প্রথাগত অর্থে মিউজিয়াম বা জাদুঘর বলতে আমরা বুঝি এমন কিছু সংগ্রহশালা যেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক, শৈল্পিক, ঐতিহাসিক বা সাংস্কৃতিক গুরুত্ব সম্পন্ন বিভিন্ন উপাদান সংরক্ষণ করা হয়, সাধারণ মানুষদের জন্য সাজিয়েও রাখা হয়। মিউজিয়াম বলতেই হয়তো আমাদের মনে আসে কলকাতার সুপ্রাচীন (এবং দেশের প্রথম) ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম, যার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, সায়েন্স সিটি ইত্যাদি বেশ কিছু বিখ্যাত জাদুঘর আমাদের সুপরিচিত। কিন্তু এইসমস্ত বিখ্যাত মিউজিয়ামগুলো ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের আনাচে কানাচে রয়েছে ভিন্নস্বাদের বিভিন্ন সংগ্রহশালা। আসুন দেখে নেওয়া যাক সেইরকমই কিছু মিউজিয়াম, যারা নিজেদের সাজিয়ে তুলেছে ভিন্ন আঙ্গিকে।
১. হিমালয়ান তিবেত মিউজিয়াম
আমরা যারা পর্বতপ্রেমী, তাদের কাছে হিমালয় এবং তিব্বত চিরকাল এক অপার আগ্রহের বিষয়। তিব্বতি মানুষদের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ভারতবর্ষের সঙ্গে তাদের ইতিহাস এবং সম্পর্কের কথা জানতে চাইলে হিমালয়ান তিবেত মিউজিয়াম একবারে আদর্শ স্থান। দালাই লামার ৮০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ২০১৫ সালের জুলাই মাসে এই মিউজিয়ামটি উদ্বোধন করা হয় এবং শুধু তিব্বতি মানুষজন নয়, হিমালয় অঞ্চলের সকল জনগোষ্ঠীর ব্যাপারেই এখানে তথ্য পাওয়া যাবে। দালাই লামার নিজস্ব সংগ্রহশালা থেকেও বেশ কিছু জিনিস এখানে সংরক্ষিত।
কোথায় : দার্জিলিং, ম্যাল থেকে কিছু মিনিটের হাঁটা পথে গান্ধী রোডের উপর এই মিউজিয়ামটি অবস্থিত।
সময় : সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টে, বুধবার বাদে সপ্তাহের বাকি সব দিন মিউজিয়াম ভ্রমণ করতে পারেন।
টিকিট মূল্য : প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে ৫০/ , ৬ থেকে ১৫ বছর বয়স্কদের জন্যে ২৫/, শিশুদের জন্যে বিনামূল্যে।
২. কলকাতা পুলিশ মিউজিয়াম
কলকাতা পুলিশের যে একটা আস্ত মিউজিয়াম থাকতে পারে এটা ভেবে দেখেছিলেন? কিন্তু ১৯৯৬ সালে কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের নিজস্ব জাদুঘর জনসাধারণের জন্যে উদ্বোধন করা হয় এবং উৎসাহী দর্শকরা এখানে বাংলার বিপ্লবী ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে ব্যবহৃত নানা অস্ত্র স্বচক্ষে দেখতে পারবেন। কলকাতা পুলিশের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট, স্পেশাল ক্রাইম ব্রাঞ্চ প্রভৃতির গুরুত্বপূর্ণ কেসের বিবরণ এবং নথিপত্রও এখানে পাবেন। আছে বিভিন্ন অপরাধ এবং কলকাতার ইতিহাস সংক্রান্ত নানা বই এবং দলিল। নেতাজি সুভাষচন্দ্র সম্পর্কিত ৬৪টি ফাইল ও বর্তমানে এখানে সংরক্ষিত।
কোথায় : ১১৩, এ.পি.সি রোড, কলকাতা ৭০০০০৯
সময় : সোমবার বাদে রোজ সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৫টা
টিকিটমূল্য : প্রবেশ বিনামূল্যে
৩. কলকাতা ট্রাম মিউজিয়াম
যদি ট্রাম নিয়ে একটা জাদুঘর থাকতো? যদি সেই আস্ত মিউজিয়ামটিই তৈরি হত একটি ট্রামের মধ্যে? ২০১৪ সালে কলকাতা ট্রাম কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে ১৯৩৮ সালের একটি ভিন্টেজ ট্রামবগিকে সম্পূর্ণ ভাবে নতুন করে স্মরণিকা নামক এরকমই একটা ট্রাম মিউজিয়াম স্থাপন করা হয়। ভেতরে পাবেন ভারতীয় ট্রামযাত্রার ইতিহাসের বিভিন্ন বিরল স্মৃতিচিহ্ন। পুরনো কলকাতার বিভিন্ন ফটো, ঘোড়ায় টানা ট্রামের মডেল, বিভিন্ন পুরনো যন্ত্রাংশ, সবই পাবেন ভিতরের প্রদর্শনীতে। দর্শকদের জন্য একটি ক্যাফেও আছে এখানে, এক কাপ কফিতে চুমুক দিয়ে হারিয়ে যেতে পারেন ইতিহাসের হাতছানিতে।
