সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য কলকাতার মজ্জায় মজ্জায়, আর তা বাঁচিয়ে রেখেছে কলকাতার সনাতন আড্ডা কালচার। হ্যাঁ! কালচার শব্দটির ব্যবহার করছি কারণ বাঙালি মানেই আড্ডাপ্রেমী... ক্ষেত্রবিশেষে আলোচনাপ্রেমী।
ইন্টেলেক্চুয়াল তর্ক বিতর্কের মোড়কে নির্ভেজাল আড্ডা খুঁজে পাবেন রাস্তার কোন টিমটিমে আলোর তলায়। পাবেন ক্যারাম বোর্ডের চারপাশে, পাবেন কফি হাউসের আবছা সিগারেট ধোঁয়ার হাতছানিতে, পাবেন চায়ের দোকানে মাটির ভাঁড়ে মিষ্টি চা হাতে বা বন্ধুর বাড়ির দরজায় শেষ কাউন্টারের টানে। কলকাতা আড্ডা দিতে বড্ড ভালোবাসে, সঙ্গে প্লেট ভর্তি চপ কাটলেট, সিগারেট আর কাপের পর কাপ চা বা কফি থাকলে তো সোনায় সোহাগা।
কম পয়সাতেও যে এত লোভনীয় খাবার দাবার কলকাতায় পাওয়া যায় সেটা কিন্তু নতুন কথা নয়। নতুন শতাব্দীতে বেড়েছে শহরের অলিতে গলিতে প্রচুর রংচঙে জাঁকজমকপূর্ণ পাব আর রেস্টুরেন্টের সংখ্যা, তাতে নিজেদের মতো করে আড্ডা দিতে ছুটছে প্রচুর পরিমাণে তরুণ তরুণী। সময়ে সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসেছে ক্যাফেটেরিয়া এবং অন্যান্য আধুনিক বিষয়সব।
কিন্তু একদম খাঁটি কিছু মুখরোচক খাবার খেতে চাইলে পৌঁছে যান এই হেরিটেজ খাবার দোকানগুলিতে (আর আরেকটা ছোট কথা এই প্রসঙ্গে, আপনার সঙ্গে কয়েকটা জেলুসিল রাখতে ভুলবেন না যেন!)।
১. ইন্ডিয়ান কফি হাউস, কলকাতা
কলেজ স্ট্রিট, রাস্তায় উপচে পড়া বইয়ের দোকান আর গলি ঘুঁজির মাঝে এক কোণে রয়েছে ইন্ডিয়ান কফি হাউস। সরু রংচটা সিঁড়ি দিয়ে ঘুরে উঠলেই হটাৎ এসে পড়বেন ব্রিটিশ আমলের বিরাট হলঘরে, অসংখ্য ছোট্ট ছোট্ট চৌকো টেবিল আর কথোপকথনের ভিড়ে।
ট্রেডমার্ক কাকাতুয়া টুপি পরে ওয়েটাররা সদাব্যস্ত এক টেবিল থেকে অন্য টেবিল এর তদারকি করতে, মুঠো রোদ্দুর এসে পড়ছে সিগারেট ধোঁয়ার মেঘে। তারই মধ্যেই বছরের পর বছর জমে উঠেছে তর্ক বিতর্কের খেলা।
কফি হাউসের প্রাক্তনীদের খাতায় নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বস, সত্যজিৎ রায় থেকে শুরু করে অমর্ত্য সেন, মৃনাল সেন, অপর্ণা সেনের মতো ব্যক্তিত্বদের। বর্তমানে ইনফিউশনের কাপে চুমুক দিয়ে সেই ঐতিহ্য বহন করছে কলেজ স্ট্রিট এর বিভিন্ন স্কুল কলেজ উনিভার্সিটির ছাত্র ছাত্রীরা। মটন কাটলেট আর ফিশ কবিরাজি সহযোগে আড্ডা থেকে কত যে বিপ্লবের সূত্রপাত, তার হিসেবে রয়েছে কফি হাউসেই। এককথায় কলকাতার কফি হাউস যেন ইতিহাসের এক জ্যান্ত আর্কাইভ...
