প্রশস্ত এবং লাল মাটির এই ঘাটটি স্থানীয় ভাষা অনুসারে ‘গঙ্গোনি ডাঙ্গা’ বা ‘গঙ্গোনি খোলা’ নামে পরিচিত। অনেকে আবার 'গনগনি' শব্দটিও ব্যবহার করে থাকেন। দীর্ঘদিন ধরে প্রাকৃতিক এবং ভৌগোলিক নানা ক্ষয়ের কারণে এই নদী তীরে এই পাড়ের ভূমিপ্রকৃতি অনেকাংশেই পরিবর্তিত হয়েছে। আর সেই কারণে এটি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্রেও পরিণত হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে আরও বেশ কয়েকটি তথ্য উল্লেখ করা যেতে পারে। ‘ক্যানিয়ন’ এই শব্দটি বললেই আমাদের মনের মধ্যে প্রথমেই যুক্তরাষ্ট্রের আরিজ়োনার ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’-এর কথা আসে। কিন্তু এখন যদি বলি পশ্চিম মেদনীপুরের এই ছোট উপকণ্ঠ শহরেই আপনি পেতে পারেন ক্যানিয়নের মিনিয়েচর ভার্সন তাহলে নিশ্চয়ই আগ্রহ আরও খানিকটা বাড়তে পারে। অনেকেই শিলাবতী নদী তীরে গড়ে ওঠা এই খাদের সঙ্গে ক্যানিয়নের তুলনা করে একে ‘পশ্চিমবঙ্গের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’ নামেও উল্লেখ করেছেন। বর্ষার সময়ে গঙ্গোনি বা গগগনি পাড় বরাবর শিলাবতী নদীর প্রবাহ প্রাকৃতিক পরিবেশকে করে তোলে মনোরম। সুন্দর।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাটি ঐতিহাসিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ এবং সমৃদ্ধ। প্রথমে ঐতিহাসিক সূত্রটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ঐতিহাসিক বিভিন্ন তথ্য-তত্ত্বের নিরিখে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাতে (দাঁতন অঞ্চলে, সেইসময়ে নাম ছিল ‘দন্দভুক্তি’) রাজা শশাঙ্কের সাম্রাজ্যের কিছু অংশ বিস্তৃত ছিল। প্রাচীন তাম্রলিপ্ত সাম্রাজ্যের অনেকাংশই ছিল এই জেলার অন্তর্ভুক্ত। ভৌগোলিক বিভিন্ন পরিভাষাতে আমরা এখন যেভাবে দেশ-কালের সীমানা নির্দেশ করে থাকি কিংবা একধরনের ভৌগোলিক মানচিত্রের তুলনামূলক আলোচনা করে থাকি, প্রাচীনকালে কিন্তু বিষয়টি ঠিক এইভাবে আলোচনা হত না। আপাতত এই প্রসঙ্গটিকে আমাদের আলোচনার বাইরে রেখে ফিরে দেখতে পারি প্রশাসনিক একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের দিকে। ২০০২ সালের ১লা জানুয়ারি অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলাকে দুটি অংশে ভাগ করে দেওয়া হয়, একটি অংশ পূর্ব-মেদিনীপুর এবং অন্য অংশটি পশ্চিম মেদিনীপুর নামে পরিচিতি পায়। খড়গপুর, মেদিনীপুর সদর এবং ঘাটাল এবং অন্যান্য অঞ্চল নিয়ে তৈরি হয় নবগঠিত এই জেলাটি।
প্রশাসনিক এবং ভৌগোলিক সীমানাকে অতিক্রম করে যদি আমরা এই অঞ্চলের চিরন্তন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা বলি তা নিঃসন্দেহে মনোজ্ঞ। একইসঙ্গে সুন্দর এবং উপভোগ্য। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে, এই কোভিড মহামারীর কালে… একইসঙ্গে গৃহবন্দি এই সময়ে প্রকৃতির নিসর্গ সৌন্দর্যের হাতছানি কারই না পছন্দ হবে? আর সেখানে যদি সামান্য কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক মাইল পথ পেরিয়েই পৌঁছে যাওয়া যেতে পারে তাহলে আর কোনও প্রশ্ন উঠতে পারে না।
এই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাতেই গড়বেতা শহরের উপকন্ঠে প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যের বিস্তৃতি চোখে পড়ে। একদিকে রুক্ষ-নিষ্প্রাণ পরিবেশ, অন্যদিকে শিলাবতী নদীর শান্ত শীতল প্রবাহ হয়ে উঠেছে একে অপরের পরিপূরক। প্রকৃতির এই অকৃপণ সৌন্দর্যের মধ্যেই অত্যাশ্চর্যের বিষয় হল শিলাবতী নদীকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা খাদ বা গিরিখাতের মতো ভূ-প্রকৃতি। আপাতভাবে রুক্ষ এবং লালবর্ণের এই গিরিখাতেই জড়িয়ে রয়েছে প্রকৃতির আসল রহস্য। বলাবাহুল্য শহুরে পরিবেশ থেকে বহুমাইল দূরে প্রকৃতির এই অজানা রূপ রাজ্যবাসী এবং ভারতীবাসীদের অনেকেরই অজানা।
নদী শব্দটি বৃহৎ অর্থে সময়েরও রূপক। তার একদিকে যেমন রয়েছে প্রকাশ-বিস্তার, তেমনই অন্যদিকে রয়েছে ক্ষয় বা বিনাশ… নদীমাতৃক ভারতের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে এমন অনেক নদীরই সন্ধান হয়তো পাওয়া যাবে যে নদীগুলির বর্তমানে আর কোনও অস্তিত্ব নেই। কালের গর্ভে সেই নদীর গতিও পথ হারিয়েছে। লুপ্ত হয়েছে। কিন্তু শিলাবতী নদী ( স্থানীয়দের অনেকেই একে বলে 'শিলাই নদী') কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া কোনও নদী নয়। এই নদীর নিজস্ব প্রবাহ পথ রয়েছে, রয়েছে বিস্তার, একইসঙ্গে রয়েছে তার নতুন রূপ সৃজনের ধারা। নদীর পাড় কেন্দ্রিক গিরিখাতকেই সেই সৃষ্টির প্রাথমিক ভিত্তিভূমি হিসেবে ধরা যেতে পারে।
সরকারের তরফ থেকে গঙ্গোনি বা গনগনির সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে পর্যটকদের যাতায়াতের সুবিধার্থে সিঁড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলেই আপনি পৌঁছে যাবেন আপনার কাঙ্ক্ষিত স্থানে। নিজের চোখেই দেখতে পাবেন নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট উঁচু-নীচু বিভিন্ন প্রকারের ভূমিরূপ। জানুয়ারি মাসে এইঅংশ অপেক্ষাকৃত বেশি রুক্ষ হয়, তুলনামূলকভাবে বর্ষাকালে সবুজের আভাস সেই রুক্ষতাকে অনেকাংশেই প্রশমিত করে দেয়। অর্থাৎ প্রাকৃতিক রূপের এক যুগ্ম বৈপরীত্যের সহবস্থান ছড়িয়ে রয়েছে এই গনগনি জুড়ে।
প্রকৃতির এই অদ্ভুত শিল্পকর্মের ভিড়েই রয়েছে এক পৌরাণিক গল্পকথা। মহাভারতেও রয়েছে এই গঙ্গোনি বা গনগনির কথা। স্থানীয়দের অনেকেই মনে করেন, এটিই সেই স্থান যেখানে পাণ্ডবদের অন্যতম ভীম বকাসুর নামে এক অসুরকে হত্যা করেছিলেন। সুতরাং, হিন্দু পৌরাণিক ঐতিহ্যের সঙ্গে এই স্থানের একধরনের সম্পৃক্ততা অবশ্যই রয়েছে।
গনগনি নিয়ে এই দীর্ঘ আলোচনার পরে একটা প্রশ্ন হতে পারে, গনগনি আপনি যাবেন কীভাবে? এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল রাস্তা বা সড়কপথ, একইসঙ্গে রেলপথ এই দুইধরনেরই ব্যবস্থা রয়েছে গনগনি পৌঁছানোর জন্য।
সড়কপথে :
আপনি যদি 'পশ্চিমবঙ্গের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন' যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তবে কলকাতা থেকে এনএনএইচ ৬ (NH6) ধরে বগানন হয়ে উলুবেড়িয়ায় যান। সেখান থেকে আপনি দুটি পৃথক রুট নিয়ে নিতে পারেন। হয় ঘাটাল হয়ে চন্দ্রকোনা টাউন বা এনএইচ ৬০(NH60) হয়ে শালবনী যেতে পারেন। ঘাটাল কিংবা শালবনী এই দুটি শহর থেকেই গনগনির দূরত্ব খুব বেশি নয়।
রেলপথে:
গাঙ্গানি বা গনগনির নিকটতম শহর গড়বেতা। যার নিজস্ব রেলস্টেশন রয়েছে। আপনাকে যা করতে হবে তা হল হওড়ার থেকে সাঁতরাগাছি স্টেশন থেকে রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস ধরতে হবে এবং কয়েক ঘণ্টা পরে আপনি নিশ্চিন্তে গড়বেতা স্টেশনে নামতে পারবেন।
থাকার ব্যবস্থা-
গনগনিতে ঠিক কোনও আবাসনের ব্যবস্থা নেই। তবে কাছের শহরগুলি এবং গড়বেতা এবং বিষ্ণুপুরে কয়েকটি হোটেল রয়েছে যেখানে আপনি থাকতে পারেন। গড়বেতা টাউন মোটামুটিভাবে বিকাশযুক্ত এবং আপনার সমস্ত প্রাথমিক সুবিধা যাবেন।
গনগনির চারপাশে দেখার মতো অনেক জায়গাই রয়েছে, সেগুলো হল-
সর্বমঙ্গলা মন্দির: সর্বমঙ্গলা মন্দিরটি বাগরি রাজা, নৃপতি সিংহ নির্মিত। ষোড়শ শতকে মন্দিরটি তৈরি হয়। মন্দিরটি দুর্গা দেবীকে উত্সর্গীকৃত। এই মন্দিরের প্রতিমা বেসাল্ট পাথর দিয়ে খোদাই করা। ওড়িয়া স্থাপত্যশৈলীর একটি অন্যতম প্রধান নিদর্শন হিসেবেও একে ধরা যেতে পারে।
রায়কোটার দুর্গ: বাগরির চৌহান রাজাদের আমলে ১৫৫৫-১৬১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনও এক সময়ে নির্মিত এই রায়কোটার দুর্গটি তৈরি হয়েছিল। ওড়িয়া স্থাপত্য শৈলীর এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শনও বলা যেতে পারে। তবে বর্তমানে পুরোটাই ক্ষয়প্রাপ্ত এবং ইতিহাসের চিহ্নটুকু নিয়ে অবশিষ্ট রয়েছে। এই ধ্বংসস্তূপের ভিড়েও রয়েছে প্রকৃতির অকৃত্রিম রহস্য, এই স্থান থেকে সূর্যোদয় এবং সূ্র্যাস্তের নৈসর্গিক দৃশ্য অবশ্যই উপভোগ্য।
বাগরির কৃষ্ণরাই জিউ মন্দির: কালো বেসাল্ট পাথর দিয়ে তৈরি এই মন্দিরটি বাগরি রাজা গজপতি সিংহের মন্ত্রী রাজ্যধর রায় নির্মাণ করেছিলেন। ইতিহাসের দিক থেকে এই মন্দিরটির যেমন আলাদা ঐতিহাসিক ঐতিহ্য রয়েছে, তেমনই স্থানীয় অধিবাসীদের পারস্পরিক বিশ্বাস এবং পরম্পরার সূত্রটি এক্ষেত্রে জড়িত।
তবে সবশেষে বলে রাখা ভাল গনগনি বা গঙ্গোনি কোনও লুকোনো জায়গা নয়, পশ্চিমবঙ্গবাসীদের মধ্যে বা ভারতীয়দের মধ্যে অনেকেই হয়তো এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে পরিচিত। তবুও এখনও পর্যন্ত যাঁরা যাননি তাঁরা অবশ্যই সপ্তাহান্তে এই স্থানটি একবার ঘুরে দেখতে পারেন। ইতিহাস এবং প্রকৃতির যুগ্ম এক অবস্থান আপনাকে অভিভূত করতে বাধ্য এমনটা নিশ্চিতরূপে বলতে পারি।
নিজের বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ট্রিপোটোর সঙ্গে ভাগ করে নিন আর সারা বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পর্যটকদের অনুপ্রাণিত করুন।
বিনামূল্যে বেড়াতে যেতে চান? ক্রেডিট জমা করুন আর ট্রিপোটোর হোটেল স্টে আর ভেকেশন প্যাকেজে সেগুলো ব্যাবহার করুন
(এটি একটি অনুবাদকৃত/ অনুলিখিত আর্টিকেল। আসল আর্টিকেল পড়তে এখানে ক্লিক করুন!)