২০২০ সাল আমাদের সবার জন্যেই খুব কঠিন একটা সময় হয়ে উঠেছে। আমরা যারা ঘুরতে ভালোবাসি, বদ্ধ ঘরে আর কোয়ারান্টিনে আটকে থেকে আমাদের মধ্যে অনেকেই হাঁপিয়ে উঠেছি। একঘেয়ে এই বন্দি দশা কাটিয়ে উঠতে চলুন ফিরে যাই রুপোলি পর্দার স্মৃতিতে। ফিরে দেখি কীভাবে সিনেমার পর্দায় নায়ক নায়িকার রোমান্সের পটভূমি হয়ে উঠেছিল দেশ-বিদেশের নয়নাভিরাম বিভিন্ন ডেস্টিনেশন। কোথায় বা নায়ক ও তার বন্ধুরা রোডট্রিপে গাড়ি ছুটিয়েছিল দূর-দূরান্তের প্রতি।
হয়তো বলিউডের বিভিন্ন ভ্রমণের দৃশ্যেই আমরা খুঁজে পাব আমাদের আগামী গন্তব্যস্থল। তাই দেরি না করে আরেকবার দেখে নেওয়া যাক আমাদের পছন্দের কোন সিনেমায় দেখা পাওয়া গেছে দেশি বিদেশি কোন ডেস্টিনেশনের কথা!
জিন্দেগি না মিলেগি দুবারা (২০১১)
তিন বন্ধু। ব্যাচেলর ট্রিপ। স্পেন। আর শুধু দু-একটা জায়গা নয়, বার্সেলোনা - কোস্তা ব্রাভা - সেভিল - বুনল - পাম্পলনা হয়ে লা-তোমাটিনা উৎসবের উদ্দাম উচ্ছল আনন্দের অবকাশ। সিনেমার প্রতিটি দৃশ্যে যেন ফুটে উঠেছে ভ্রমণপিপাসুদের বিশ্ব ভ্রমণের করুণ আর্জি এবং শুধু রোড ট্রিপ নয়, আছে ডিপ সি ডাইভিং, স্কাই ডাইভিং, বুল রানের মতন অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের হাতছানি। জিন্দেগি না মিলেগি দোবারার গল্পে বলা হয়েছে জীবনের প্রতি আমাদের প্রত্যাশার আড়ালে নিজেদের প্রকৃত সত্তাকে খুঁজে পাওয়ার চাহিদার কথা। আর আমরা সবাই জানি, অজানা অচেনা মাঝে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জন্য ভ্রমণের মতন ভাল কিছু আর হয় না।
দিল চাহতা হ্যায় (২০০১)
হয়তো বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে গোয়া যাওয়ার সমস্ত প্ল্যানের পিছনে লুকিয়ে আছে এই অসাধারণ ফিল্মটির অনুপ্রেরণা। রোড ট্রিপের মাধ্যমে নর্থ আর সাউথ গোয়ার বিভিন্ন লুকানো দিক খুঁজে বের করা, আর সেইসব জায়গায় প্রকৃতির অলস আমেজি রূপ উপভোগ করতে শিখিয়েছে দিল চাহতা হ্যায়। কখনও গোয়ার বিভিন্ন বিচ, অওগাদা, আঞ্জুনা বা ছাপোড়া ফোর্টের মতন ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিশিষ্ট স্থান, প্রকৃত পর্যটকদের জন্য গোয়ায় আছে সব কিছু। সত্যি করে বলুন, দিল চাহতা হ্যায় দেখতে দেখতে আপনারও কি ইচ্ছে হয়নি বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে গোয়ার দিকে লং ড্রাইভে বেরিয়ে পরতে?
বরফি (২০১২)
বরফি সিনেমায় রণবীর কাপুর, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া আর ইলিয়েনা দি'ক্রুজের সাবলীল অভিনয় আজীবন মনে রাখার মতো। কিন্তু তার থেকেও বেশি ভ্রমণপ্রেমীদের মনে জায়গা করে নিয়েছে সিনেমার প্রতি দৃশ্যে ফুটে ওঠা দার্জিলিং শহরের প্রতিটি অলি গলি। বাঙালি মাত্রেই পাহাড়ের রানির প্রতি গড়ে ওঠা এই রোমান্স আমাদের হৃদয়ের মধ্যে বেড়ে ওঠে ছোটবেলা থেকে। আর এখানে কাঞ্চনজঙ্ঘার পটভূমিতে আমাদের সবার প্রিয় এই শৈলশহরের রূপ বার বার আমাদের মুগ্ধ করেছে, ডাক দিয়েছে আরেকবার ঘুরে আসার জন্যে। যাবেন নাকি, প্যান্ডেমিকের পরে কেভেন্টার্সের ছাদে বসে দার্জিলিং চা খেতে খেতে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন করতে?
কুইন (২০১৩)
সোলো ট্র্যাভেল যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং জীবনে ফলপ্রসূ হতে পারে, তা বোঝা যায় কুইন সিনেমাটা দেখলে। ভারতবর্ষের ছোট্ট শহরের এক আপাত ঘরোয়া মেয়ে কীভাবে প্যারিস, আমস্টারডামে সোলো ট্রাভেলের মধ্যে দিয়ে নিজের স্বাধীনতা এবং নিজের আসল পরিচয় খুঁজে পায়, তা আমরা দেখতে পাই এই সিনেমায়। আসলে আমাদের সবার মনের মধ্যেই রয়েছে এক কুইন, যে ডানা মেলে উড়তে চায়, নিজেকে স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে চায়। শুধু নিজেদের ভয়টুকু অতিক্রম করে বিশ্বের দরবারে নিজেদের খুঁজে পাওয়ার অপেক্ষা।
ইয়ে জাওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি (২০১৩)
এই সিনেমায় বানি আর নয়নার প্রেমকাহিনীর ফাঁকে ফাঁকে আমরা কিন্তু দেখতে পেয়েছি ভারতবর্ষের বেশ কিছু আকর্ষণীয় ট্যুরিস্ট স্পটের ঝলক। গল্পেই আছে কীভাবে বানি পৃথিবীটাকে আরও ভাল করে চিনতে চায়, অজানার মধ্যে হারিয়ে যেতে চায়। গল্পের শুরুতে আমরা দেখতে পাই মানালি আর কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। গল্পের দ্বিতীয়ার্ধে রাজস্থানের উদয়পুরের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আমরা দেখতে পাই বেশ কিছু পুরনো দুর্গ এবং প্রাসাদ। গল্প শুধু ভারতেই থেমে থাকেনি, মাঝে আছে ইউরোপ আর প্যারিসের দৃশ্যও। সত্যি যেন একটা রাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ট্রিপের মতোই সাজানো এই সিনেমার গল্প।
দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে (১৯৯৫)
ভারতীয় চলচ্চিত্রপ্রেমিক এবং ভারতীয় ভ্রমণপ্রেমীদের মেলবন্ধন যদি ঘটে থাকে, তাহলে অবশ্যই সেটা যশ রাজ ফিল্মসের এই অমর কীর্তির মাধ্যমে। লন্ডনের কিংস ক্রস স্টেশনে রাজ আর সিমরনের প্রথম দেখা, তারপর একে একে আমরা দেখতে পেয়েছি সুইজারল্যান্ডের জোয়েসিমেন, জিস্টাড এবং জুংফ্রাউ। সেখান থেকে আমরা ঘুরে এসেছি সেন্ট মরিশাস চার্চ, সেন্ট গ্রান্ট চার্চ, সানেন ব্রিজ। কিন্তু গল্প প্রথম ভাগে আমাদের ইউরোপের সওয়ারী করালেও, দ্বিতীয় ভাগে ফিরে এসেছে ভারতবর্ষের মাটিতে। পাঞ্জাবের দিগন্তজোড়া সর্ষেক্ষেতের মধ্যে রাজ সিমরনের একে অপরকে ফিরে পাওয়ার দৃশ্য এখনো আইকনিক। এখনও বহু বিদেশি ট্যুর অপারেটরদের কাছে ভারতীয় ট্যুরিস্টরা অনুরোধ করেন ডি.ডি.এল.জের স্পট গুলি ঘুরিয়ে দেখানোর।
পিকু (২০১৫)
