আমাদের মধ্যে অনেকেই যখন এই দৈনন্দিন জীবনের বস্তাপচা ইঁদুরদৌড়ে হাঁপিয়ে পড়ি, আমাদের মধ্যেই আবার এক এক জন বিশেষ মানুষ সমস্ত বাধাকে পিছনে ফেলে নিজের স্বপ্ন সত্যি করার পথে এগিয়ে চলেন। এরকমই এমন অনুপ্রেরক হলেন প্রেরণা দাঙ্গী, যিনি আক্ষরিক অর্থেই তার জীবনে আসা প্রতিটি বাধা বিপত্তির শৃঙ্গ অতিক্রম করেছেন। প্রেরণা একজন বিশিষ্ট রক ক্লাইম্বার এবং বর্তমান ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ মহিলা বরফ আরোহী বা আইস ক্লাইম্বারদের মধ্যে অন্যতম। মাত্র ২৬ বছর বয়েসেই তাঁর ঝুলিতে অবাক করা অনেক অভিজ্ঞতা, যেমন চূড়ান্ত ঠান্ডা তাপমাত্রার সম্মুখীন হওয়া, সামিট ক্যাম্পে একলা আটকে পড়া বা ২০০০০ ফুট উচ্চতায় বরফের দেওয়াল বেয়ে ওপরে ওঠা!
সম্প্রতি ট্রিপোটোর সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণ করলেন এই অসমসাহসী মহিলা। আসুন জেনে নি তার এডভেঞ্চারগুলি সম্পর্কে, দেখে নি প্রেরণার দুনিয়ার এক ঝলক।
প্রেরণা, আপনি একজন পেশাদার আরোহী, ক্লাইম্বিং এর প্রতি এই আকর্ষণ বা ভালোবাসা খুঁজে পেলেন কীভাবে ?
"আমার বেড়ে ওঠা উত্তরাখণ্ডের রানিখেতে, তাই মাঠে ঘটে ঘুরে বেড়ানো আমার কাছে খুবই স্বাভাবিক। ছোটবেলা থেকেই দৌড়ঝাঁপ করা বা গাছে চড়ায় আমার অপার উৎসাহ। স্কুল কলেজে থাকাকালীন গ্রীষ্মকালে আমি প্রথমিক কিছু ক্লাইম্বিং কোর্সে ভর্তি হয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে, যতটা সম্ভব নিজেও বেরিয়ে পড়তাম নিজের ক্লাইম্বিং ক্ষমতাকে বাড়াতে ।"
প্রেরণা আমাদের জানালেন কীভাবে আলাস্কার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ডেনালি অতিক্রম করার সময় তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায় এবং কীভাবে ক্লাইম্বিং-এর পেছনে তিনি তাঁর সমস্ত অধ্যবসায় এবং ভালোবাসা উৎসর্গ করেন। আলাস্কা থেকে ফিরে এসে প্রেরণার মেন্টর প্রেরণাকে একটি ৮দিন ব্যাপী অভিযানে নিয়ে যান স্পিতি-তে, যেখানে প্রেরণা একদম নতুন কিছু রুটে আইস ক্লাইম্বিং করেন। প্রেরণা জানালেন "তার আগে আমি কখনও আইস ক্লাইম্বিং করিনি, কিন্তু আমার কাছে ছিল বহু বছরের রক ক্লাইম্বিং -এর অভিজ্ঞতা আর আল্পাইন ভূখণ্ডটা আমি খুব ভাল ভাবে বুঝতে পারি। তাই দুয়ে দুয়ে চার করে আমি আস্তে আস্তে ঠান্ডায় জমে যাওয়া একটি ঝর্ণা বেয়ে ওপরে উঠি। আমি উপলব্ধি করি যে আমি নিয়মিত আইস ক্লাইম্বিং করতে চাই। আর তাই তার কিছুকাল পরেই আমি রাশিয়া যাই এবং সেখানকার বরফ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগদান করি এবং আইস ক্লাইম্বিং এর খুঁটিনাটি শিখতে শুরু করি"।
ভারতবর্ষে আইস ক্লাইম্বিং এর জগতে মহিলাদের সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা বলা যায়, আপনি যখন শুরু করেছিলেন, কী বা কাদের থেকে আপনি অনুপ্রেরণা খুঁজে পেতেন ?
"আইস বা রক ক্লাইম্বিং-এর ক্ষেত্রে ভারতবর্ষে মহিলা রোল মডেল সেভাবে কেউ নেই। পাশ্চাত্য দেশে কিছু মহিলা ক্লাইম্বর আছেন বটে, কিন্তু তাঁদের সামাজিক পরিবেশ আমার চারপাশের দুনিয়া থেকে এতটাই আলাদা যে মেন্টর হিসেবে আমি কাউকে পাইনি। আস্তে আস্তে আমি মেনে নিতে শুরু করি যে অনুপ্রেরণা হিসেবে কোনও মহিলা কে আমি পাব না। তাই আমি নিজের উপরেই ফোকাস করি। নিজেকে নিয়েই আমার প্যাশন গড়ে ওঠে। আমি ক্লাইম্বিং -এর সমস্ত খুঁটিনাটি শিখতে শুরু করি, বিভিন্ন উপস্থিত রুটে চড়তে আর বিভিন্ন নতুন রুট প্রমবারের জন্যে আমি চড়তে থাকি, এভাবেই এই ক্ষেত্রে আমি পারদর্শী হয়ে উঠি। তাই ভারতবর্ষে যখন আইস ক্লাইম্বিং এর জগতে পথিকৃৎ হওয়ার সুযোগ পাই, সেই সুযোগ আমি লুফে নি", বললেন প্রেরণা।
প্রেরণার নিষ্ঠা এবং অধ্যবসায় তাকে এনে দিয়েছে সাফল্যের চূড়ায়, বর্তমান সময়ে তিনি একমাত্র মহিলা যিনি নতুন আইস ক্লাইম্বিং রুটের সূচনা করছেন। এর থেকে অনুপ্রেরণাজনক আর কী হতে পারে!
আপনার শেষ ক্লাইম্বিং-এর অভিজ্ঞতার ব্যাপারে কিছু বলুন
"ভারতীয়দের মধ্যে থাইল্যান্ড খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। শান্তিতে ছুটি কাটানো বা পার্টি করার জন্যে খুব সুন্দর জায়গা। কিন্তু আমি গেছিলাম অবশ্য রক ক্লাইম্ব করতে। অনেকেই জানেন না, কিন্তু ক্লাইম্বিং-এর দিক থেকে থাইল্যান্ড কিন্তু বেশ এগিয়ে আছে", জানালেন প্রেরণা।
ক্রাবি বিচের পাশেই টনসাই রুফওয়ালটি প্রেরণা আরোহন করেন। এটি থাইল্যান্ডের অন্যতম জনপ্রিয় পাথরখণ্ড এবং এর বাইরের দিকে ঝুলে থাকা রুফটি চড়ার অভিজ্ঞতা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হয়। সেই সম্পর্কে প্রেরণা বললেন, "আমার জন্যে খুবই নতুন একটা অভিজ্ঞতা ছিল এবং প্রচন্ড সুন্দরও বলতে পারি এই অভিজ্ঞতাকে, কারণ যতবার আমি পিছনে ফিরে তাকিয়েছি, দেখতে পেয়েছি শুধু দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র। আর শুধু এটুকুতেই শেষ নয়, পাথরটি বেয়ে চড়ার পর চূড়ার মাথায়ে থাকা এক পানশালার চেয়ারে হয়েছিল আমার যাত্রার শেষ। এর থেকে মজার অভিজ্ঞতা আর কী বা হতে পারে বলুন!"
এরম কঠিন চড়াইয়ে যাওয়ার আগে আপনি কীভাবে প্রস্তুতি নেন ?
প্রেরণার মতে "কঠিন কোনও চড়াইয়ের আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, শান্ত থাকা এবং নিজের লক্ষ্যের প্রতি অনড় থাকা। তাই থাইল্যান্ডে আমি ছিলাম একটি খুব সুন্দর এয়ার বি.এন.বি তে। ক্লাইম্বিং খুবই কঠিন একটি অ্যাক্টিভিটি, শেষ করার পরে ক্লান্তি শুধু চায় বাড়ি ফিরে আসতে। স্বাভাবিকভাবেই সব সময় তা সম্ভব নয়। তাই নতুন শহরে বা দেশে নিজের বাড়ির মতো আরাম আর স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পেতে আমি এয়ার বি.এন.বি গুলিকেই বেছে নিয়ে থাকি।"
তিনি আরও বললেন "একটাই ঘরে আটকে না থেকে একটা বড় জায়গায় স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করাটাই আমার পছন্দ। চড়াইয়ে যাওয়ার আগে এবং পরে একধরণের বিশেষ কফি আমার পছন্দ। এয়ার বি.এন.বি তে রান্নাঘরে যাওয়ার সুযোগ থাকায় আমি নিজের ইচ্ছেমতো সেই কফি বানিয়ে নিতে পারি। এই ছোট ছোট স্বাচ্ছন্দ্যগুলোই বাড়ির অভাব সেভাবে অনুভব করতে দেয় না, ক্লাইম্বিং এর আগে আমি মাথা ঠান্ডা রেখে এগোতে পারি।"
থাইল্যান্ডে থাকার সময় আর কী কী ভাল লেগেছে ?
"এয়ার বি.এন.বির সমস্তরকম সুবিধে বাদে আরেকটি খুব সুন্দর ব্যাপার হল ক্রাবিতে আমার স্থানীয় হোস্টের সাহায্য। স্থানীয় জীবনযাত্রা কী রকম হয় বা এখানকার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ কী রকম তা বুঝতে পেরেছি ওঁনার দৌলতে। বেড়ানোর সময় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার থেকে সবার সাথে মিশে যেতেই আমি বেশি স্বচ্ছন্দ, তাই এই ব্যাপারটা আমার বেশ ভাল লেগেছে। কিছু থাই শব্দ এবং স্থানীয় আদবকায়দাও শিখেছি। কোথাও গেলে, সেখানকার সংস্কৃতির কিছু অংশ আত্মস্থ করতে পারলে স্থানীয়রাও বেশ খুশি হন। আর সেটা দেখতেও খুব ভাল লাগে আমার। কোনও জায়গায় বেড়াতে গেলে সেই জায়গাটার সবকিছুর সাথে নিজেকে জড়িয়ে নেওয়ার থেকে ভাল তো আর কিছু হয় না, তাই না?"
