দক্ষিণ ভারতের অচেনা দিকগুলোর মধ্যে কর্ণাটক উপকূল অন্যতম। প্রাচীন সভ্যতাগুলোর ধ্বংসস্তূপের চিহ্নের সঙ্গেই এখানে পাবেন নকশিকাঁথার মতো বিছানো নির্জন দ্বীপসমূহ, রৌদ্রোজ্জ্বল সামুদ্রিক উপসাগর এবং ঢেউখেলানো পাহাড়ি ভূমিরূপ। পূর্বে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা আর আরব মহাসাগরকে পশ্চিমে রেখে, তার মধ্যে উত্তর কন্নড়, উদুপি এবং দক্ষিণ কন্নড়, এই তিনটি জেলা মিলিয়ে গড়ে উঠেছে এই অতুলনীয় উপকূলরেখা।
সঙ্গে অবশ্যই নিন আপনার ক্যামেরা, ডেকে নিন আপনার বন্ধুদের, গাড়িতে থাকুক চিপস্ আর কোলা, আর তৈরি হয়ে যান এমন এক জার্নির জন্যে, যেখানে আপনার সামনে শুধু খোলা রাস্তা, নীল আকাশ আর একরাশ সমুদ্রের হাওয়া অপেক্ষা করে আছে।
দক্ষিণ কন্নড় থেকে উদুপি : নির্মল সমুদ্রসৈকত
রুট : ম্যাঙ্গালোর - কুন্দাপুর - শিরুর
ছোট্ট ছোট্ট পাহাড়, ঘন জঙ্গল আর নির্মল জলাশয় মিলিয়ে গড়ে ওঠা দক্ষিণ ভারতের অন্যতম সুন্দর রাস্তা হল এই দক্ষিণ কন্নড় থেকে উদুপি যাওয়ার পথ। উপকূল রেখা বরাবর নিস্তব্ধ এই গ্রাম্য রাস্তা দিয়ে এগোনোর সময় দেখা পাবেন অনেক নির্জন বীচের। দেখতে পাবেন দিগন্ত বিস্তৃত মনমাতানো সূর্যাস্তের দৃশ্য, যা আপনাকে দেবে এক নীরব প্রশান্তির অনুভব।
উজ্জ্বল কঙ্কন উপকূলে, দক্ষিণ কন্নড়-এর বন্দর শহর ম্যাঙ্গালোরে আপনি পাবেন অসাধারণ আর বৈচিত্র্যপূর্ণ সি-ফুডের সমাহার। আর নিঝুম নিস্তব্ধ কুন্দাপুরে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে ঘন বনাঞ্চলে আচ্ছাদিত এবং দক্ষিণ ভারতীয় ভাস্কর্যশিল্পে অলংকৃত এক ঝাঁক মন্দির। আর শিরুর মূলত একটি মৎস্যজীবীপ্রধান গ্রাম হলেও, যাত্রা শেষের পরেও আপনার মনে করে নেবে নিজস্ব জায়গা। শিরুরের পরিচিতি তার স্নিগ্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা স্বর্ণা নদী। আর কর্ণাটকের এই অচেনা দিকগুলো আবিষ্কার করার সময় আপনার সঙ্গী হবে সিকাডা পোকাদের সম্মোহনী গুঞ্জন।
যাত্রাপথের সময়কাল : ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট
দূরত্ব : ন্যাশনাল হাইওয়ে ৭৫ আর ৬৬ হয়ে, প্রায় ১০৭ কিলোমিটার
পিট স্টপ : কুন্দাপুরে শেট্টিস লাঞ্চ হোমে চিকেন ঘি রোস্ট খেতে কিন্তু ভুলবেন না
কী কী অবশ্যই করবেন : দক্ষিণ কন্নড়ে পাবেন করার মতন প্রচুর অ্যাক্টিভিটির সুযোগ। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার বিভিন্ন ফরেস্ট ট্রেলগুলো দিয়ে ট্রেক করে পৌঁছতে পারেন পাহাড়ি আমেদিকাল্লু, এটটিনভূঝা, গাদাইকাল্লু বা কুমার পর্বতে। ম্যাঙ্গালোরের বিস্তৃত পানামবুর বীচে করতে পারেন প্যারাসেলিং বা সার্ফিং। যেতে পারেন পোলালি, ধর্মস্থলা, থোকুরু বা কাতিলের মন্দিরগুলোতেও। চেখে দেখতে পারেন ম্যাঙ্গালোরিয়ান কুইজিনের কিছু বিশেষত্ব, যেমন গোলিবাজজে, পাত্রদে, অদ্ভুত ইডলি-কাডুবু আর আপ্পা (কাঁঠালের ডাম্পলিং ভাজা)। উদুপিতে পৌঁছে চলে যেতে পারেন শ্রীকৃষ্ণ মন্দির, বা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সৃষ্ট কিন্তু কাঠামোগত ভাবে অত্যন্ত আধুনিক মন্দিরভূমি মাত্ত তে। আর যদি চান একলা সময় কাটাতে, তাহলে চলে যান উত্তাল সমুদ্রহাওয়ায় মাতোয়ারা কাপু সমুদ্রতটে। ন্যাশনাল হাইওয়ে ৬৬ ছাড়িয়ে এই বীচে এলেই দেখতে পাবেন এখানকার অন্যতম আকর্ষণ, লাইটহাউসটিকে... একা... নিঃসঙ্গ...
উদুপি থেকে উত্তর কন্নড় : নান্দনিকতা এবং ইতিহাসের মেলবন্ধন
রুট : শিরুর - ভাটকাল - গেরুসোপ্পা
শ্যাওলামাখা রাস্তা আর অগুনতি চা-বাগানের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলা এই রুটে দেখতে পাবেন অসংখ্য ঝলমলে জলপ্রপাত আর সারি সারি উইন্ডমিল। যাত্রাপথের এই পর্যায়ে আঁকাবাঁকা সর্পিল পথ এগোবে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, পাশে দেখবেন ব্যাকওয়াটারের জল কেমন সেজে উঠেছে লিলি পাতার বাহারে। উত্তর কন্নড় দিয়ে এই যাত্রার শেষে আপনি এসে পৌঁছবেন ভাটকাল আর গেরুসোপ্পা নামক কর্ণাটকের দুই অন্যতম প্রধান শহরে।
ভাটকাল বা ঐতিহাসিক পর্তুগীজ দলিলপত্র অনুযায়ী "বাতেকালা", একটি শান্ত বন্দরশহর। এই অঞ্চলের জনপ্রিয় বাজারটিই এখানকার বাসিন্দাদের প্রধান কর্মক্ষেত্র। সারি সারি টেবিলে সাজানো থাকে টেরাকোটার বাসনপত্র বা শুকনো মশলার থলি। খাদ্যপ্রেমীদের জন্যেও এই বাজার এলাকাটি আদর্শ। তারপর এখান থেকে সুন্দর বিস্তৃত রাস্তা ধরে বেরিয়ে পড়ুন গেরুসোপ্পার উদ্দেশ্যে। ঘন জঙ্গলের ভিতরে লুকনো এই মন্দিরশহরের অলিগলিতে পাবেন চতুর্দশ শতাব্দীর প্রাচীন জৈন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। একসময়ে এই শহরে ছিল একশোরও বেশি স্তূপ, কালক্রমে আজ তার সংখ্যা এসে ঠেকেছে ১২টিরও কমে।
যাত্রাপথের সময়কাল : ৬ ঘণ্টা
দূরত্ব : উদুপি - পেরদুর - আগুম্বে রোড হয়ে ২৪১ কিলোমিটার
পিট স্টপ : জবা পাতায় মুড়িয়ে ভাপানো সুগন্ধি সবুজ ইডলির স্বাদ চেখে দেখতে চান? তাহলে অবশ্যই থামুন শিরুরের ওয়াইল্ড উডস স্পা রিসোর্টে।
কী কী অবশ্যই করবেন : কাটাতে পারেন মাল্পে বীচের পান্নাসবুজ জলের পাশে অলস দুপুর, নিশ্চুপ সেন্ট মেরিস দ্বীপ থেকে দেখতে পারেন রূপলি পর্দা ভেদ করে যেন উঠে আসা সূর্যাস্ত, উদুপি থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে উদ্যাভার পিথ্রোডি গ্রামটিও অনিন্দ্যসুন্দর, যেতে পারেন আগুম্বে পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত সোমেশ্বর বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে, জমলু তীর্থের সাদা খরস্রোতা জলে করতে পারেন রাফটিং, বিশ্রাম নিতে পারেন উদুপির বেলভে গ্রামে; এমনকি উত্তর কন্নড় এর এক অসাধারণ মন্দির থেকে অন্য মন্দিরে যাওয়ার ধর্মীয় তীর্থযাত্রাও আপনার সাধ্যের মধ্যেই। গোকার্নায় থাকাকালীন ক্যামেরাবন্দি করতে পারেন কুদলে, ওম, হাফ মুন বা প্যারাডাইস বীচের শোভা; যাদের ইতিহাসে আগ্রহ তারা ঘুরে আসতে পারেন ষোড়শ শতাব্দীর মির্জান দুর্গের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে; সার্ফিং শিখতে চাইলে আছে গোকার্না বীচেই কোকোপেললি সার্ফিং স্কুল। আর দিনের শেষে শরীর মন তরতাজা করে নেওয়ার জন্যে থাক গোকার্না যোগব্যায়াম উদ্যানে যোগাসনের আসর।
কখন যাবেন : উপকূল কর্ণাটকা যাওয়ার আদর্শ সময় নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস। মিঠে শীতের আগমনের সময়। দিনের বেলা পাবেন রৌদ্রোজ্জ্বল ঝলমলে দিন, তাপমাত্রা থাকে মোটামুটি ২৫° সেলসিয়াসের আশেপাশে। তবে জঙ্গলে ঘেরা এই এলাকায় শীতের পরশ পাবেন সন্ধে ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই। হালকা শীতের জামা নিয়ে যেতে কিন্তু ভুলবেন না যেন।
কোথায় থাকবেন : যাত্রাপথের দ্বিতীয় পর্যায়ে উত্তর কন্নড় যাওয়ার জন্যে বেরিয়ে পরার আগে, দিন কয়েক বিশ্রাম নিতে পারেন ভাটকালের দ্য রয়্যাল ওক হোটেলে।