখনও কিছু দেরি। ভোয়ালি রোড ধরে ফিরতে ফিরতে হঠাৎ আমরা এই দরজার মতো দেখতে কাঠামোটি দেখতে পাই। আমরা তৎক্ষণাৎ গাড়ি থামাই।
সৌভাগ্যক্রমে, আমরা কী করতে চলেছি, সে নিয়ে আমাদের অল্প ধারণা ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাও আমরা নিজেদের আটকাইনি। আমাদের দলের মধ্যে একজন এই কবরস্থান নিয়ে তার বহুদিন আগে কোথাও পড়া কিছু গল্প আমাদের বলে। আমরাও সাথে সাথে উৎসাহে লাফিয়ে উঠি, সবকিছু জানার পরেও। আগাগোড়া কিছু না ভেবেই আমরা পৌঁছে যাই কবরস্থানের দরজার ঠিক বাইরে।
পরমুহূর্তেই যেন আমরা পৌঁছে গেছিলাম কবরস্থানের ভিতরে, যেন খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম ইতিহাসের আড়ালে লুকানো কবরে শায়িত আত্মাদের গল্প। আসলে কৈশোর বয়সটাই তো এমন, তাই না, কোনো কিছু না ভেবে হুজুগে গা ভাসিয়ে দেওয়ার। আমাদের কৌতূহলের তাড়নায় আমরা বুঝতেই পারিনি কখন আমরা হয়ে উঠেছিলাম দায়িত্বজ্ঞানহীন, শুরু করেছিলাম হৈ হট্টগোল। অল্পবয়েসি নির্বোধ একদল বাচ্চার দলের মতোই আমরা কবরস্থানের মধ্যেই মেতে উঠেছিলাম চটুল রসিকতায়, সেলফি তোলায়। যদিও আমাদের উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না, তবুও আমাদের কাজকর্মের ফলাফল যে এত ভয়ানক হয়ে উঠবে আর এত তাড়াতাড়ি ঘটে যাবে, তা আমরা ভাবতেই পারিনি।
তারপর কী হল?
কবরস্থানের ভেতর আধ ঘণ্টা মতো সময় কাটানোর পর, আমরা বেরিয়ে এসে আবার পথ চলতে শুরু করি। আমি আবার গাড়ি চালাতে শুরু করি। কিন্তু এক কিলোমিটার যেতে না যেতেই আমি প্রচন্ড পরিশ্রান্ত হতে শুরু করি। এর আগে আমার সাথে এরকম কখনও হয়নি। মনে হচ্ছিল যেন আমার পা থেকে যেন সমস্ত রক্ত চুষে নেওয়া হয়েছে, বদলে আমার প্রাপ্য প্রচন্ড ক্লান্তি আর প্রচন্ড ব্যাথা। ও কিছু নয়, শুধু মাসল স্প্যাজম বলে আমি নিজেই নিজের মনকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম। হোটেলে ফিরে আসার পর কিন্তু আমাদের অবস্থার আরও অবনতি হয়। আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা সকলেই প্রবল জ্বরে পরি, এবং ততক্ষণে আমরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারি।
বলা বাহুল্য, এরপরে কি করা উচিত আমাদের তা আমরা বুঝতে পারিনি। ঘুমিয়ে পড়লে কমে যাবে ভেবে আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়ি, কিন্তু কয়েক ঘণ্টা বাদে আমাদের ঘুম ভাঙে আরও করুণ অবস্থায়। জ্বর কিছুতেই না কমায় আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। আমাদের মধ্যেই একজন স্যুপ খাওয়ার পরামর্শ দেয়। অজয়, আমাদের ওয়েটার, ঘরে স্যুপ নিয়ে আসেন এবং এক মুহূর্তেই বুঝতে পারেন যে কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। আগের রাত্তিরে যে ছেলেগুলো সারারাত হৈ হুল্লোড় করে পার্টি করেছে, আজ তারাই বিছানায় গুটিসুটি মেরে পরে রয়েছে।
আসতে আসতে আমরা অজয়ের সাথে কথা বলতে বলতে তাকে সব খুলে বলি। তিনিই যেন আমাদের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। কবরস্থানটির ব্যাপারে সমস্তটা আমাদের খুলে বলেন এবং আমাদের বোঝান যে আমরা কত বড় ভুল করেছি। তার কথা মতো আমরা সবাই গোল হয়ে বসি। তিনি আমাদের বলেন তাকে অনুসরণ করতে এবং তিনি যা বলবেন আমাদের তা পুনরাবৃত্তি করতে। তার কথা মতো আমরা সমস্ত শক্তিগুলোর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। আমরা বার বার বলি যে আমাদের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না এবং আমরা কাউকে অসম্মান করতে চাইনি, এবং ভবিষ্যতে আর কখনও আমরা এরকম কিছু করব না।
এই গল্পের সারমর্ম
বিশ্বাস করুন বা না করুন, এই ছোট্ট হোটেলের একটা ঘুপচি ঘরে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমেই কিন্তু আমরা অশুভ আত্মাদের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম। পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙার পর আগের দিনের গ্লানির চিন্হমাত্র ছিল না। আমরা মেনে নিই যে আমাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের জন্যেই আমরা এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম এবং এটাই হওয়ার ছিল।
তাই বন্ধুরা, মনে রাখবেন, যেখানেই যাবেন, সেই স্থান এবং স্থানীয় লোকেদের, সেখানকার আচার উপাচারের সম্মান করবেন। আর যদি কখনো ভূতুড়ে কিছুর সম্মুখীন হন, তাহলে খুব সাবধানে আপনার পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন।