ভারতবর্ষের এই উপত্যকাগুলোর নাম দেখলেই যেন জায়গাগুলোতে যাওয়ার জন্য মন আনচান করে ওঠে। আর গোটা ভারতে এতগুলো এরকম উপত্যকা আছে, যে সবকটার নাম একসঙ্গে লেখা প্রায় পাগলামির সমান। তাই রইল শুধুমাত্র উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে রহস্যাবৃত এবং এখনো জনমানসের আড়ালে রয়ে যাওয়া কিছু উপত্যকার খোঁজ।
দেখে নি ভারতবর্ষের কোন অসাধারণ উপত্যকাগুলিতে আপনার যাওয়া অত্যাবশ্যক
১. মানা ভ্যালি
চামোলী জেলা, উত্তরখণ্ড
হিন্দু পুরাণ অনুসারে এই উপত্যকার মানা গ্রামের গুরুত্ব অপরিসীম। মহর্ষি ব্যাসদেব এখানেই ভগবান গণেশ কে মহাভারতের সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করেন। বিখ্যাত বদ্রীনাথ মন্দিরও এখান থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে। গঙ্গা নদীর সবচেয়ে বড় উপনদী অলকানন্দার উৎপত্তিও এই মানা ভ্যালি থেকে।
কীভাবে পৌঁছাবেন : দেরাদুনের জলি গ্রান্ট এয়ারপোর্ট আর ঋষিকেশ রেলস্টেশন এখানকার নিকটতম। এই স্টেশনগুলো থেকে ভোরের বাস বা শেয়ার ট্যাক্সি বা নিজে ড্রাইভ করে জসীমঠ হয়ে বদ্রীনাথে আসতে পারবেন।
কী কী করবেন : ভারত এবং তিব্বত সীমান্তে ১৮১৯২ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত মানা লা দেশের সবথেকে উঁচু এবং চলাচলযোগ্য পাস। মানা গ্রাম ভারতবর্ষের শেষ গ্রাম নামেও বিখ্যাত। মানা লা থেকেই চৌখাম্বা শৃঙ্গের চড়াই শুরু হয়। মানা তে অবস্থিত দুটো ছোট গুহা - ব্যাস গুহা আর গণেশ গুহা দেখে আসতে পারেন। আর কাছাকাছি দ্রষ্টব্য স্থান বলতে আছে বসুন্ধরা ফলস, সাতোপান্থ লেক এবং ভীম পুল।
২. পিন্দার ভ্যালি
বাগেশ্বর জেলা, উত্তরাখণ্ড
এটি ভারতবর্ষের স্বল্পপরিচিত উপত্যকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। পিন্দারি নদীর তীর বরাবর বেড়ে ওঠা এই উপত্যকা কুমায়ন অঞ্চলের অত্যন্ত সুন্দর বাগেশ্বর জেলায় অবস্থিত। দেভাল, থারালি, কুলসারি, হারমানি, মিং, নারায়ন বাগার এবং নলগাঁও হ্যামলেটের মধ্যে দিয়ে নদীটি এগিয়ে চলে। কন্যাপ্রয়াগের কাছে পিন্দারি উপনদী গিয়ে মেশে অলকানন্দায়।
কীভাবে পৌঁছাবেন : পন্থনাগার এয়ারপোর্ট (বাগেশ্বর থেকে ১৩৬ কিলোমিটার দূরে) এবং কাঠগোদাম রেলস্টেশন নিকটতম। সেখানে পৌঁছে তারপর নিজের গাড়ি, শেয়ার ট্যাক্সি বা ভোরবেলার বাসে করে আলমোড়া হয়ে বাগেশ্বর পৌঁছতে পারেন।
কী কী করবেন : বাগেশ্বর যাওয়ার পথে দেখুন পাতাল ভুবনেশ্বরের চুনাপাথরের গুহা মন্দির। পিন্দার উপত্যকায় বহু ছোট ছোট গ্রাম পাবেন, যেমন ধুর, সেখানে হাইক করে যেতে পারেন। আরেক কদম এগোতে চাইলে যেতে পারেন পিন্দারি নদীর উৎসস্থল পিন্দারি হিমবাহের কাছে।