আমরা নিশ্চিত বেশিরভাগ পর্যটকরাই এই কথাটি পরে সেটার সাথে সম্পূর্ণ একমত হবেন।
আপনার এই ক্লাইম্বিং এর প্যাশন আপনাকে কোথায় কোথায় নিয়ে গেছে?
"কিছু বিশেষ জায়গার কথা বলতে গেলে বলতে হয় আলাস্কার ডেনালি ন্যাশনাল পার্কের কথা, তা ছাড়াও আছে স্কটিশ হাইল্যান্ডের আভিমোর, রাশিয়ার কিরভ বা ইংল্যান্ডের পিক ডিস্ট্রিক্ট।" ভারতের বিভিন্ন জায়গায় মধ্যে থেকে সবচেয়ে পছন্দের গুলি বেছে নিতে বললে প্রেরণা বেশ কিছুক্ষণ ইতস্তত করেন, অবশেষে বলেন "হাম্পি, বাদামি, সেথান আর সুরু ভ্যালিতে চড়তে আমার খুবই ভাল লাগে"।
এখনো পর্যন্ত আপনার কাছে ক্লাইম্বিং এর সবথেকে সেরা অভিজ্ঞতা কোনটি?
"আমার সাম্প্রতিকতম অভিযান, ৬৪০০ মিটার উচ্চতায়, পূর্ব তোষ হিমবাহের পাপসুরা শৃঙ্গ আরোহনের অভিজ্ঞতার কথাই বলব। সেখানে প্রায় ৮০° উল্লম্ব দেওয়াল বেয়ে উঠতে হয়েছিল। কিন্তু এবার আমার আইস ক্লাইম্বিং-এর সমস্ত জ্ঞান এবং প্রশিক্ষণ সাথে ছিল, তাই আমি যা যা শিখেছি তা প্রয়োগ করতে পেরেছিলাম। সমগ্র অভিযান জুড়েই প্রতি মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এবং প্রতিটি পদক্ষেপ বিবেচনা করে এগোতে হয়েছিল। অনেক কিছু ব্যাপার আমি আবার নতুন করে শেখার সুযোগ পেয়েছি। এই অভিযানটি সত্যি আমার জীবন বদলে দিয়েছে", জানালেন প্রেরণা।
আপনার চরম স্বপ্ন তাহলে কি?
প্রেরণা বললেন, "আমার বাড়ি থেকে যে পর্বতমালাগুলো আমি দেখতে পাই, আমি সেগুলো চড়তে চাই। বৃহত্তর হিমালয় পর্বতমালার যে অংশটুকু আছে কুমায়নে। খুব কঠিন রক রুট গুলি আমি জয় করতে চাই। আইস ক্লাইম্বিং এর ক্ষেত্রে এখনো অজেয় বিভিন্ন শৃঙ্গে আমি উঠতে চাই, চাই নতুন নতুন রুটের সূচনা করতে।"
বাইরের জগৎ যাদের ভাল লাগে, সেইসব মহিলাদের আপনি কী পরামর্শ দেবেন?
"আমার মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল নিজেকে বাইরের জগতের সাথে তাল মিলিয়ে চলার। শুরুতে তা সহজ হবে না, কারণ এতদিন আপনি ছিলেন আপনার চেনা গণ্ডির মধ্যে। কিন্তু কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই আসে সেই সত্যিকারের পরিবর্তন। বাইরের জগৎ আপনাকে অনেক বিনয়ী করে তুলবে, আপনার কী চাই এর বদলে আপনার কী দরকার সেটা মনে করিয়ে দেবে।"
প্রেরণা আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিলেন, বললেন প্রত্যাশার জালে জড়িয়ে না পড়াই ভাল। "কিছু মানুষ তোমার থেকে অনেক কিছু আশা করবে, আবার কেউ কেউ তোমাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনবে না। এইরকম সময়ে আমাদের এটা মনে রাখা উচিত যে আমরা যা করি, তা শুধু নিজেদের জন্যে করি। অন্য কারওর কথা ভাবার প্রয়োজন নেই"।
ক্লাইম্বিং-এর প্রতি প্রেরণার ভালোবাসা এবং নিরলস অধ্যবসায় সত্যি আমাদের অনুপ্রেরিত করে। তুমিও যদি জীবনের নানান পরিস্থিতির কারণে নিজের স্বপ্নকে পূরণ করতে পারছ না, তাহলে ভেঙে পড়ো না, আবার নতুন করে ভাবনা চিন্তা নতুন করে পথ চলা শুরু কর। কে জানে, জীবনের পরেই মোড়েই হয়তো লুকিয়ে আছে তোমার জীবনের সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষা।