ভাগীরথী নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই নগরীর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। ১৭১৭ থেকে ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার একচ্ছত্র রাজধানী ছিল এই শহর; দেওয়ান নবাব মুর্শিদকুলি খানের নামে নামাঙ্কিত হয়ে পরিচিত হয়েছিল মুর্শিদাবাদ নামে। তৎকালীন ঐতিহাসিক পটভূমিকায় বর্ধিষ্ণু মুর্শিদাবাদ সমগ্র বাংলা তথা ভারতের রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং সামাজিক উন্নতির দিক থেকে অগ্রগণ্য হয়ে উঠেছিল। ১৭৫৭ সালে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া পলাশীর যুদ্ধের সাক্ষীও ছিল মুর্শিদাবাদ। আজও মুর্শিদাবাদের আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং সম্পদ। চলুন, জেনে নিই মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের নানান খুঁটিনাটি।
মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ - কী কী দেখবেন
হাজারদুয়ারী প্যালেস : হুমায়ুন জাহ-র শাসনকালে ১৮৩৭ সালে হাজারদুয়ারী প্যালেসের গোড়াপত্তন। নিজামত কিলা নামক পুরনো এক দুর্গের স্থানে এই প্যালেসটি তৈরি করা হয়। সমগ্র প্যালেসে ১০০০টি দরজা আছে (যার মধ্যে ১০০টি আসল)। বর্তমানে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া থেকে এই প্যালেসটিকে মিউজিয়ামে পরিণত করা হয়েছে। ভেতরে আছে নবাবী আমলের বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র, ডাচ, ফ্রেঞ্চ এবং ইতালিয় শিল্পীদের আঁকা শিল্পকর্ম, মার্বেলের স্ট্যাচু, বিরল বই এবং আরও অনেক কিছু। ভারতবর্ষের বৃহত্তম ঐতিহাসিক মিউজিয়ামের মধ্যে এটি অন্যতম এবং মুর্শিদাবাদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।
বড়া ইমামবাড়া : হাজারদুয়ারী প্যালেসের ঠিক উল্টোদিকেই আছে বড়া ইমামবাড়া। নবাব সিরাজউদ্দৌলার স্থাপিত কাঠের তৈরি ইমামবাড়া আগুনে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর ১৮৪৭ সালে নবাব নাজিম মনসুর আলী খান ফেরাদুন জাহ-এর নির্দেশে এই নতুন ইমামবাড়াটি স্থাপিত হয়। বর্তমানে ইমামবাড়াটি তিনটি ভাগে বিভক্ত এবং ভেতরে আছে মদিনা মসজিদ, মেম্বারদালান এবং নহবতখানা।
ক্লক টাওয়ার : ইমামবাড়া এবং হাজারদুয়ারী প্যালেসের মাঝের বিশাল মাঠের পারে আছে সুবিশাল এক ক্লক টাওয়ার। ক্লক টাওয়ারের মাথায় ঘণ্টা পর্যটকদের নিয়মিত সময়ের জানান দেয়।
এছাড়াও এই অঞ্চলে, ভাগীরথীর একদম তীরে এখনও দাঁড়িয়ে আছে হলুদ রঙের জুরুদ মসজিদ। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পৃষ্ঠপোষকতায় এই মসজিদটি তৈরি হয়।
কাতরা মসজিদ : ১৭২৩ খ্রিস্টাব্দে নবাব মুর্শিদ কুলি খানের তত্ত্বাবধানে তৈরি হয় সুবিশাল কাতরা মসজিদ, যেখানে একসঙ্গে প্রায় ২০০০ মানুষ নমাজ পড়তে পারতেন। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মসজিদের নানান দিক ভেঙে পড়লেও, আজও এটি খুব জনপ্রিয় এবং পর্যটকদের অত্যন্ত প্রিয় স্থান।
আজিমুন্নিসা বেগমের কবর : মুর্শিদকুলি খানের পুত্রী আজিমুন্নিসার কবর এবং মৃত্যু নিয়ে আছে বহু গল্পকথা। বলা হয় তিনি শিশুদের রক্ত এবং মাংস খেতেন এবং সেই কারণে তাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়। বর্তমানে কবরটি এমনভাবে অবস্থিত, যাতে পর্যটকরা এখানে এলে কবরের উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে যেতে হয়।
জাফরগঞ্জ কবরস্থান : হাজারদুয়ারী থেকে মোটামুটি দেড় থেকে দুই কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে পাবেন জাফরগঞ্জ কবরস্থান, যার ভিতরে আছে মীরজাফরের কবর। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কবর বলতে এখানে শায়িত আছেন মীরজাফরের পিতা, তার দুই বেগম মুন্নি এবং বাব্বু, ভাই মোহাম্মদ আলী খান এবং আলীবর্দী খানের বোন শাহখানুম।
কাঠগোলা বাগান বাড়ি : রাজা ধনপত সিং দুগার এবং লক্ষিপত সিং দুগারের এই প্রাসাদোপম বাগানবাড়ি টি বানানো হয়েছিল ১৮৭৩ সালে। এই বাগান বাড়ির সাথেই আছে আদিনাথ দিগম্বর জৈন মন্দির। অপূর্ব সুন্দর এই বাড়িটি এবং জৈন মন্দিরের কারুকলাপ দেখতে বহু পর্যটক এখানে আসেন। বাড়িতে একটি ছোট চিড়িয়াখানা আছে। এবং আছে বিখ্যাত মাইকেলেঞ্জেলোর তৈরি একটি মূর্তি।
এই অঞ্চলে দেখতে পাবেন আরও কিছু দর্শনীয় স্থান, যার মধ্যে বিখ্যাত ব্যবসায়ী জগৎ শেঠের বাড়ি। বর্তমানে এটি একটি মিউজিয়ামে রূপান্তরিত হয়েছে। মিউজিয়াম চত্বরেই আছে একটি পরেশনাথ মন্দির। ঘুরে দেখতে পারেন নাসিপুর প্যালেস, রাজা কীর্তিচাঁদ বাহাদুরের বাড়ি; ভিতরে আছে রামচন্দ্র এবং লক্ষ্মী-নারায়ণ মন্দির। কাটরা মসজিদের দক্ষিণপূর্ব দিকের তোপখানায়ে অবস্থিত জাহান কোষা নামক কামানটিও প্রভূত বিখ্যাত।
হাজারদুয়ারী প্যালেস চত্বরের দক্ষিণ দিকেও আছে বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান, যেমন সুউচ্চ ত্রিপোলিয়া গেট, যার মাথায় আছে নহবতখানা, দেখতে পারেন চক মসজিদ এবং সফেদ মসজিদ। মুর্শিদাবাদের নবাবী আমলের বহু পুরনো মসজিদ কালের প্রকোপে ধংসাবশেষে পরিণত হয়েছে, কিন্তু ঐতিহাসিক দিক থেকে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ঘুরে আসতে পারেন মতিঝিল থেকে। ঘসেটি বেগমের স্বামী নাওয়াজেশ মোহাম্মদের তত্ত্বাবধানে তৈরি এই ঝিলের তীরেই লর্ড ক্লাইভ বাংলার দেওয়ানি অধিগ্রহণ করেন। একে একে ওয়ারেন হেস্টিংস, স্যার জন শোর এবং লর্ড টেইনমাউথও এখানে বসবাস করেন। অনতিদূরের মসজিদটি মতিঝিল মসজিদ নামে পরিচিত।
কাশিমবাজার অঞ্চলে গেলে দেখতে পাবেন বড় এবং ছোট রাজবাড়ি। বড় রাজবাড়িটির এখন প্রায় কিছুই অবশেষ নেই, ছোট রাজবাড়ি বা রায় প্যালেস বর্তমানে একটি হেরিটেজ হোটেলে রূপান্তরিত হয়েছে। রায় বংশের হাত ধরেই মুর্শিদাবাদের সিল্কের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল।
এই অঞ্চলে পাবেন বেশ কিছু বিদেশি দ্রষ্টব্য, যেমন ব্রিটিশ এবং ডাচ সেমেন্ট্রি এবং ১৭৫৮ সালে প্রতিষ্টিত সেন্ট মেরি আর্মেনিয়ান চার্চ অফ সায়দাবাদ।
মুর্শিদাবাদে কী কী কিনবেন :
মুর্শিদাবাদের তাঁত বা সিল্ক শাড়ির সুখ্যাতি সর্বজনবিদিত। তাই মুর্শিদাবাদে এলে এখানকার বালুচরী এবং সিল্ক কোরা শাড়ি অবশ্যই কিনতে পারেন। বহরমপুরে বা খাগড়ার বিভিন্ন শাড়ির দোকানে এগুলো পাবেন।
এখানকার শোলার তৈরি শিল্পকর্ম, পিতল, কাঁসা বা তামার বিভিন্ন ঘর সাজানোর জিনিসও বেশ বিখ্যাত।
মুর্শিদাবাদে কী কী খাবেন :
মুঘল ঘরানার খাবার বাংলার স্বাদ এবং স্বভাবের অনুপ্রেরণায় নতুন স্বাদের ধারক ও বাহক হয়ে এক কালে এই অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। মুর্শিদাবাদের নবাবী ঘরানার সেই অকৃত্রিম খাবার দাবার দুর্ভাগ্যবশত লুপ্তপ্রায় এবং কোনো নির্দিষ্ট হোটেল বা রেস্টুরেন্টে উপলব্ধ নয়। তবুও সুযোগ পেলে এখানকার বিরিয়ানি, বিভিন্ন রকম মাছের তরকারি এবং কাবাব খেয়ে দেখতে পারেন।
মিষ্টির মধ্যে মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জের ক্ষীরমোহন এবং বহরমপুরের ছানাবড়া খুবই বিখ্যাত। সঙ্গে করে এগুলো নিয়েও আসতে পারবেন।
মুর্শিদাবাদে কখন যাবেন :
গ্রীষ্মকালের তীব্র তাপমাত্রা এড়িয়ে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির শীতল পরিবেশেই মুর্শিদাবাদ আদর্শ। তবে আপনি যদি চান খাস মুর্শিদাবাদের আম খেতে, তাহলে গ্রীষ্মকালেই যেতে হবে। রানীপসন্দ, এনায়েতপসন্দ, বিমলি,কালাপাহার, হিমসাগর, মোলামজাম, কোহিতুর, চন্দনকোসা, গুলাবখাস, শাহাদুল্লা ইত্যাদি বিভিন্ন জাতের আম জিয়াগঞ্জ এবং আজিমগঞ্জে পাবেন শুধুমাত্র গ্রীষ্মকালে।
মুর্শিদাবাদে কীভাবে পৌঁছবেন :
মুর্শিদাবাদ পৌঁছনোর জন্য সড়কপথে পশ্চিমবঙ্গের সকল জেলার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ ভাল। কলকাতার হাওড়া, শিয়ালদহ এবং কলকাতা রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেন চলে এবং সময় লাগে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা। বহরমপুর কোর্ট স্টেশন বা কাশিমবাজার স্টেশনে নেমেও ভেতরে আসতে পারেন।
দূরপাল্লার বাসেও কলকাতা ও অন্যান্য জেলা থেকে মুর্শিদাবাদ পৌঁছনো যায়।
বিমানপথে আসতে হলে শুরু করতে পারেন কলকাতার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট থেকে।
আশা করি মুর্শিদাবাদের ইতিহাস এবং স্থাপত্যের বৰ্ণনা পরে আপনিও নিজের চোখে দেখতে চান, পৌঁছে যেতে চান এই হারানো সাম্রাজ্যের দেশে। ফ্যামিলি বা সোলো, দুরকম ট্রিপের জন্যেই আদর্শ মুর্শিদাবাদ অপেক্ষা করে রইল আপনার আগমনের।