৩. দার্মা ভ্যালি
পিথোড়গড় জেলা, উত্তরাখণ্ড
দার্মা গঙ্গার তীরে এই উপত্যকা পূর্বে কুঠ ইয়াংতি উপত্যকা এবং পশ্চিমে লাসসার ইয়াংতি উপত্যকার মধ্যে অবস্থিত। পিথোড়গড়ের এই সুউচ্চ হিমালয় উপত্যকা বিখ্যাত পঞ্চচুল্লি বেসক্যাম্প যাওয়ার পথে একমাত্র পায়ে হেঁটেই পৌঁছনো সম্ভব। ইন্দো-তিব্বতীয় সীমানার খুব কাছে হওয়ায় সিন-লা যাওয়ার পথে কৈলাশ পর্বতের দর্শনও পাবেন। দার্মা ভারতবর্ষের অন্যতম সুন্দর পাহাড়ি ভ্যালি।
কীভাবে পৌঁছাবেন : তনকপুর রেল স্টেশন এবং পিথোড়গড়ের নৈনি সাইনি এয়ারপোর্ট এখানকার নিকটতম যোগাযোগকেন্দ্র। সেখানে পৌঁছে তারপর নিজের গাড়ি, শেয়ার ট্যাক্সি বা ভোরবেলার বাসে করে পৌঁছে যান ধারচুলায়ে।
কী কী করবেন : আপনি যদি পাহাড়প্রেমী হন তাহলে জীবনে অন্তত একবার দার্মা উপত্যকায় ট্রেক করা আপনার একান্ত প্রয়োজন। পঞ্চচুল্লি বেসক্যাম্পের পথে যাওয়ার সময় এখানকার ভূমিরূপে হিমবাহ থেকে কনিফেরাস জঙ্গল পর্যন্ত দেখা যায়। মনে করা হয় যে স্বর্গারোহণের পূর্বে পাণ্ডবরা পঞ্চচুল্লি পাহাড়ের কোনো শৃঙ্গে তাদের শেষ আহারের জন্যে রান্না করেন। ট্রেক করতে চাইলে আপনি ধৌলিগঙ্গা থেকে দুগতু হয়ে তিডাং এবং বিডাং গ্রাম ছুঁয়ে সিন-লা হয়ে ব্যান্স ভ্যালি যেতে পারেন।
৪. পিন ভ্যালি
লাহৌল এবং স্পিতি জেলা, হিমাচল প্রদেশ
কাজার দক্ষিণপূর্ব দিকে এগিয়ে গেলে দেখবেন আঁকাবাঁকা স্পিতি নদীতে এসে মিশছে পিন নদী। পিন উপত্যকার ভূমিরূপ খুবই আকর্ষণীয়, পৃথিবীর কিছু বিশেষ প্রাণী এবং উদ্ভিদ শুধুমাত্র এখানেই খুঁজে পাওয়া যায়। উপত্যকার বেশিরভাগটাই কোল্ড ডেজার্ট বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের অন্তর্গত এবং তিব্বত সীমানার কাছের ধানকার গুম্ফার দক্ষিণ থেকে স্পিতি ভ্যালির শেষ পর্যন্ত এই উপত্যকার ব্যাপ্তি। ২০০০০ ফুট উচ্চতায় কা ডোগরীর কিন্নর গ্রাম এই এলাকার উচ্চতম স্থান।
কীভাবে পৌঁছাবেন : পিন ভ্যালি থেকে ২৫২ কিলোমিটার দূরের ভুনতার এয়ারপোর্ট এবং যোগীন্দরনগর রেলস্টেশন এখানকার নিকটতম যোগাযোগকেন্দ্র। মানালি বা শিমলা থেকে কাজা পর্যন্ত লোকাল বাস ও পাবেন, তবে সেগুলি খুব সময় মেনে চলে। সেখানে পৌঁছানোর পরে ভোরবেলার বাস, শেয়ার ট্যাক্সি বা নিজের গাড়ি করে চলে আসুন পিন ভ্যালি অবধি। রোহতাং পাস হয়ে মানালি বা রেকং পিও হয়ে শিমলা, যে কোনও একটি রাস্তা দিয়ে আসতে পারেন।
কী কী করবেন : ৬৮০ বছর পুরনো উগিয়েন সাংনাক চলিং গোমপা অবশ্যই যাবেন, সেখানে ঘুরে দেখবেন বিশাল নতুন গুম্ফাগৃহটি। শ্বেত সিংহ, উৎসবে পরিধানের মুখোশ এবং কালো হয়ে যাওয়া মুরাল দিয়ে সাজানো মধ্যযুগীয় মন্দিরগুলোও দেখতে পারেন। সাংনাম গ্রাম থেকে মুধ যাওয়ার একদিনের ট্রেক পথটিও খুব সুন্দর। সেখান থেকে পিন-পার্বতী পাস, ভাবা পাস বা কিন্নরের কাফনুর সময়সাপেক্ষ ট্রেকগুলোও করার সুযোগ পাবেন।
৫. তীর্থান ভ্যালি
কুলু জেলা, হিমাচল প্রদেশ
ভারতবর্ষের অন্যতম জনপ্রিয় এই উপত্যকা হিমালয়ের তীর্থান নদীর তীরে অবস্থিত। সবুজে মোড়া এই লুকনো পাহাড়ি শহরটি গ্রেট হিমালয়ান ন্যাশনাল পার্কের (জি.এইচ.এন.পি) থেকে বেশি দূর নয়। পার্ক থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরের এই উপত্যকায় পাবেন এমন অনেক উদ্ভিদ বা প্রাণী যা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। শান্তিতে হাইক করার মতন বেশ কিছু সুন্দর সুন্দর হ্যামলেটও আছে পাশাপাশি।
কীভাবে পৌঁছাবেন : তীর্থান থেকে ৮০কিলোমিটার দূরের ভুনতার এয়ারপোর্ট এবং কিরাটপুর রেলস্টেশন নিকটবর্তী যোগাযোগকেন্দ্র। কুলু বা মানালি যাওয়ার যে কোনো বাস ধরে নেমে পড়ুন আউতে। সেখান থেকে সকালের বাস বা শেয়ার ট্যাক্সি করে যেতে হবে শোঝা বা জিভি।
কী কী করবেন : তীর্থানের দুই প্রধান শহর শোঝা বা জিভিতে আছে ক্যাম্প করার জায়গা। ক্যাম্প অর্গানাইজারদের কাছেই পাবেন জিপ-লাইনিং বা দড়ি বেয়ে রিভার ক্রসিংয়ের সরঞ্জাম। গ্রেট হিমালয়ান ন্যাশনাল পার্কের ভেতরে হাইক করার সুযোগ কিন্তু হারাবেন না। ন্যাশনাল পার্কের ভেতরে জালরি পাস, সেরলস্কর লেক, নেউলি, গুসাইনি এবং ভাগি কাশহরী যাওয়ার পথও পাবেন।
৬. কাঙরা ভ্যালি
কাঙরা জেলা, হিমাচল প্রদেশ
দেবদারু গাছের ঘন জঙ্গলে হারিয়ে গিয়ে মনপ্রাণ চাঙ্গা করতে চাইলে চলে আসুন কাঙরা ভ্যালিতে। হিমাচলের এই পাহাড় ঘেরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে প্রচুর তিব্বতী রিফিউজি নিজেদের আশ্রয় খুঁজে পেয়েছেন। দিল্লি থেকে শুরু করে যদি কাঙরা ভ্যালি পুরোটা ঘুরে দেখতে চান, তাহলে কমপক্ষে ৭দিন হাতে রাখা উচিত।
কীভাবে পৌঁছাবেন : ধর্মশালা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরের গগ্গাল এয়ারপোর্ট বা পাঠানকোট রেলস্টেশন বা দিল্লি থেকে সরাসরি বাস ধরে চলে আসুন ধর্মশালা বা মান্ডি। সেখান থেকে সকালবেলার বাস বা শেয়ার ট্যাক্সি করে চলে আসতে পারেন উপত্যকার আরও গভীরে।
