বিরিয়ানির ইতিহাস কিন্তু খুব একটা সহজ সরল না। জিভে জল আনা মশলা, ঝরঝরে ভাত আর মাংস দিয়ে তৈরি এই পদটি ভারতবর্ষে কীভাবে এসেছে তাই নিয়ে চালু আছে বহু মত, বহু গল্পকথা... অন্যান্য ইতিবৃত্ত।
১৩৯৮ সাল নাগাদ তুর্কি-মোঙ্গল আক্রমণকারী তৈমুর এবং তাঁর সেনাবাহিনির আগমনের সময় হয়তো ভারতবর্ষের মাটিতে প্রথম বিরিয়ানির দেখা পাওয়া যায়। বিরিয়ানি ছিল সৈন্যবাহিনীর সেনাদের দৈনিক আহারের অন্যতম প্রধান উপাদান। মাটির পাত্রে চাল, মশলা এবং হাতের কাছে যা মাংস পাওয়া যায় তা ভরে, সেটা মাটির তলায় গরম কুণ্ডের ভেতর রেখে চাপা দিয়ে দেওয়া হয়ে থাকত এবং আবার খাওয়ার সময় খুঁড়ে বের করে খাওয়া হত।
মুঘল শাসনকালেও বিরিয়ানির সুখ্যাতি ছিল দেশজোড়া। মুঘল সম্রাটরা তাঁদের বিত্ত এবং বৈভবপূর্ণ জীবনযাত্রার জন্যে এবং খাদ্যরসিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সুগন্ধী চালের এবং নরম মাংস দিয়ে তৈরি ভাল বিরিয়ানির কদর তাঁরা করতে জানতেন।
অন্য একটি মত অনুসারে, দ্বিতীয় শতকের তামিল সাহিত্য অনুযায়ী দক্ষিণ মালাবার উপকূলে পাওয়া যেত "উন সোরু" বা একরকম মশলাদার মাংস আর ভাতের মিশ্রণ।
আবার আরেকটি মতবাদ অনুসারে বিরিয়ানির আবিষ্কর্তা ছিলেন মুমতাজ মহল, শাজাহানের রূপসী বেগম। তিনি সৈন্যবাহিনির সৈন্যদের শারীরিক দুরবস্থা দেখে মুঘল রাঁধুনীদের বলে ছিলেন ভাত এবং মাংস একসঙ্গে খাওয়াতে, যাতে দুর্বল সৈন্যরা শরীরিক পুষ্টি পেতে পারে।
আজ অবধি জায়গা বিশেষে বিরিয়ানির স্বাদ বা প্রণালীর তারতম্য ঘটলেও, বিরিয়ানির প্রতি মানুষের ভালোবাসা একটুও কমেনি। কোনও এক অঞ্চলের বিরিয়ানিকে শ্রেষ্ঠ বললে সঙ্গে সঙ্গে দেখবেন কীভাবে বাকিরা রে রে করে তেড়ে আসে। আসলে বিরিয়ানি জড়িয়ে আছে মানুষের ভাবাবেগের সাথে, আসুন দেখে নেওয়া যাক ভারতবর্ষে কী কী বিভিন্ন রকম বিরিয়ানি পাওয়া যায়।
হায়দ্রাবাদ
হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি
হায়দ্রাবাদি নিজামদের রাজহেঁশেল থেকে উৎপন্ন এই বিখ্যাত বিরিয়ানি বেশ মশলাদার এবং মূলত দুরকম - কাচ্চি এবং পাক্কি। কাচ্চি বিরিয়ানিতে মশলা এবং দই দিয়ে মাংস সারারাত ম্যারিনেট করা হয় এবং তারপর একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রান্না করা হয়। অন্যদিকে পাক্কি বিরিয়ানিতে মাংস ম্যারিনেট করা হয় অনেক কম সময়ে এবং ভাতের থেকে আলাদা করে রান্না করা হয়। তারপর ভাত এবং মাংস স্তরে স্তরে সাজিয়ে দম দিয়ে রান্না করা হয়।