কী খাবেন: ক্রিম দিয়ে কোল্ড কফি , চিকেন আফগানি কাটলেট
দু'জনের খরচ: ২০০ টাকা
কোথায়: ১৫, বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিট , কলকাতা
২. মিত্র ক্যাফে
কলকাতার অবশিষ্ট কেবিন ক্যাফে গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ১৯২০ সালে স্থাপিত মিত্র ক্যাফে। ১০০ বছর পরেও মিত্র ক্যাফের ফিস ডায়মন্ড ফ্রাই বা ফাউল কাটলেটের লোভ সামলাতে পারবে এরকম লোকদের খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
১৯২০ সাল নাগাদ, যখন বাংলার মানুষজন সবে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া শুরু করে, তখন মিত্র কাফে ও তার সমসাময়িক রেস্টুরেন্ট গুলিতে প্রথম দেখা পাওয়া যায় এই কেবিনগুলি।
পর্দা ঘেরা ছোট্ট চৌকো ঘর বা কেবিনগুলির মূল উদ্দেশ্য ছিল যাতে বনেদি বাড়ির মহিলারা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে নির্বিঘ্নে উপভোগ করতে পারেন। আস্তে আস্তে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ সময়ের সাথে এগিয়ে চলে, কেবিন গুলির ব্যবহারেও আসে বদল। তারপর থেকে এই কেবিনের চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে, ব্রেন চপের প্লেটের স্বাদে আহ্লাদে বেড়ে উঠেছে অসংখ্য প্রেম কাহিনি।
চেখে দেখুন মিত্র কাফের মটন চপ, বা সাহস থাকলে খেয়ে দেখুন ব্রেন চপ। তবে তাড়াতাড়ি যাবেন, আপনার অর্ডার দেওয়ার আগেই মিত্র কাফের সব চপ বিক্রি হয়ে যাওয়া আশ্চর্যের কিছু নয় কিন্তু।
কী খাবেন: বিভিন্ন মটনের আইটেম, ব্রেন চপ
দু'জনের খরচ: ৩০০ টাকা
কোথায়: ৪৭, যতীন্দ্র এভিনিউ, শোভা বাজার
দেখতে অনাড়ম্বরহীন হলেও, অনাদি কেবিনের মোঘলাই পরোটার গুণগ্রাহী ছিলেন উত্তম কুমার আর ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট তারকারাও। লখনৌ এর নির্বাসিত সম্রাট ওয়াজিদ আলী শাহ কলকাতাকে দিয়েছিলেন মুঘলাই ঘরানার ঐতিহ্য, কিন্তু কলকাতা শুধুমাত্র কাবাবে আর বিরিয়ানিতে থেমে থাকতে শেখেনি।
মোটা করে পরোটা, তার মাঝে কিমার পুরু আস্তরণ, আর বাইরেটা কড়া করে ভাজা। সাথে ঝাল ঝাল আলুর তরকারি আর মিহি করে কাটা পেয়াঁজ। ৯৪ বছর পুরানো অনাদি কেবিন এখনও চলছে রমরমিয়ে।
প্রতিদিন দুপুর বেলায়, দেখে যান ভিড়ে ঠাসা অনাদি তে কিভাবে একের পর এক মোঘলাই পরোটা তাওয়া থেকে প্লেটে উঠে আসছে। লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ুন, এ জিনিস হাতছাড়া করবেন না।
কী খাবেন: মোঘলাই পরোটা, কবিরাজি কাটলেট
দু'জনের খরচ: ১৫০ টাকা
কোথায়: ৯, জওহরলাল নেহেরু রোড, নিউ মার্কেট চত্বর
অ্যালেন কিচেন মানেই মুখের মধ্যে মিলিয়ে যাওয়া প্রন কাটলেট। ১৩৮ বছরের পুরোনো এই দোকানের বাইরের সাইনবোর্ডে লেখা 'স্বর্গের স্বাদ'। অ্যালেন এর খাবারের স্বাদের সামনে তা বিন্দুমাত্র অতিশয়োক্তি নয়। চতুর্থ প্রজন্মে দোকানটির কর্ণধার এখন জীবন কৃষ্ণ সাহা, যার হাত ধরেই প্রন কাটলেটের এত রমরমা।
জাঁকজমক খুঁজলে কিন্তু এখানে পাবেন না , শুধু পাবেন অসাধারণ একটা ফিশ কবিরাজি আর যতক্ষণ না কাটলেট আসছে, নিয়ে নিন এক বাটি মাটন স্টু। অবশেষে পাবেন খাঁটি ঘিয়ে ভাজা কাটলেটের ভেতরে তুলতুলে প্রন আর বাইরে মুচমুচে, সোনালী আবরণ। একবার একটু কাসুন্দি আর স্যালাড দিয়ে এক কামড় খেয়ে দেখলেই বুঝবেন কেন দোকান বন্ধ হওয়ার ঘন্টা দুয়েক আগেই এদের সব স্টক শেষ হয়ে যায়।
কি খাবেন: প্রন কাটলেট আর চপ
দু'জনের খরচ: ৩০০ টাকা
কোথায়: ৪০/১, যতীন্দ্র মোহন এভিনিউ, শোভা বাজার
৫. অলি পাব
অলিম্পিয়া বার এন্ড রেস্টুরেন্টের পথ চলা শুরু ১৯৪৭ সালে। ১৯৮১ সালে নাম পাল্টে হয় আজকের জনপ্রিয় অলি পাব। তৃষ্ণার্ত যুবক যুবতী, প্লেট ভর্তি স্টেক (যদিও সেগুলো আসল স্টেকের মতো নয় একেবারেই), নেশাতুর হৈচৈ আর অঢেল চানাচুর মিক্সের গুণে প্রতি সন্ধ্যায় অলি পাব হয়ে ওঠে জমজমাট।
অলি পাবে অ্যালকোহলের দাম বেশ সাধ্যের মধ্যে, তাই অনেকেরই ভয়ে ভয়ে বিয়ারের গ্লাসে প্রথম চুমুক এখানেই, আর বারে বারে ফিরেও এসেছেন তারা। রয়েছে নির্ভেজাল আড্ডার পরিবেশও।
তবে টেবিলের দাগগুলোর কথা বেশি না ভাবাই ভালো। আর সিগারেটের ধোঁয়ায় যদি একটু হুইস্কির গন্ধ না থাকে, তাহলে আর কীসের অলি পাব।
কী খাবেন: মিক্সড গ্রিল প্ল্যাটার, চিকেন আ লা কিভ
দু'জনের খরচ: ১০০০ টাকা
কোথায়: ২১ পার্ক স্ট্রিট
এককালে কালপুরুষ আর সাহেব বিবি গোলামের মতো সিনেমায় দেখা পাওয়া যেত ফার্ন হোটেলের। খাঁটি বাঙালি খাবার আর আনুষাঙ্গিক টুকিটাকির টানে সেই ১৯৩৮ সাল থেকে মানুষ ছুটে আসেন এই বিখ্যাত কেবিনে।
উৎসাহী প্রেমিক প্রেমিকাদের দৌরাত্ম্য সামলাতে না পেরে বহু পুরোনো রেস্টুরেন্টেই আজকাল আর কেবিনের দেখা পাওয়া যায় না। কিন্তু ফার্ন হোটেলের কেবিন গুলো আজো আছে, তাদের সামনে টাঙানো "লেডিস" লেখা বোর্ড, মহিলাদের দু দণ্ড শান্তির সন্ধান।
গড়িয়াহাট বাজারে কেনাকাটি দরদাম সেরে লাঞ্চ করতে চলে আসুন ফার্নে, কব্জি ডোবান ঝাল ঝাল মটন কষা বা ফিশ আফগানি তে। সন্ধে যত বাড়তে থাকে, ভিড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে হাওয়ায় বাড়তে থাকে মুচমুচে ফিশ ফ্রাই বা মোঘলাই পরোটার ঘ্রাণ।
কী খাবেন: বিভিন্ন মটন ডিশ, ফিশ ফ্রাই
দু'জনের খরচ: ৩৫০ টাকা
কোথায়: ১৯৩, রাসবিহারী এভিনিউ, ফার্ন রোড ইন্টারসেকশন, গড়িয়াহাট, কলকাতা
এখানে ডেভিলের নাম নিলে কিন্তু কেউ বাঁকা চোখে তাকাবে না। ডিমের ডেভিল, বিখ্যাত স্কচ এগ রেসিপির বাংলা সংস্করণ, তার ওপরের আবরণটি ভেঙে নিলে দেখতে পাবেন মটন কিমা দিয়ে ঘেরা হাঁসের ডিমের মোহময়ী রূপ। একটুখানি কাসুন্দির স্পর্শে নিরঞ্জনের ডেভিল যেন জিভের ওপর এনে দেয় চরম সুখের আবেশ। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল এখানে শুকনো কাসুন্দি বা কাসুন্দ দেওয়ার চল রয়েছে।
