মনে পড়ে? ছোটবেলায় একটা সময় গরমের ছুটি আর পুজোর ছুটির মানেই ছিল সদল বদলে সপরিবারে ঘুরতে যাওয়া? আর ঘুরতে যাওয়ার কথা উঠলেই উঠে আসত দীঘা, পুরী বা দার্জিলিংয়ের নাম। শুধু গ্রীষ্মকাল বা শরৎকাল কেন, অফিস ট্যুর বলুন, কলেজের বন্ধুদের নিয়ে একসঙ্গে প্রথমবার বাবা মা ছাড়া বেড়াতে যাওয়া, এমনকী বাঙালির আদি এবং অকৃত্রিম হানিমুন ডেস্টিনেশনও ছিল আমারদের এই দীপুদা। দীঘার ঝাউবনের সারির দিকে তাকিয়ে বা পুরীর জগন্নাথ মন্দির দর্শনের লাইনে দাঁড়িয়ে বা কেভেন্টার্সের ছাদে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার মধ্যে যে আমেজ আছে, তা কিন্তু বাঙালির মননে এবং অবচেতনে বংশানুক্রমে বেঁচে আছে। আমাদের, কিংবা আগের প্রজন্মের এবং তারও আগে থেকেই ভ্রমণের প্রথম হাতেখড়ি শুরু হয়েছে দীপুদার হাত ধরেই।
মনে করুন সেই ছোটবেলার কথা, হই হই করে গোটা পরিবার শিয়ালদহ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, দার্জিলিং মেল ঢোকার অধীর আগ্রহে। আপনার হাতে হয়তো ফেলুদার বই, দার্জিলিং জমজমাট বা ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি গল্পগুলো পরে দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি আঁকা বাঁকা রাস্তা ঘাট আর পাইন গাছের জঙ্গল আপনাকে কাছে ডাকছে। ট্রেনের ছাড়ার কিছু সময় পরেই হয়তো মা কাকীমার ব্যাগ থেকে বেরিয়ে আসছে থালা বাটি, যার ভেতরে গরম গরম লুচি আর আলুরদম। ট্রেনের দুলুনিতে আধো ঘুমে আধো অন্ধকারে সকাল হওয়ার পর বাইরে তাকিয়ে দেখছেন সবুজের সমারোহ। সত্যি, পৃথিবীটা আরও সবুজ ছিল তখন, তাই না? জলপাইগুড়ি থেকে গাড়ি উপরে উঠতে শুরু করার আগেই রয়েছে সেভকের অপরূপ মনোরম সৌন্দর্য, আর দুপাশে চা বাগানের হাতছানি। আসতে আসতে চড়াই যত বাড়তে থাকে, তত জাঁকিয়ে শীত নেমে আসে। সোয়েটার টুপি পরে, গুটিসুটি হয়ে বসে অপেক্ষা কতক্ষণে ট্রেন ম্যালে পৌঁছবে।
মনে আছে প্রথম যে বারে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছিলেন, মেঘের আড়ালে কেটে যেতেই যার শ্বেতশুভ্ররূপ আপনাকে দার্জিলিংকে ভালবাসতে শিখিয়েছিল? শহরের রাস্তার প্রতিটি বাঁকে বাঁকে নতুন নতুন ভাবে পাহাড়ি জীবনযাত্রাকে খুঁজে পাওয়া, পাহাড়ি মানুষজনের অদ্ভুত সারল্য, সব মিলিয়ে যেন এক স্বর্গের দেশ। কেভেন্টার্সের হট চকোলেট বা গ্লেনারিসে রোস্ট চিকেন, বা আরেকটু বড় হয়ে জোয়িস পাবে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক, দার্জিলিংয়ের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত রোম্যান্টিসিজম। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি, ব্রিটিশ আর্কিটেকচার আর বাঙালি আবেগের সংমিশ্রণে তৈরি যেন এক 'সব পেয়েছির দেশ'।
বাঙালির প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ বোধহয় লুকিয়ে আছে দীঘার সমুদ্রতটে। সে বিয়ের পরে নবদম্পতির হানিমুনে একে অপরের ভালবাসায় জড়িয়ে পড়া থেকে হোক বা ভেতো বাঙালির মহাসমুদ্র দর্শনের পর নিজেকে মহারাজ মনে হওয়ার অনুভূতি থেকেই হোক, দীঘা মানেই ছিল কিন্তু একটা রাজকীয় ব্যাপার। সমুদ্রতটের পাড়ে বসে, দিগন্তে সূর্যের ঢলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ ভরে ওঠে নানা রঙের কারসাজিতে, আবার ভোরবেলা সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যেত সমুদ্র থেকে নৌকা বোঝাই মাছ নিয়ে ফিরে আসছে মাঝি ভাইরা। বিকেলবেলাতে হয়তো বিচের ধারে কোনও ছোট্ট দোকান থেকে কিনে খেতেন নানা রকম মাছভাজা, কাঁকড়া বা চিংড়ি মাছ।