দেশে বিদেশের বিভিন্ন নয়নাভিরাম জায়গার দৃশ্য বহু সিনেমাতে থাকলেও, মাঝে মাঝে কিন্তু পিকুর একটা মিষ্টি ফ্যামিলি রোড ট্রিপেরও খুব দরকার। সিনেমাতে যেভাবে পিকু তার বাবা ভাস্করের সঙ্গে রোড ট্রিপের মাধ্যমে দিল্লি থেকে কলকাতা ফেরে, সেরকম কিন্তু আমরাও পারি আমাদের গোটা পরিবারের সাথে মাঝে মধ্যেই বেড়িয়ে পরতে, এক শহর থেকে অন্য শহরে পাড়ি দিতে। পিকু সিনেমায় গ্ল্যামারাস লোকেশন বা অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ না থাকলেও, আছে মনের মধ্যে আমাদের পরিবারের প্রতি ভালোবাসাটা বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা। আর তা যদি হয় একটা সুন্দর রোড ট্রিপের মাধ্যমে, তাহলে ওর থেকে ভাল আর কী হতে পারে।
জব উই মেট (২০০৭)
ইমতিয়াজ আলির সিনেমাগুলোর সঙ্গে ভ্রমণ আর ঘুরতে যাওয়া প্রায় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। জব উই মেট থেকেই ভ্রমণের প্রতি সেই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। সিনেমাটার কেন্দ্রে যেমন আছে ছোট্ট মিষ্টি একটি ভালবাসার গল্প, তেমনি জব উই মেট আমাদের ভালোবাসতে শিখিয়েছে ভারতবর্ষের ছোট্ট ছোট্ট শহরগুলিকে। রাতলাম, কোটা, ভাটিনদা হয়ে একেবারে কুলু, মানালি, শিমলা পর্যন্ত আমরা ছুটে গেছি গীত আর আদিত্যর সঙ্গে সঙ্গে। মানালি, শিমলা, রোটাং পাসের জনপ্রিয়তার পিছনে এই সিনেমার ভূমিকা কিন্তু অনস্বীকার্য। আর হ্যাঁ, রাতের ট্রেনে ট্রাভেল করা যে কত মজাদার আর ঘটনাবহুল হতে পারে, তা আমাদের শিখিয়েছে কিন্তু জব উই মেট!
হাইওয়ে (২০১৪)
ভ্রমণ আমাদের বাঁচতে শেখায়, শেখায় স্বাধীনতার প্রকৃত মনে। চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে বাইরে অজানা অচেনার খোঁজে বেরোনোর মধ্যেই আছে বিশ্বসত্তা কে নিজের মধ্যে আপন করে নেওয়ার উপায়। সিনেমায় আলিয়ার চরিত্র একে একে দিল্লি, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, হিমাচল প্রদেশ হয়ে পৌঁছায় কাশ্মীর। পথে প্রকৃতির শোভা, বরফ ঢাকা পাহাড় আর পাহাড়ি নদীর কলতানের মধ্যে দিয়ে দর্শকও যেন ঘুরে আসি সমগ্র উত্তর ভারতের অপরূপ সুন্দর এই জায়গাগুলো। উন্মুক্ত হাইওয়ে দিয়ে আনমনে গাড়ি ছোটানোর স্বাদ পাবার জন্যে আরেকবার দেখে নিন হাইওয়ে, আর ঠিক করে ফেলুন, প্যান্ডেমিকের পরে এর মধ্যে কোথায় কোথায় যাবেন।
থ্রি ইডিয়েটস (২০০৯)
লেহ লাদাখের জনপ্রিয়তার পেছনে একটা বড় হাত রয়েছে থ্রি ইডিয়েটসের ক্লাইম্যাক্স সিনের। হিমালয়ের অনির্বচনীয় সুন্দর প্যাংগং লেকের স্বচ্ছ নীল জলের ধারে সিনেমার এই অংশটি এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, লাদাখের এই অতি অল্প পরিচিত জায়গা টি উঠে আসে ভ্রমণ মানচিত্রের একদম ওপরে। আর ভুললে চলবে না, পুরো সিনেমা জুড়েই রয়েছে বন্ধুর খোঁজে উত্তর ভারতের অসাধারণ সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলা রোড ট্রিপ। ভ্রমণ আর রুপোলি পর্দা কীভাবে একে অপরকে অনুপ্রাণিত করে তার আদর্শ উদাহরণ আমাদের সবার প্রিয় থ্রি ইডিয়েটস।