১৯২২ সালে স্থাপিত এই কেবিনের বাহ্যিক জৌলুসে একটু ভাটা পড়েছে। কিন্তু বিশ্বস্ত মক্কেলের দল আজও মনে করিয়ে দেয় আশির দশকে নিরঞ্জন আগারের স্বর্ণযুগের কথা, যখন গাড়ি থামিয়ে চপ কাটলেট অর্ডার করতেন অপর্ণা সেন, আর ডেভিল ছুটে যেত রাজভবনের রান্নাঘরে।
কী খাবেন: ডিমের ডেভিল
দু'জনের খরচ: ২৫০ টাকা
কোথায়: ২৩৯/এ , চিত্তরঞ্জন এভিনিউ, গিরিশ পার্ক
এক ঝাঁক বই, এক সারি বইয়ের দোকান, আর তার মধ্যে লুকিয়ে শতাব্দীপ্রাচীন বসন্ত কেবিন। ভেঙে পড়া বাড়িটি দেখলে মনে হয় যেন কবেকার হারিয়ে যাওয়া ফটোগ্রাফ। তার মাঝে ১২৯ বছর পুরনো এই কেবিন, যেন একবিংশ শতাব্দীতে নিজেকে খুঁজে পেয়ে সে নিজেও বিস্মিত।
সম্ভবত, বিখ্যাত কবিরাজির জন্ম এখানেই। তার পেছনেও রয়েছে বেশ এক মজার গল্প। শোনা যায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এসেছেন খেতে, কিন্তু বিস্কুট গুঁড়োর কোটিং দেওয়া কবিরাজি তাঁর রুচলো না, নালিশ গেলো রান্নাঘরে। হেড রাঁধুনীও দমবার পাত্র নন, নালিশটি নিলেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে। ব্রেডক্রাম্ব কোটিংয়ের পরিবর্তে ব্যবহার করলেন ডিম দিয়ে তৈরি ব্যাটার। জন্ম হল অভূতপূর্ব কবিরাজির, ওপরে পাতলা সোনালি কুড়মুড়ে আবরণ, আর ভেতরে নরম সাদা মাছের অবস্থান।
তারপরে বহু ক্যাফের মেনুতেই কবিরাজি জায়গা করে নিয়েছে, কিন্তু The Better India কে ম্যানেজার অমরনাথ রায় জানান ".... আমাদের মতো জায়গা গুলির সাফল্যের পেছনে রয়েছে বহু বছর ধরে লালন করা ভালোবাসা আর আড্ডা আর খাবারের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা সম্পর্ক। আমাদের রেসিপি টা হয়তো নকল করা যাবে, কিন্তু প্রতিটি ডিশের প্রতি আমাদের যে যত্ন আর ভালোবাসা তা কি করে নকল হবে!"
কী খাবেন: চিকেন কবিরাজি, ফিশ ফ্রাই
দুজনের খরচ: ২০০ টাকা
কোথায়: ৫৩, কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা
কীংবদন্তি এই কেবিন আর ক্যাফেগুলি কিন্তু আজ প্রায় স্মৃতির অগোচরে। জীর্ণ, রংচটা দেওয়াল, আর ফেলে আসা সোনালি দিনগুলির উদ্দেশ্যে ফেলা দীর্ঘশ্বাসের ভারে ভারাক্রান্ত। তবে তাদের সুখ্যাতি কিন্তু একটুও কমেনি। সকাল বিকেলে আজো খদ্দেরদের ভিড়ের মাঝে টেবিলে টেবিলে পৌঁছে যায় রকমারি সুখাদ্য, দু হাত ভর্তি ডিশ নিয়ে দ্রুতগতিতে ওয়েটার এসে থামে আপনারই সামনে।
দৈনন্দিন জীবনের জাঁতাকলের বাইরে বেরিয়ে এসে কাটিয়ে আসুন কয়েক ঘন্টা কলকাতার এই পুরোনো কেবিন গুলোতে। সঙ্গে থাকুক অসাধারণ সুস্বাদু কিছু খাবার, অনেকটা আড্ডা আর এক চিমটে নস্টালজিয়া।