পাহাড়ি অঞ্চল এবং তার প্রকৃতি সকল ভ্রমণপিপাসুদের কাছে সেরা পর্যটন স্থান হিসেবেই সুপরিচিত| কিন্তু পার্বত্য প্রকৃতির এই রূপসৌন্দর্য্যের সঙ্গেই আপনার হোটেলের অন্দরসজ্জাটির মধ্যেও যদি প্রাকৃতিক রূপের কোমল ছোঁয়া থাকে, তাহলে তার চেয়ে ভাল পর্যটন স্থান অন্য কিছুই হতে পারে না | সপ্তাহ শেষে এই ধরণের প্রকৃতির মনোরম পরিবেশে প্রিয়জনের সঙ্গে সেরা একটা মুহূর্ত কাটানোর জন্য আপনার গন্তব্য হয়ে উঠতে পারে ঝিল্লিঙ্গ টেরাস| এই হোটেলটির একটি অন্যতম আকর্ষণ হল, প্রত্যেকটি ঘরের নামকরণেই রয়েছে প্রকৃতির নিপুণ প্রতিচ্ছবির ছোঁয়া |
ঝিল্লিঙ্গ টেরাস:
১৯৩৩ সালে একজন সংস্কৃত পন্ডিতের পোলিশ স্ত্রী তাঁর নিজের দেশ পোল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন | সেই ইচ্ছা অনুসারেই সেই পন্ডিত উত্তরাখণ্ডের গভীর অরণ্যের মধ্যে, শীতল আবহাওয়া পরিপূর্ণ পরিবেশে, সুউচ্চ হিমালয়ের দক্ষিণে, গোলা রেঞ্জ নিকটবর্তী স্থানে একটি চেস্টনাট হাউস নির্মাণ করেন | ৮০ বছর পরে পুরনো সেই ভালবাসার বাড়িটি আজ ঝিল্লিঙ্গ টেরাস নামক হোমস্টেতে পরিণত হয়েছে |
এই হোমস্টেটি নির্মাণ করা হয়েছে নন্দাদেবী এবং অন্যান্য শৃঙ্গের মধ্যবর্তী অঞ্চলে | প্রাকৃতিক শোভা পরিবেষ্টিত এই হোমস্টেটির অন্দরসজ্জায় প্রকৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিকভাবে যুক্ত গাছপালা এবং জীবজন্তুর কোমল রূপ বৈচিত্র্যের আবছা ছোঁয়া লক্ষণীয়| এই হোমস্টের নিচের তলার দুইটি সুইট বুরাংশ ও উটিশ নামে পরিচিত, যার মধ্যে নিজস্ব একটি করে সাক্ষাৎকক্ষ আছে | এছাড়া উপরের তলায় কাফল ও পদম নামে দুই শয্যা বিশিষ্ট দুইটি সুইট আছে|
পদম:
হিমালয়ান চেরি ফুল ‘পদম’-এর নাম অনুসারে একটি মিনি সুইটটির নামকরণ হয়েছে |এছাড়াও হালকা গোলাপি রং করা এই কক্ষটির মেঝেটি কাঠ দ্বারা নির্মিত | এই মিনি সুইটে একটা সুন্দর বারান্দাও রয়েছে | এই বারান্দা থেকে সকালের সোনালি আভায় পূর্ণ হিমালয়ের রূপ অথবা সন্ধে নামার ঠিক আগে রঙিন আলোয় মাখা হিমালয়ের থেকে শুভরাত্রি অভিবাদন পেতে হলে আপনাকে আসতেই হবে ঝিল্লিঙ্গ টেরাসে|
কাফল
ভারতীয় ও নেপাল সীমান্ত বরাবর পার্বত্য অঞ্চলের বিখ্যাত ফল বে-বেরি বা বক্স মির্টলে- র নাম অনুসারে কক্ষটির নাম হয়েছে কাফল | দুইজনের থাকার মতো উপযুক্ত কক্ষটি হলুদ, ফিরোজা এবং সবুজ-এই তিনটি রং মিলিয়ে একটি নতুন রঙে সজ্জিত হয়েছে; যার প্রথম দর্শনেই একটা অন্যরকম আরাম অনুভূত হয় | কক্ষটির সুবিশাল জানালা দিয়ে উঁকি মারে একমাত্র হিমালয় | সারাদিন হিমালয়ের মুখোমুখি বসে একান্তে প্রকৃতির শোভা উপভোগ চাইলে কক্ষটির বারান্দাটি কিন্তু মন্দ নয় |