দম প্রণালীতে মাটির পাত্রের ভিতরে বিরিয়ানিটি রেখে পাত্রের উপর অংশটি ঢাকা দিয়ে ময়দা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। সুগন্ধী জাফরানের স্বাদ বিশিষ্ট ভাত এবং মশলাদার মাংসের এই বিরিয়ানির সঙ্গে সবথেকে খেতে ভাল লাগে ঝাল ঝাল সালান এবং রায়তা।
কলকাতা
কলকাতা বিরিয়ানি
জিভে জল আনা মনমাতানো কলকাতা বিরিয়ানির সুক্ষ্ম স্বাদের পিছনে কিন্তু আছে একটি বিয়োগান্ত গল্প। আওয়াধের শেষ নবাব খাদ্যরসিক ওয়াজিদ আলি শাহের নির্বাসনের পর তিনি তাঁর রাঁধুনিদের নিয়ে সদলবলে চলে আসেন কলকাতা। টাকাপয়সার যোগান কম, কিন্তু খাদ্যরসিক নবাবের তখনও খাবারে চাই সেরা স্বাদ। এমন সময় তাঁর রাঁধুনিরা বিরিয়ানির মাংসের টুকরোর বদলে দিতে শুরু করেন আলুর টুকরো। সেই থেকে কলকাতা বিরিয়ানিতে আলুর উপস্থিতি একান্ত কাম্য।
কলকাতা বিরিয়ানির স্বাদের জাদুও লুকিয়ে আছে এই আলুর মাঝে। বিরিয়ানির আলুর ওপরে মুচমুচে সোনালী আস্তরণ, আর প্রতি কামড়ে নরম গরম স্বাদ। সঙ্গে জাফরান আর গোলাপ জল দেওয়া ঝরঝরে বাসমতি চালের ভাত আর চিকেন বা মটন। আর সবার মধ্যে লুকিয়ে আস্ত ডিমসেদ্ধ।
লখনৌ
লখনৌ বিরিয়ানি
আওয়াধি ঐতিহ্য থেকে উৎপন্ন কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম মশলার ব্যবহারের জন্যে লখনৌ বিরিয়ানি বিখ্যাত। মাংসের স্টক তৈরি করে সেই জুসের মধ্যে বিভিন্ন মশলা দিয়ে রেঁধে তা বিরিয়ানির চালের সঙ্গে মেশানো হয়, ফলে মাংস হয়ে ওঠে নরম, আর বিরিয়ানিও শুকনো হয়ে যায় না। মাংস টুকরোগুলোও দারুচিনি এবং স্টার আনিসের মতন মশলা দিয়ে কিছুটা রান্না করে, তা ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে দম পোক্ত উপায়ে বাকিটা রান্না করা হয়।
তামিলনাড়ু
ডিনদিগুল বিরিয়ানি
ডিনদিগুল থালাপাকাটটি বিরিয়ানির ভক্ত সংখ্যা কিন্তু থালাইভার থেকে এক বর্ণও কম নয়, এবং তার পেছনে কারণও যথেষ্ট।
খাঁটি শুদ্ধ ডিনদিগুল বিরিয়ানি তৈরি করতে লাগে এমন কাননিভাদি ছাগল, যারা শুধু ঘাস খেয়ে বড় হয়েছে। এই বিরিয়ানির সাথে অন্য বিরিয়ানির পার্থক্য বলতে এখানে মাংসের টুকরোগুলো ছোট ছোট চৌকো টুকরো করে দেওয়া হয়। জিরা সাম্বা ভাতের সঙ্গে ভাল করে দই এবং লেবুর রস মেশানো হয়, যাতে একটা বেশ চটকদার স্বাদ পাওয়া যায়, আর ঝালের জন্যে ব্যবহার করা হয় লঙ্কাপাতা। তবে সৌভাগ্যক্রমে এই ঝাল মোকাবিলা করার জন্যে সঙ্গে থাকে পেয়াঁজের রায়তা আর বেগুনের তরকারি।
কেরালা
থালাসেরি বিরিয়ানি