কোথায় : এস্প্ল্যানেড, ক্যালকাটা ট্রাম করপোরেশন কন্ট্রোল অফিস
সময় : দুপুর ১টা থেকে রাত ৮টা, বৃহস্পতিবার বাদে রোজ
টিকিটমূল্য : মাথাপিছু ১০ টাকা
৪. হাওড়া রেল মিউজিয়াম
ভারতীয় রেল পরিবহনের অন্যতম পীঠস্থান হাওড়া স্টেশন, সহস্রাধিক বছর পুরনো এই স্টেশনের সাথে জড়িয়ে আছে বহু ইতিহাস, বহু ঘটনা। সেই ট্রেন যাত্রার ইতিহাসের বিভিন্ন স্মৃতিবিজড়িত চিন্হ এবং বহু ভিন্টেজ রেল ইঞ্জিন মডেল দিয়ে সাজানো এই রেল মিউজিয়ামটি। ভিতরে আছে একটি মিনিয়েচার হাওড়া স্টেশন, যেখান থেকে মিনিয়েচার রেল মডেল অনবরত ঘুরছে। রেল মিউজিয়ামের ভিতরের জায়গাটাও বেশ বড় এবং এখানে বাচ্চাদের খেলার জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা করা আছে। টয় ট্রেন রাইডের ব্যবস্থাও করা হয় এখানে।
কোথায় : ফোর্শর রোড, হাওড়া স্টেশন নিউ বিল্ডিং থেকে একটু এগিয়ে
সময় : সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫.৩০টা, সোমবার বাদে রোজ
টিকিটমূল্য : ১০টাকা, টয় ট্রেন রাইডের টিকিট আলাদা
৫. ফ্যানাটিক স্পোর্টস মিউজিয়াম
বিদেশে স্পোর্টস মিউজিয়ামের প্রচলন প্রবল ভাবে থাকলেও ভারতবর্ষে বা পশ্চিমবঙ্গে সেভাবে স্পোর্টস মিউজিয়াম বা সংগ্রহশালা দেখতে পাওয়া যায় না। তবে সৌভাগ্যক্রমে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে নিউটাউনে ফ্যানাটিক স্পোর্টস মিউজিয়ামের সূচনা করা হয়। ফুটবল এবং ক্রিকেটের ওপর প্রাধান্য থাকলেও ভারতের অন্যান্য বিভিন্ন খেলা বা ত্রীড়া নিয়ে এখানে প্রদর্শনী হয়। পাওয়া যায় নানারকম মেমরিবিলিয়া। বিখ্যাত খেলোয়াড়দের জার্সি, টুপি, অটোগ্রাফ, সবই পাওয়া যাবে এক ছাদের তলায়। কিছু নির্দিষ্ট আইটেম ইচ্ছে করলে কিনতেও পারবেন এখান থেকে।
কোথায় : ইকোস্পেস বিজনেস পার্ক, নিউটাউন, চকপাচুরিয়া
সময় : সকাল ১১টা থেকে সন্ধে ৭টা, সোমবার বাদে রোজ
টিকিটমূল্য : মাথাপিছু ১০ টাকা
৬. মাদার্স ওয়াক্স মিউজিয়াম
শাহরুখ খানের সাথে ফটো তুলতে চান, নাকি রাজা রামমোহন রায়ের সাথে? বাচ্চাদের ভালো লাগবে এরম আরেকটি মিউজিয়াম হলো মাদার্স ওয়াক্স মিউজিয়াম, যেখানে দেশ বিদেশের বিভিন্ন সেলিব্রিটির মোমের প্রমান সাইজ মডেল তৈরি করে রাখা হয়েছে এবং দর্শকরা এই মডেলগুলোর সঙ্গে খুশি মতো সেলফি বা ফটোশুট করতে পারেন। লন্ডনের মাদাম তুসো ওয়াক্স মিউজিয়ামের আদলে বানানো আমাদের শহরের এই মিউজিয়ামটি খুব অল্প সময়েই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মিউজিয়ামের সমস্ত মূর্তিগুলো স্পোর্টস, বলিউড, হিস্টোরি এন্ড লিডার্স, হলিউড এবং মিউজিক এই ৫টি ভাগে সাজানো।
কোথায় : ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স সেন্টার, নিউটাউন
সময় : দুপুর ১২টা থেকে সন্ধে ৭.৩০টা, সোমবার বাদে রোজ
টিকিটমূল্য : মাথাপিছু ২৫০ টাকা, ৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের প্রবেশ বিনামূল্যে
৭. ইনস্টিটিউট দে চান্দেরনাগর
পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম পুরানো মিউজিয়াম চন্দননগরের ডুপ্লে প্যালেসে অবস্থিত এই ফরাসি স্মৃতিবিজড়িত মিউজিয়ামটি। ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধে ব্যবহৃত বহু অস্ত্র এখানে সংরক্ষিত আছে। আছে ভারতের ক্ষুদ্র ফরাসি শাসনকালের নানা নিদর্শন, আছে বিভিন্ন ফ্রেঞ্চ গভর্নর জেনারেলের ব্যবহৃত আসবাবপত্র, আছে স্থানীয় এবং ফরাসি কলোনিয়াল ইতিহাসের বিবরণ। এখানে ফ্রেঞ্চ শেখানোর নিয়মিত ক্লাসের ব্যবস্থাও করা হয়।
কোথায় : স্ট্রান্ড রোড, চন্দননগর
সময় : সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যে ৬.৩০টা, বৃহস্পতিবার এবং শনিবার বন্ধ
টিকিটমূল্য : ভারতীয়দের জন্যে ৫/, বিদেশীদের জন্যে ২০/
৮. দ্য আর.বি.আই মিউজিউম
একটি অত্যন্ত স্বল্পপরিচিত মিউজিয়াম হল রিসার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার এই সংগ্রহশালাটি। অর্থ এবং মুদ্রার ইতিহাস, আমাদের দেশের ইতিহাসে এবং বর্তমান সমাজে অর্থের ভূমিকা এবং তার সাথে সাধারণ মানুষের কি সম্পর্ক, খুব সহজ সরল ভাবে এখানে বিভিন্ন প্রদর্শনীর মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কীভাবে নানারকম মুদ্রা এবং অর্থনীতির যুগে যুগে বিবর্তন হয়েছে তাও জানা যাবে। গোল্ড মাইনিং বা স্বর্ণখননের ওপরেও আছে একটি ইন্টারেক্টিভ প্রদর্শনী।
কোথায় : ৮, কাউন্সিল হাউস, বি বা দী বাগ, কলকাতা ৭০০০০১
সময় : মঙ্গল থেকে রবিবার, সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা
টিকিটমূল্য : প্রবেশ বিনামূল্যে
৯. বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড টেকনোলজিকাল মিউজিয়াম
ভারতবর্ষের প্রথম বিজ্ঞান মিউজিয়াম হিসেবে এই জাদুঘরের স্থাপনা। বিভিন্ন রকম ইন্টারেক্টিভ মডেল, বিজ্ঞান বিষয়ক প্রদর্শনী, শিক্ষামূলক ক্রিয়াকর্মের মাধ্যমে ছাত্রসমাজের মধ্যে বিজ্ঞানশিক্ষার প্রতি ভালবাসা এবং অনুপ্রেরণা ছড়িয়ে দেওয়া এই মিউজিয়ামের অন্যতম উদ্দেশ্য। ফিজিক্স, বায়োটেকনোলজি, অঙ্ক, ইলেক্ট্রিসিটি, টেলিভিশন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়েই বিভিন্ন গ্যালারি দর্শকদের জন্যে খোলা থাকে। কিছু শিখতে এবং জানতে চাইলে, বিড়লা বিজ্ঞান মিউজিয়াম একেবারে আদর্শ জায়গা।
কোথায় : ১৯ গুরুসদয় রোড, কলকাতা ৭০০০১৯
সময় : সকাল ৯.৩০টা থেকে সন্ধে ৬টা
টিকিটমূল্য : ৫০টাকা মাথাপিছু, ছাত্রছাত্রীদের জন্যে আছে বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা
১০. গাঞ্জুলামা ওয়ার মিউজিয়াম
যদিও এই মিউজিয়ামটি পশ্চিমবঙ্গের বাইরে তাও সিকিম পশ্চিমবঙ্গের একেবারে নিকটবর্তী হওয়ায়, সুযোগ পেলে অবশ্যই যেতে পারেন এখানে। এটি সিকিমের একমাত্র মিউজিয়াম যেটি ভারতবর্ষের বিভিন্ন বীর এবং শহীদ সৈন্যদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে স্থাপন করা হয়েছে। এই অঞ্চলের সৈন্যবাহিনীর বিভিন্ন যুদ্ধের বর্ণনা, তাদের ইতিহাস এবং জীবনযাত্রার বর্ণনা এখানে জানা যায়। একটি ডকুমেন্টারি সিনেমাও দেখানো হয়, যার মাধ্যমে আরও বিশদে আপনি এই প্রান্তিক পাহাড়ি অঞ্চলে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর বীরত্বের নানা গাথা জানতে পারবেন।
কোথায় : সারাথাং, সিকিম
সময় : সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টে
কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গের আশেপাশের এই দশটি মিউজিয়াম সকল উৎসাহী পর্যটকদের একবার অবশ্যই ঘুরে আসা উচিত।