উটিশ
ভারতের উত্তরবর্তী অঞ্চলে সুবিশাল অল্ডার গাছের নাম অনুসারে কক্ষটির নাম উটিশ|এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, এই গাছের কাঠ মজবুত হওয়ার কারণে এটি অন্দরসজ্জার আসবাবপত্র নির্মাণের জন্য ব্যবহার করা হয় | কক্ষগুলোর মধ্যে তোয়ালে রাখার আলনা, টয়লেট পেপার এর হোল্ডার, এমনকি আয়নাটিও অল্ডার গাছের কাঠ দ্বারা নির্মিত | হালকা নীলাভ বর্ণের এই সুইটটি ছোট পরিবারের পর্যটকদের জন্য একেবারে উপযুক্ত | নিচের তলায় প্রশস্ত বারান্দা এবং সুইটের পিছনের দিকের ছোট্ট বাগানটি সমস্ত পর্যটকদের মন ভাল রাখার জন্য আদর্শ স্থান | উটিশে পর্যটকদের সাক্ষাৎকারীদের জন্য বিশেষ কক্ষের ব্যবস্থা আছে | এছাড়াও, সুইটের লিভিংরুমে একটি ফায়ারপ্লেস এবং সব বয়সের পর্যটকদের জন্য গেমিং ও ক্যাটারিং-এর বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে |
পাহাড়ি রডোডেনড্রন ফুলের একটি বিশেষ ধরণের নাম অনুসারে এই সুইটের নামকরণ হয়েছে বুরাংশ | বসন্তে বিকশিত এই ফুলের লাল রং অনুসরণ করেই সুইট- টিকে লাল রঙে আরও উজ্জ্বল করা হয়েছে | সুইটের অন্যতম আকর্ষণ হল ঐতিহ্যশালী ফায়ারপ্লেস, বিলাসবহুল পালঙ্ক, নির্দিষ্ট সাক্ষাৎকক্ষ, সুবিশাল বারান্দা ইত্যাদি |
ওক অরণ্যে ঐতিহ্যগত ভাবে ফলনকারী খর্বকায় বাঁশের নাম অনুসারে রিঙ্গল কটেজটির নামকরন হয়েছে | কটেজটির উপরের ছাদটির এই বাঁশের কাঠ দিয়ে নির্মিত | এই বাঁশ কাঠটি স্থানীয় মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয় | বাঁশ কাঠনির্মিত শিল্পকেই এখানকার মানুষ রোজগারের অন্যতম পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন | দুইতলা বিশিষ্ট এই সুইটে আলাদা শয়নকক্ষ, ভোজনকক্ষ, এবং সমস্ত রকম রন্ধন সরঞ্জাম বিশিষ্ট রান্নাঘর-ও রয়েছে |
অন্যতম আকর্ষণ:
ঝিল্লিঙ্গ নিকটস্থ দুটি ট্রেক কিন্তু খুবই রোমাঞ্চকর | ইচ্ছা করলে, এই ট্রেকগুলো আগে থেকে পরিকল্পনা করে ফেলুন আর বেড়িয়ে পড়ুন প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের উদ্দেশ্যে।
গুয়ালা নদী ট্রেইল:
একদিনের ট্রেকে সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়ুন এবং পার্বত্য গ্রাম পানায়ালি পেরিয়ে গুয়ালা নদীর আঁকাবাঁকা গতিপথ ধরে পৌঁছে যান নদীর উৎস সন্ধানের জন্য | দূর থেকে দেখলে এই নদীর উৎসস্থলটি এক্কেবারে ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতোই মনে হয় | নদীটি পাহাড়ের গা বেয়ে জলপ্রপাতের রূপ নিয়ে সমতলে নেমে বয়ে চলেছে আজীবনকাল ধরে | আবহাওয়া অনুকূল থাকলে নদীর বুকে একটু সাঁতরে নিতে চাইলেও অভিজ্ঞতা মন্দ হবে না | এই সুদূর প্রসারী ট্রেকের মধ্যে পথপ্রদর্শক দ্বারা নির্মিত ক্যাম্পে, মনোরম পরিবেশে পাহাড়ের কোলে দুপুরের আহার সম্পন্ন করে সন্ধ্যা নামার আগেই ফিরে আসুন হোমস্টেতে |
যাত্রাপথ - কঠিন
দূরত্ব - ১০ কিমি
সময় - ৮ ঘণ্টা
কানারখা ট্রেইল:
গাউলা নদীর ট্রেইলের তুলনায় কানারখা ট্রেইল পর্যন্ত ট্রেক করা অনেকটাই সহজসাধ্য| হোমস্টে থেকে কানারখা ট্রেইল ট্রেকে যেতে হলে সকালে বেড়িয়ে দুপুরের মধ্যে ফিরে আসা যায় | প্রায় ২০০০ ফিট উচ্চতায় পাহাড়ের পাদদেশে কানারখা গ্রামটি অবস্থিত | এগ্ররিয়ান সম্প্রদায় সম্পন্ন এই গ্রামটি বেশ জনবহুল বলতেই হবে | স্থানীয় ফসল উৎপন্ন করেই এঁরা জীবিকা নির্বাহ করেন |
কাঠিন্য - তুলনায় সহজসাধ্য
দূরত্ব - ৮ কিমি
সময় - ৬ ঘণ্টা
কী কী করবেন:
পর্যটকদের উদ্দেশ্যে ঝিল্লিঙ্গ টেরাসে প্রায়ই ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয় যা ক্লাউডশপ নামে পরিচিত | এই ক্লাউডশপ মূল লক্ষ্য হল মানুষকে শিল্প, যোগ, বা শিক্ষা মূলক ক্রিয়াকলাপের সাথে যুক্ত করা |
তাছাড়াও প্রত্যেকটি সুইটে বিভিন্ন ধরণের গেম যেমন মনোপলি, স্ক্র্যাব্বল প্রভৃতির ব্যবস্থা আছে | অন্ধকার রাতে, গা ছমছমে পরিবেশে কটেজের লিভিং-রুমের ফায়ার প্লেস বা বারান্দাতে বন ফায়ার করতে চাইলেও তার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়|
খরচ:
জুলাই মাসে রাত্রি যাপনের খরচ:
• উটিশ - ১৩,৫০০ টাকা
• বুরাংশ - ১৩,৫০০ টাকা
• সম্পূর্ণ চেস্টনাট হাউস - দুই রাত্রিযাপনের খরচ ১,২৪,০০০ টাকা
• পদম - ১০,০০০ টাকা
• রিঙ্গল - ১৩,৫০০ টাকা
• কাফল - ১০,০০০ টাকা
ঠিকানা:
মাটিয়াল গ্রাম , ভাটেলিয়া - ধানচুলি - ভীমতাল রোড ,দক্ষিণগোলা রেঞ্জ , নৈনিতাল ,উত্তরাখন্ড
কীভাবে যাবেন:
রেলপথে - মাটিয়াল গ্রাম যাওয়ার জন্য নিকটতম স্টেশনটি হলো কাঠগোদাম | স্টেশন থেকে স্থানীয় ট্যাক্সি ভাড়া করেঘন্টা খানেক দূরত্বে পৌঁছে যান গন্তব্যে |
বিমানপথে - ঝিল্লিঙ্গ টেরাসে পৌঁছনোর জন্য নিকটস্থ বিমানবন্দরটি হল পান্থনগর বিমানবন্দর| বিমানবন্দর থেকে ঘণ্টা দুয়েক দূরত্বের মধ্যেই পৌঁছে যান মাটিয়াল | আর মাটিয়াল গ্রাম থেকে ঘণ্টা খানেক ট্রেক করে পৌঁছে যান ঝিল্লিঙ্গ টেরাসে |