ঝাল এবং মিষ্টির সংমিশ্রিত স্বাদের এই বিরিয়ানি পাওয়া যায় মূলত কেরালার মালাবার উপকূলে। তবে এই অঞ্চলে বিরিয়ানির বেশ কয়েক রকম প্রকারভেদ দেখতে পাওয়া যায়।
থালাসেরি বিরিয়ানি কিন্তু ছেলেখেলা নয়। বাসমতি চালের বদলে স্থানীয় খাইমা বা জিরাকাসালা চালের ব্যবহার করা হয়। এরপরে একে একে আসে সুস্বাদু চিকেন উইংস, কড়া করে ভাজা পেয়াঁজ, কাজুবাদাম ভাজা, কিশমিশ, মালাবার উপকূলের মশলা আর মৌরি। পরিবেশন করার সময় ভাতের সাথে মাংস এবং মাংসের ঝোল মিশিয়ে দেওয়া হয়।
গুজরাট
মেমোনি বিরিয়ানি
যারা খাবারে বেশ অনেকটা ঝাল খেতে পছন্দ করেন, তাদের জন্যে মেমোনি বিরিয়ানি একদম আদর্শ। গুজরাটের সিন্ধু অঞ্চলের মেমোন জনগোষ্ঠীর রন্ধন প্রণালী অনুসারে এই বিরিয়ানি রান্না করা হয়। সুস্বাদু ভেঁড়ার মাংসের টুকরো, পেঁয়াজ ভাজা, আলু এবং দই দেওয়া হয় এই বিরিয়ানিতে। কোনও রকম কৃত্রিম রং ব্যবহার করা হয় না, সবজির টুকরো, মাংস এবং ভাতের রং থেকেই আসে এই বিরিয়ানির প্রকৃত রূপ।
তামিলনাড়ু
আম্বুর বিরিয়ানি
তামিলনাড়ু গেলে কিন্তু একথালা আম্বুর বিরিয়ানি খাওয়া একান্ত জরুরি। এরকম স্বাদ অন্য কোনও বিরিয়ানিতে পাবেন না। আসলে আম্বুর বিরিয়ানির মাংস টুকরোগুলোকে অনেকক্ষণ দই মাখিয়ে রাখা হয় এবং তারপর ধনে এবং পুদিনার ব্যবহার করা হয়। এরপরে মাংস, বিভিন্ন রকম মশলা দিয়ে আগে থেকে কিছুটা রান্না করা সিরগা সাম্বা চালের সঙ্গে একসঙ্গে রান্না করা হয়। আর যেহেতু এই বিরিয়ানিতে ভাতের তুলনায় মাংসের পরিমাণ বেশ বেশি, তাই মাংসপ্রেমীদের কাছে এই বিরিয়ানি অত্যন্ত জনপ্রিয়। ইন্নাই কথরিকাই বা বেগুনের তরকারির সঙ্গেও এই বিরিয়ানি খেয়ে দেখুন এবং সম্পূর্ণ ভিন্নধারার স্বাদ খুঁজে পান
ম্যাঙ্গালোর
বিয়ারি বিরিয়ানি
কর্ণাটকের দক্ষিণ কন্নড় উপকূলের বিয়ারি মুসলিম সম্প্রদায়ের রন্ধনপ্রণালী অনুযায়ী এই ঝালঝাল বিরিয়ানির সুখ্যাতি। বিরিয়ানির নামকরণের ক্ষেত্রে উঠে এসেছে ব্যারা শব্দটি যার মানে ব্যবসা বা বাণিজ্য। এখানকার নাবিক এবং বণিকদের তৈরি এই বিরিয়ানিতে পাবেন প্রচুর পরিমানে লঙ্কা এবং নারকোল। আর এই বিরিয়ানির চাল সারারাত ঘি এবং মশলায় ভিজিয়ে রাখা হয়, ফলে ভাতে পাওয়া যায় একটা বেশ অন্যরকম জোরদার গন্ধ। বহুমুখী এই বিরিয়ানিতে চিকেন বা মটন ছাড়া সি-ফুডের ব্যবহারও করা হয়।
কাশ্মীর
তেহারি বিরিয়ানি
যতখুশি খেতে পারেন এই বিরিয়ানি, কারণ বাকি বিরিয়ানিগুলোর মতো কিন্তু তেহারিতে মাংস থাকে না। তার বদলে থাকে বিভিন্নরকম সবজি, প্রচুর পরিমাণে। আর সুগন্ধী মশলার সঙ্গে দেওয়া হয় মূলত আলু এবং গাজর।