সকলে মিলে দীঘার অগভীর সমুদ্রের জলে নেমে সারা সকাল দুপুর কাটিয়ে, চান করে, হই হুল্লোড় করে উঠে আসার মধ্যে ছিল শৈশবের আনন্দের ছোঁয়া। স্মার্টফোন জমানার আগে সি বিচে তখন ছবি তুলতে সহায় হতে হতো কোডাকের ক্যামেরার। সেলফি তোলার হিড়িকে হারিয়ে যাওয়ার আগে দীঘার বালুকাবেলায় ঘোড়ায় চড়া ছবি হয়তো এখনও আপনার বাড়িতে সাজানো। রাস্তার ধারের দোকান থেকে কিনে আনা শামুকের ঘর সাজানোর জিনিস আজও স্মৃতিবিজড়িত হয়ে আছে শোকেসে। হয়তো দীঘার বিচে কোনও এক বিকেলবেলা যখন শেষ বিকেলের আলোয় আর সমুদ্রের প্রাণখোলা হাওয়ায় সবাই মাতোয়ারা তখন আপনার মনে ভিড় করে এসেছে ছুটি শেষের মেলাঙ্কলি সুর।
আসলে ৭০ বা ৮০র দশকে বা ৯০ দশকের অধিকাংশ সময় জুড়ে মধ্যবিত্ত বাঙালির সাধ আর সাধ্যের মেলবন্ধন ঘটেছিল এই কয়েকটি জায়গায় মাধ্যমে। তাই জায়গাগুলো হয়ে উঠেছিল এত জনপ্রিয় আর বার বার ছুটি কাটানোর ফলে হয়ে উঠেছিল যেন আমাদেরই নিজস্ব আনন্দ উদ্যান। তাই পুরী কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাইরে অবস্থানের পরেও কখনও তার আদ্যোপান্ত বাঙালিয়ানায় কোনও ভাটা পড়েনি।
পুরীর উত্তাল সমুদ্রে বাঙালি খুঁজে পেয়েছে অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ, আর তার ধর্মীয় নিষ্টাও পূর্ণ করেছে কখনও শ্রী জগন্নাথ মন্দিরে পুজো দিয়ে বা কোর্ণাকের সূর্য মন্দিরের কারুকার্যের পাশে দাঁড়িয়ে একমুখ হেসে ছবি তুলে। লোকনাথ মন্দির বলুন বা চক্র তীর্থ, পুরী বেড়াতে এসে বাঙালীর ঘুরে ঘুরে সাইট সিয়িং করা কিন্তু পৃথিবী বিখ্যাত। পুরীর খাবার কথাই বা ভোলা যায় কিকরে, সামুদ্রিক মাছ মাংস না হয় ছেড়েই দিলাম, কাকাতুয়ার খাজার স্বাদ আজও আমাদের জিভে লেগে আছে। আর পুরী বেড়াতে এসে অন্তত একবার নন্দন কাননে বাঘ দেখে যাননি বা চিলকা হ্রদের তীরে দাঁড়িয়ে পরিতৃপ্ত হননি, এইরকম কাউকে খুঁজে বার করাটাই মুশকিল। তাই আমাদের পুরনো ফোটো অ্যালবামগুলো বের করলে দেখতে পাই কীভাবে আমাদের শৈশব জুড়ে ছিল দীপুদা।
একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তির যুগে হয়তো গোটা পৃথিবী আমাদের হাতের মুঠোয়। আন্দামান নিকোবর, মালদ্বীপের সমুদ্র বা সুইজারল্যান্ডের পাহাড়, দুই-ই এখন সমানভাবে বাঙালিদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু ২০২০ সালের শেষে এসে যখন আমরা এতদিন ঘরবন্দি, যখন আন্তর্জাতিক ডেস্টিনেশনগুলো তাদের দরজা আমাদের জন্যে দরজা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে, তখন কেমন হয় আবার করে দীপুদার কোলে ফিরে গেলে?
যুগের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজ আমাদের চির পরিচিত দীঘা, পুরী বা দার্জিলিং-ও হয়ে উঠছে বিশ্বমানের গন্তব্যস্থল। সাস্টেনেবল ট্যুরিজম বা পরিবেশবান্ধব পর্যটনের কথা মাথায় রেখে, সরকারের প্রচেষ্টায় এই জায়গাগুলো হয়ে উঠছে নতুন যুগের উপযোগী। দার্জিলিংয়ের আশেপাশের বিভিন্ন স্পট, যেমন বড় মানগোয়া, চটকপুর, লেপচাজগৎ বা লামহাটায় গড়ে উঠছে ইকো ট্যুরিজম হাব। শুধু দীঘায়ে আটকে না থেকে মন্দারমনি, তালসারি, উদয়পুর বা শংকরপুর বিচেও আজকাল নতুন যুগের বাঙালিদের আনাগোনা।
নস্টালজিয়া আর ভালোবাসার দীপুদা তাই আজ আমাদের প্রজন্মকে নতুন করে ডাক দিচ্ছে, নতুন স্মৃতি গড়ে তোলার আহ্বানে আজ আমরা আবার ফিরে যাচ্ছি শৈশবের পথে। চলুন, প্যান্ডেমিকের পরে দীপুদাই হয়ে উঠুক আমাদের আগামী গন্তব্যস্থল।