কী কী করবেন : মান্ডি থেকে বাসে বা ট্যাক্সি করে বাগগি গ্রামে এসে সেখান থেকে ট্রেক করে যেতে পারেন সুন্দর প্রশার লেকে। লেকের ধারে ছোট গেস্টহাউসে রাত্রিবাসও করতে পারেন। বিরের চৌকলিং গুম্ফায় অবশ্যই যাবেন। বির তিব্বতি কলোনিতে অবস্থিত এই গুম্ফায় পায়ে হেঁটেই যাওয়া যায়। ভারতের প্রধান প্যারাগ্লাইডিং কেন্দ্র বিলিঙে আপনিও করতে পারেন প্যারাগ্লাইডিং। সঙ্গে যেতে পারেন হিমালয়ের বৃহত্তম দুর্গ, কাতচ রাজপরিবারের আমলে তৈরি বিখ্যাত কাঙরা দূর্গে।
৭. ওয়ারওয়ান ভ্যালি
কিস্তোয়ার জেলা, কাশ্মীর
উত্তর ভারতের শ্রেষ্ট লুকানো সম্পদ হল ওয়ারওয়ান। একদিকে কাশ্মীর উপত্যকার ঘন সবুজ বনজঙ্গল, আরেদিকে লাদাখের শীতল মরুভূমি, তার মাঝে ওয়ারওয়ান যেন এক টুকরো স্বর্গ। গ্রীষ্মের কিছু মাস বাদে এখানে যাওয়া যায় না, বছরে ৭ মাস জায়গাটি বন্ধ থাকে।
কীভাবে পৌঁছাবেন : প্রথমে আসুন শ্রীনগর এয়ারপোর্ট বা জম্মু রেলস্টেশন। অনন্তনাগের কোকেরাং থেকে ওয়ারওয়ান ৩ ঘণ্টার পথ। সেখান থেকে ভোরবেলার বাস বা শেয়ার ট্যাক্সি করে যেতে পারেন উপত্যকার ভিতরে।
কী কী করবেন : ওয়ারওয়ান ভ্যালিতে ভ্রমণ করার সবথেকে ভাল উপায় হল পায়ে হেঁটে বা ট্রেক করে। দেখতে পাবেন নানারূপ ভূমিরূপ, কোথাও বিশাল হিমবাহ, কোথাও গ্রাবরেখা আবার কোথাও বা মাইলের পর মাইল জুড়ে ঢেউ খেলানো তৃণভূমি।
৮. লিদ্দার ভ্যালি
অনন্তনাগ জেলা, কাশ্মীর
কলহ-ই হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে লিদ্দার নদী উপনদী হিসাবে মেশে ঝিলম নদীর সাথে, আর এই ঝিলমের জলেই পুষ্ট হয়ে কাশ্মীর উপত্যকা। অনন্তনাগ থেকে লিদ্দার ভ্যালি প্রান্তমুখ কেবল ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ওয়ারওয়ানের মতই লিদ্দার ভ্যালির দক্ষিণে সবুজ পীরপঞ্জাল পর্বতমালা আর উত্তরে সিন্ধ এবং জানস্কার পর্বতমালা। হিন্দু পুরাণে বলা আছে লিদ্দার নদীর ধর্মীয় গুরুত্বের কথা, কারণ পূর্ব লিদ্দারের উৎপত্তি পবিত্র শেষনাগ লেক থেকে। মন্দলন, লারিপরা, ফ্রাস্লুন, আশমুকাম এবং সীর হামদান এই অঞ্চলের কিছু দ্রষ্টব্য শহর।
কীভাবে পৌঁছাবেন : নিকটবর্তী এয়ারপোর্ট হল শ্রীনগর এবং নিকটবর্তী প্রধান রেলস্টেশন হল জম্মু। অনন্তনাগ থেকে লিদ্দারের দূরত্ব মাত্র ৭ কিলোমিটার। এরপরে আপনাকে করতে হবে হয় ভোরবেলার বাস বা শেয়ার ট্যাক্সি।
