দলাই লামা বলেছেন, "নিজের মধ্যে শান্তি না থাকলে, বাইরের দুনিয়ায় শান্তি খুঁজে পাওয়া যায় না"। আর হয়তো এটাই ভুটানবাসীদের চোখে মুখে ফুটে ওঠা প্রশান্তির চাবিকাঠি। তারা নিজেদের জীবনে খুঁজে পেয়েছেন তৃপ্তি এবং তাদের দেশ, সমাজ এবং রাজা-রানীকে নিয়ে তারা সন্তুষ্ট। রাজনীতির বাইরে গিয়ে, আনন্দ আর শান্তিই হয়ে উঠেছে তাদের জীবনের লক্ষ্য। তার মানে এই নয় যে, তাদের জীবনে সমস্যার অভাব। কিন্তু অধিকাংশ ভুটানবাসী তাদের জীবনযাপন করেন বৌদ্ধ মতাদর্শ অনুযায়ী। তারা মনে করেন এই জন্মের সবকিছুই পূর্বজন্মের কর্মফল। এই বিশ্বাস থেকে তারা খুঁজে পান সন্তুষ্টি। আর সেই সন্তুষ্টি থেকেই এখানকার মানুষজন হয়ে ওঠেন জগতশ্রেষ্ঠ।
ভুটানবাসীরা আপনাকে স্বাগত জানাতে সদা আগ্রহী
ফুন্টশোলিং থেকে পারো যাওয়ার পথে আমাদের ট্যাক্সির ড্রাইভার আমাদের মন জয় করে নিতে কোনও কিছু বাকি রাখেননি। হানি সিংয়ের গান শুনিয়েছেন (হানি সিংয়ের বদলে স্থানীয় গান চালাতে বলায় কষ্টও পেয়েছেন), লখনৌতে তার কলেজ জীবনের গল্প শুনিয়েছেন (এবং এখনো তিনি লখনৌকে সেই একইভাবে ভালোবাসেন), পারোতে সবচেয়ে ভালো খাবার-দাবারের হদিশ দিয়েছেন এবং ভারতবাসী এবং ভারতবর্ষের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
সমাজের সব ক্ষেত্রে এগিয়ে মহিলারা
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের থেকে ভুটানের সমাজব্যবস্থা বেশি ভাল তা বলছি না, কিন্তু সবজায়গায় মহিলাদের উপস্থিতি একটা আলাদা নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়। নিজের সন্তানদের পিঠে বেঁধে নিয়েই এখানকার মহিলারা রেস্তোঁরা চালান, একলা বেরিয়ে পড়েন দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ড্রাইভে বা একলা হাতেই সামলে নেন হোটেলের রাত্রিকালীন দেখাশোনার সব দায়িত্ব। সত্যি, মন জয় করে নেওয়ার মতো দৃশ্য।
তাদের জীবনযাত্রা আড়ম্বরহীন এবং চিন্তামুক্ত
এই ব্যাপারটা বোঝা গিয়েছিল ভুটানে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু নিশ্চিত হলাম যখন দেখলাম বুমথাং-এর মধ্যে একটি গাড়ি আমাদের প্রায় চাপা দিয়ে দিচ্ছিল তখন। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সে গাড়ি গড়িয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে, কোনও ড্রাইভারের দেখা নেই। আমরা আর চারপাশের জনাকয়েক অধিবাসী মিলে গাড়িটিকে গায়ের জোরে থামিয়ে, ভেতরে উঁকি মেরে দেখি, ড্রাইভারের সিটে জমিয়ে ঘুম দিচ্ছেন এক ভুটানি ভদ্রলোক। কোলাহলের মধ্যে তিনি এক মুহূর্তের জন্যই ঘুম ভেঙে উঠলেন, একবার আমাদের দিকে অনুতপ্ত ভাবে দেখলেন, এবং সঙ্গে সঙ্গেই আবার ঘুমিয়ে পড়লেন।
ঘো এবং কিরা নিয়ে তারা যথেষ্ট সচেতন
ভুটানিরা প্রচন্ড স্বাস্থ্যবান এবং তাদের বেশভূষা একেবারে নিখুঁত। দিনেরবেলা, জনসমক্ষে তারা ভুটানি ট্রাডিশনাল জামাকাপড় পরার প্রথা মেনে চলেন, পুরুষদের জন্য ঘো এবং মহিলাদের জন্য কিরা। কিন্তু উনিফর্ম পড়লে আমাদের মুখ যেরকম গোমড়া হয়ে থাকে, তার বিন্দুমাত্র চিহ্ন তাদের মুখে চোখে পাবেন না। তারা নিজেদের পোশাক পরেন গর্বের সঙ্গে, আর তাদের চলন-বলনে ফুটে ওঠে স্টাইল আর ব্যাক্তিত্ব।
পুরুষাঙ্গ নিয়ে তারা লজ্জা পান না
ভুটানে গেলে আপনি দুটো জিনিস সব জায়গায় দেখতে পাবেন। প্রথমত দেখবেন প্রতিটি বাড়ির ছাদে শুকোতে দেওয়া হয়েছে বড় বড় টুকটুকে লাল লঙ্কা। আর দ্বিতীয়টি হল ছোট বড়, বিভিন্ন রকম পুরুষাঙ্গের প্রতিমূর্তি। বাড়ির বাইরে বড় কাঠের লিঙ্গের মূর্তি বা বিভিন্ন দেওয়ালে লিঙ্গের ছবি বা ছোট্ট ছোট্ট লিঙ্গের আকারের চাবির রিং, সবেতেই পাবেন পুরুষাঙ্গের ছোঁয়া। স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, অশুভ আত্মা কে দূরে রাখতে পুরুষাঙ্গের থেকে ভাল কিছু হয় না!!