কথিত আছে যে মাইসোরে যখন টিপু সুলতান নিরামিষ ভোজনপ্রিয় হিন্দুদের হিসাবরক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন, তাঁদের কারণেই এই তেহারির উৎপত্তি। বিরিয়ানির নিরামিষ বিকল্প হিসেবে তৈরি হয়েছিল তেহারি এবং আজ বহু নিরামিষাশী মানুষের অন্যতম প্রিয় খাবার তেহারি। বিশেষত কাশ্মীরে এটি খুবই জনপ্রিয়।
সিন্ধি বিরিয়ানি
পাকিস্তানের সিন্ধ অঞ্চল থেকে এই বিশিষ্ট স্বাদের বিরিয়ানির পথ চলা শুরু। খেতে আরম্ভ করলে আপনি থামতে পারবেন না ঠিক, তবে প্রচুর পরিমানে চেরা চেরা কাঁচালঙ্কা ব্যবহারের জন্য বিখ্যাত এই বিরিয়ানি খেয়ে ঝাল লাগার সম্ভাবনা প্রচুর। বিভিন্ন রকম মশলা, ভাজা ড্রাই ফ্রুটস, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, পেয়াঁজ এবং বাদামের ব্যবহারও করা হয় এই বিরিয়ানিতে। প্লাম এবং আলু ব্যবহার করার ফলে এই বিরিয়ানির পরিচয় হয়ে ওঠে এক বিশেষ গন্ধ। একটু টক স্বাদ আনার জন্যে রান্না করার সময় টক দইয়ের ব্যবহারও করা হয়ে থাকে এই রেসিপিতে।
মুম্বই
বম্বে বিরিয়ানি
মুম্বইকারদের জীবনের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন তাঁদের বিরিয়ানির মধ্যেও পাওয়া যায়। টক ঝাল মিষ্টি, বম্বে বিরিয়ানির প্রতি চামচে পাবেন সমস্ত রকম স্বাদের মেলবন্ধন। চিকেন আর মটন ছাড়াও বম্বে বিরিয়ানির ভাতের পরতে পরতে পাবেন ঝাল ঝাল করে ভাজা আলুর টুকরো। শুকনো প্লাম এবং কেওড়ার জল ব্যবহার করার ফলে পাবেন একটা মিষ্টি স্বাদও। শহরটির মতোই, এই বিরিয়ানিটিও আপনার মন জয় করে নিতে বাধ্য।
কর্ণাটক
ভাটকালি বিরিয়ানি
আপনি যদি কখনো কর্ণাটকের উপকূলের ছোট্ট শহর ভাটকালে কোনো বিয়েবাড়ির নিমন্ত্রণ খেয়ে থাকেন, তাহেল গরম গরম ভাটকালি বিরিয়ানি নিশ্চই চেখে দেখেছেন। ইতিহাস বলে, এই বিরিয়ানির আগমন পারস্যের বণিক নাবিকদের হাত ধরে। পেয়াঁজ এবং কাঁচা লঙ্কার মশলায় মাংসের টুকরোগুলো রান্না করে তা সুগন্ধী চালের সঙ্গে মেশানো হয়। স্বাদ বাড়াতে ব্যবহার করা হয় আরও লঙ্কা, মশলা এবং কারি পাতা। রান্নার শেষে আমরা পাই অতুলনীয় এক বিরিয়ানি যাতে থাকে নরম মাংস, সাদা ভাতে কমলা রঙের বাহার আর পেয়াঁজ রশুনের মনমাতানো গন্ধ।
চলুন, তাহলে আর অপেক্ষা কি? পাত পেড়ে বসা যাক বিরিয়ানি আহারে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে লুকিয়ে থাকা ভিন্ন স্বাদের সবকটি বিরিয়ানি খেয়ে দেখতে হবে তো!