কী কী করবেন : এই ভ্যালির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং বৈচিত্র্য যারা চাক্ষুস উপভোগ করতে চান, তাদের জন্য মাঝারি কঠিন কলহই হিমবাহের ট্রেকটি একদম আদর্শ। কলহই পর্যন্ত না যেতে চাইলে নিকটবর্তী আরু গ্রামে হাইক করে গেলেও পাবেন একই মজা। লিদ্দার যাওয়ার পথে অবন্তীপোরায়ে দেখতে পারবেন প্রাচীন বিষ্ণু মন্দির, যা স্থাপিত হয়েছিল রাজা অবন্তীবর্মণের শাসনকালে (৮৫৫-৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ)। আছে গুরু নানক দেব গুরুদ্বারা, যেটিকে পূর্ব হিমালয় অঞ্চলে শিখ ধর্মগুরুর বিশ্রামস্থল হিসেবে মানা হয়ে থাকে।
৯. নুব্রা ভ্যালি
লেহ্ জেলা, লাদাখ
লাদাখের নুব্রা ভ্যালির নাম একসময় ছিল লদুমরা বা ফুলের উপত্যকা। শীতল মরুভূমির পক্ষে এই নামটি খুব অপ্রযোজ্য মনে হলেও, শিওক নদীর তীরে এই স্থানে এই ঘটনাটাই সত্যি হয়েছে। শুকনো বাদামী পটভূমি আর ঘন নীল আকাশের মাঝে এই রঙ-বেরঙের হাতছানি দেখে মনে হয় বাস্তব বহির্ভূত কিছু। কারাকোরাম পর্বতমালার মাঝে বয়ে যাওয়া সুবিশাল ইন্দাস নদীর উপনদী শিওক। নুব্রা ভ্যালির গড় উচ্চতা প্রায় ১০০০০ ফিট, আর গ্রাম গুলি আরও উঁচুতে অবস্থিত হওয়ার জন্য এখানে ঘুরতে যাওয়া বা বসবাস করা খুব দুরূহ। এই ভ্যালির ঠিক উত্তরে দেখতে পাবেন বিখ্যাত সিয়াচেন হিমবাহ।
কীভাবে পৌঁছাবেন : নিকটবর্তী এয়ারপোর্ট হল লেহ্ এবং নিকটবর্তী প্রধান রেলস্টেশন হল জম্মু। লেহ্ থেকে নুব্রা ভ্যালির দূরত্ব প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। এরপরে আপনাকে করতে হবে হয় ভোরবেলার বাস বা শেয়ার ট্যাক্সি।
কী কী করবেন : নুব্রা ভ্যালির দিসকিতে দেখতে পাবেন ৩২ মিটার উঁচু মৈত্রেয় বুদ্ধ মূর্তি। ১৪২০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে স্থাপিত দিসকিত গুম্ফা এখানকার বৃহত্তম গুম্ফা। প্রাচীন কালে এই ভ্যালির বিস্তৃতি ছিল গিলগিট বালতিস্তান অবধি, কিন্তু সীমানা ছোট হয়ে এলেও আজও এখানে থাকেন বালতি উপজাতির মানুষজন। এখানে কয়েক কিলোমিটার লম্বা বালিয়াড়িও দেখা যায়। এই বালিয়াড়িগুলোতে খুঁজে পাওয়া যায় ব্যাক্টরিয়ান উঠেদের দল, যারা আশেপাশের সি বাকথর্ন খেয়ে বেঁচে থাকে। ২০১০ সাল পর্যন্ত এই ভ্যালির তুর্তুক গ্রামটি পর্যটকদের জন্য বন্ধ ছিল। ২০১০ সালের পরবর্তী সময়ে সরকারের অনুমতিপত্র বা পারমিটের বদলে পর্যটকরা গ্রামটিতে যেতে সক্ষম হয়েছেন।
১০. দিবাঙ ভ্যালি
আপার এবং লোয়ার দিবাঙ জেলা, অরুণাচল প্রদেশ