রাজা ও রানীর প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অপরিসীম
আপনার ডেস্কে কার ছবি থাকে? আপনার স্বামী বা স্ত্রীর, আপনার সন্তানদের, নাকি আপনার পোষ্যের? কিন্তু আপনি ভুটানে বাস করলে বিষয়টা একটু অন্যরকম হত। মানে সেক্ষেত্রে ছবি থাকত ভূটানের রানী যেৎসুন পেমা এবং রাজা জীগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুকের। গাড়ির ড্যাশবোর্ড-এর ছোট্ট ফ্রেম থেকে দোকানের ভিতরে লাগানো বিশাল পোস্টারে, সর্বত্রই তাদের রাজত্ব। আর হবে নাই বা কেন। দেশবাসী এবং রাজপরিবারের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার মধ্যে রাজদম্পতির অবদান অনস্বীকার্য।
পৃথিবীর শেষ জলবিন্দুটি কিনতে চাইলেও এখানে কেউ আপনাকে ঠকাবে না
পারো থেকে ১১ ঘণ্টা বাসে জার্নি করে দুর্গম বুমথাং পৌঁছানোর পরে বাজেটে থাকার জায়গা খোঁজার অবস্থায় আমরা ছিলাম না। তাই বাস-স্টপের কাছে এক হোটেল-লজে থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বেশ পুরনো দিনের কাঠের আসবাবপত্র, ফায়ারপ্লেস, ট্রাডিশনাল সাজসজ্জা আর মখমলের মতো নরম বিছানা পেয়ে আমরা তখন খুব খুশি। এরম রাত-বিরেতে বুমথাং-এর মতন নিভৃত জায়গায় যেখানে থাকার জায়গার বড়ই অভাব, সেখানে এই হোটেলের মালিক আমাদের থেকে প্রচুর ভাড়া চাইবে বলেই আমরা ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু শেষমেশ ভাড়া দিলাম দিন প্রতি ১৫০০ টাকা। ১৫০০ টাকায় ৪ স্টার সুযোগ সুবিধা। ভূটানের লোকজন সত্যিই এতটা সৎ।
ভুটানের ভূখণ্ডের ৫০% জাতীয় উদ্যান হিসাবে সংরক্ষিত
কথিত আছে যে শুধুমাত্র প্রকৃতিই আপনাকে নিরাশ করবে না। আপনি প্রকৃতির যত কাছাকাছি থাকবেন, ততই আপনার অন্তরাত্মা শুদ্ধ হবে। ভুটানবাসীরা মনে প্রাণে এই কথাটি বিশ্বাস করেন এবং বৃক্ষছেদনের হাত থেকে দেশের বনসম্পদকে বাঁচাতে একত্র হয়েছেন।
রাস্তাঘাটে সঠিক আচরণ করার জন্যে তাদের ট্রাফিক লাইটের প্রয়োজন হয় না
ভুটানের রাজধানী হওয়ার কারণে, থিম্পুর রাস্তাঘাটেই ট্রাফিকের পরিমাণ সর্বোচ্চ। কিন্তু গাড়ি কখন চালাতে হবে আর কখন থামাতে হবে তা বোঝার জন্য ট্রাফিক লাইটের ব্যবহার হয় না। হাতে গোনা কয়েকজন ট্রাফিক পুলিশ আর কয়েকটা নির্দেশবাহী গাড়ি। তাই আমাকে রাস্তা পার হতে দেখে গাড়ি থামিয়ে দেওয়ায় সত্যি অবাক হয়েছিলাম। ছিলনা তাড়া দেওয়ার জন্যে কোনও হর্নের বাড়াবাড়ি। ড্রাইভারের মুখে ছিল শুধু এক সুমধুর হাসি।
ভূটানের প্রাকৃতিক রূপ অনির্বচনীয় সুন্দর, তাই ভুটানবাসীদের মধ্যেও পাবেন সেই সৌন্দর্যের প্রতিফলন
মানুষ হিসেবে ভূটানিরা কত ভাল, তা নিয়ে কথা বলা শেষ হওয়ার নয়, কিন্তু আমার মনে হয় সেই সৌন্দর্যের পেছনে হাত আছে ভুটানের অপূর্ব প্রাকৃতিক নান্দনিকতারও। স্বর্গের মতন সুন্দর এই দেশে যারা বসবাস করেন, তারা রূঢ় বা কঠোর হবেনই বা কী করে?
বলা যায় আমি প্রায় চিরজীবন-ই মুখ গোমড়া করে কাটিয়ে দিয়েছি, কিন্তু ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে যখন আমি ভুটানে গিয়েছিলাম, প্রতিমুহূর্তে অনুভব করেছিলাম আমি যেন একজন নতুন পরিতৃপ্ত মানুষে পরিণত হচ্ছি। একটি দেশের সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বোধহয় এটাই।