অরুণাচল প্রদেশের সুদূর দিবাঙ ভ্যালি আপার ও লোয়ার দিবাঙ নামে দুটি আলাদা ভাগে বিভক্ত। আয়তনের দিক থেকে ৯১২৯ বর্গ কিমি বিশিষ্ট আপার দিবাঙ ভ্যালি ভারতের বৃহত্তম জেলা হলেও, জনসংখ্যার নিরিখে নিম্নতম। আপার দিবাঙ-এর জেলাসদর আনিনির ইতিহাস এখনও অধরা। স্থানীয় ইদু মিশমী এবং হাজার বছর আগে আগত তিব্বতি অভিবাসীরা এই অঞ্চলের মূল বাসিন্দা। মূল ভারতীয় ভূখণ্ডের সাথে আপার দিবাঙ-এর একমাত্র জোগাযোগস্থল আনিনি। বর্তমানে দিবাঙ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য নামে পরিচিত এখানকার জঙ্গলটি পূর্ব হিমালয়ের সবথেকে সমৃদ্ধ বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ বলে গণ্য করা হয়। মিশমী জঙ্গলে ইতিপূর্বে অচেনা এক ফ্লাইং স্কুইরেল বা উড়ন্ত কাঠবিড়ালি দেখা গেছে, যার নাম এই অঞ্চলের নাম অনুসারে দেওয়া হয়েছে মিশমী হিলস জায়ান্ট ফ্লাইং স্কুইরেল (পেটাউরিস্তা মিশমিয়েন্সিস)।
কীভাবে পৌঁছাবেন : ট্রেনে করে তিনসুকিয়া বা প্লেনে করে ডিব্রুগড় এয়ারপোর্ট এসে সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে আপনাকে এই ভ্যালিতে আসতে হবে। আপার দিবাঙ ভ্যালিতে শুধুমাত্র আনিনি পর্যন্তই রাস্তা আছে।
কী কী করবেন : যদি লোয়ার দিবাঙ ভ্যালি থেকে ঘুরে আসতে চান, তাহলে স্থানীয় বিভিন্ন সংস্থা বা ট্যুর অপারেটররা ট্রেকের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। ট্রেকগুলি রোয়িং থেকে শুরু হয়ে মিশমী গ্রামের মধ্যে দিয়ে গিয়ে নিজাম ঘাটে শেষ হয়। আপার দিবাঙ ভ্যালিতে আপনি আনিনি থেকে ঘুরে আসতে পারেন বা যেতে পারেন জঙ্গলঘন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকেন্দ্রে। কিন্তু প্রস্তুত থাকবেন, কারণ সংবেদনশীল এলাকা হওয়ায় কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে আপনার পারমিটের প্রয়োজন হবে।
১১. জুকু ভ্যালি
কোহিমা জেলা, নাগাল্যান্ড এবং সেনাপতি জেলা, মনিপুর
নাগাল্যান্ড এবং মণিপুরের সীমান্তের ঠিক মাঝামাঝি অবস্থিত অসাধারণ সুন্দর জুকু ভ্যালি। উত্তরাখণ্ডের ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সের মতোই, জুকু ভ্যালিও কেবলমাত্র ট্রেক করেই যাওয়া সম্ভব। বিশ্বেমা গ্রামের পাদদেশ দিয়ে বা জাখামা গ্রামের ভেতর দিয়ে আপনি এই ট্রেক শুরু করতে পারবেন। দুটি রাস্তাই নাগাল্যান্ড থেকে শুরু এবং আপনি কোহিমা হয়ে পৌঁছতে পারবেন। জুকু লিলি নামক এক বিশেষ ধরনের লিলি ফুলের কারণে, যা পৃথিবীতে আর কোথাও পাওয়া যায় না, এই ভ্যালি পৃথিবীবিখ্যাত। জুকু লিলি ছাড়াও এই ভ্যালির ঢেউখেলানো তৃণভূমিতে প্রতি বছর দেখতে পাওয়া যায় বিভিন্ন বৈচিত্রের পাহাড়ি ফুল।
কীভাবে পৌঁছাবেন : প্রথমে ট্রেনে বা প্লেনে করে আসতে হবে ডিমাপুর, সেখান থেকে ট্যাক্সি করে জাখামা বা বিশ্বেমা এসে ট্রেক শুরু করতে হবে।
কী কী করবেন : আপনি যদি মনিপুর হয়ে জুকু ভ্যালি যেতে চান তাহলে সেনাপতি জেলার মাউন্ট ইসু থেকে ৫ ঘণ্টার ট্রেকটি করতে পারেন। এই রুটটি সম্প্রতি মনিপুর মাউন্টেনিয়ারিং এন্ড ট্রেকিং এসোসিয়েশন উদ্বোধন করেছে। পাখি দেখার নেশা থাকলে যেতে পারেন পুলি বাদযে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে, যা জাপফি এবং জুলেকি নামক দুই পাহাড়ি জলধারার মাঝে অবস্থিত। জাপফু শৃঙ্গের ঠিক পাদদেশেই জুকু ভ্যালির অবস্থান। আর যেসব ট্রেকাররা নিজেদের চ্যালেঞ্জ করতে চান, তারা যেতে পারেন নাগাল্যান্ডের দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গের দিকে।
১২. ইউমথাং ভ্যালি
উত্তর সিকিম জেলা, সিকিম
১১,৬৯৩ ফুট উচ্চতায় পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত ইউমথাং ভ্যালিতে পাবেন অসংখ্য রডোডেন্ড্রন গাছের সমাহার। তিস্তা নদীর উপনদীর জলসিঞ্চনে পুষ্ট এই ভ্যালিতে পাবেন প্রায় ২৪ রকমের রডোডেন্ড্রন প্রজাতি ও ফুল। আন্তর্জাতিক স্কি ডেস্টিনেশন হিসেবেও এই উপত্যকা বিখ্যাত। ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস বাদে সারাবছরই এখানে থাকে পর্যটকদের আনাগোনা। এই ভ্যালির সবচেয়ে নিকটবর্তী শহর হল লাচুং, ভ্যালি থেকে গাড়ি করে সহজেই লাচুং যাওয়া যায়।
কীভাবে পৌঁছাবেন : প্রথমে পৌঁছতে হবে বাগডোগরা এয়ারপোর্ট (ইউমথাং থেকে ২১৮ কিলোমিটার দূরে) বা দার্জিলিং রেলস্টেশন। সেখান থেকে শেয়ার ট্যাক্সি নিয়ে বা ভোরবেলার বাসে চেপে ভ্যালির দিকে এগোতে পারেন।
কী কী করবেন : মার্চ থেকে মে মাসে প্রতিবছর রডোডেন্ড্রনের ফুল ফোটে, তাই এই সময় আন্তর্জাতিক রডোডেন্ড্রন উৎসব আয়োজিত হয়। যেতে পারেন শিং বা রডোডেন্ড্রন অভয়ারণ্যে। ইউমথাং ভ্যালিতে ঢোকার মুখে ছোট্ট একটি ট্রেকের মাধ্যমে আপনি যেতে পারেন ইউমথাং উষ্ণ প্রসবণে। এখানের জলে সালফারের মাত্রা বেশ বেশি এবং কিছু ওষধি গুণ ও লক্ষ করা গেছে। ইউমথাং থেকে মাত্র ২৩ কিলোমিটার দুরত্বে আছে জিরো পয়েন্ট (যার অপর নাম ইউম সামদং)। এর পরে আর কোনও রাস্তা নেই এবং কিছু কিলোমিটার পরেই চিন সীমান্ত। কিন্তু গ্রীষ্মকালে জিরো পয়েন্টে তিনটি নদীর মিলনস্থল সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় এবং হয়ে ওঠে পর্যটকদের বিস্ময়ের কারণ। লাচুং শহরের লাচুং গুম্ফায় যেতে পারেন, অথবা স্থানীয় সংস্কৃতিকে কাছ থেকে দেখতে চাইলে যেতে পারেন লাচুং-এর কার্পেট বোনার কেন্দ্রে।