বিশ শতকের একেবারে গোড়ার দিক। উনিশ শতকীয় নবজাগরণ আন্দোলনের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। নারীশিক্ষা ব্যবস্থাতেও এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন, সেইসঙ্গে নারীর সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রে এসেছে বহুমুখী ভাবনা প্রসঙ্গ। তবে, তখনও পর্যন্ত অনেককিছুই ছিল নারীর আয়ত্বের বাইরে। শিক্ষা থেকে সমাজ, সমাজ থেকে অর্থনীতি সব বিষয়েই নারীকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নীতি-নির্দিষ্ট নিয়মেই বন্দি থাকতে হয়েছে।
কিন্তু নিয়ম-নীতির বাইরে বেরিয়েও সমাজ এবং সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য। আজ যে নারী বিমানের ককপিটে মূলক চালকের আসনে বসে বিমানযাত্রী সহ বিমান পরিষেবায় বিভিন্ন রদবদল আনে, সেই নারীরই কিন্তু একটা সময়ে বিমানে চড়া এমনকি বাড়ির বাইরে বেরানোরও কোনও অধিকার ছিল না। উনিশ শতকীয় বঙ্গ রেনেসাঁর আঁচ সেই সময়ের আভিজাত্যপূর্ণ পরিবারগুলোতে বিশেষভাবে প্রভাব ফেললেও মেয়েদের স্বাধীনভাবে মেলামেশার ক্ষেত্রে ছিল বিশেষ কিছু প্রথাগত নিয়মনীতি। সেই সময়ের বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস বা স্মৃতিচারণমূলক রচনাতে ফুটে উঠেছে মেয়েদের স্নানযাত্রার এক ভয়ানক চিত্র। শোনা যায় অভিজাত পরিবারের মেয়ে এবং বৌ-রা গঙ্গাস্নানে যেতেন পালকি করে। সবথেকে মজার বিষয় হল পালকি বাহকেরাই পালকিটিকে সোজা নামিয়ে দিতেন নদীতে এবং সেই অবস্থাতেই স্নান সম্পন্ন হত। অর্থাৎ পর্দাপ্রথার থেকেও ভয়ংকর বিভিন্ন সামাজিক নিয়মের মধ্যে দিয়ে ওই সময়ে মেয়েদের জীবনধারা পরিচালিত হয়ে থাকত।
এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে, নিয়ম যেখানে থাকে, সেখানেই থাকে নিয়মের নানা বিধ ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। সেই দৃষ্টান্তের খোঁজেই সাক্ষাৎ ঘটে গেল মিসেস সেনের সঙ্গে। না, সিলভার স্ক্রিনের নায়িকার সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই, তবে বঙ্গ ইতিহাসেই শুধু নয় ভারতীয় সামগ্রিক ইতিহাস চর্চাতেও তাঁর উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি চোখে পড়ে।
কে এই মিসেস সেন?
মিসেস সেনর পরিচয় দেওয়ার আগে বলে নেওয়া প্রয়োজন মিসেস সেন হলেন ভারতীয় তথা বাঙালি ইতিহাসের প্রথম মহিলা যিনি প্রথম বিমানে চড়েছিলেন। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে এই ঘটনা অতি সাধারণ হলেও ওই সময়ের প্রেক্ষিতে নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। মিসেস সেন ছিলেন বঙ্গ সমাজসংস্কারক এবং সমাজ পরিচায়ক হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত শ্রী কেশব চন্দ্র সেনের পুত্রবধূ নির্মলা সেন বা নেলি সেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতেই হবে, সেই সময়ে তাঁর সহযাত্রী ছিলেন পুরুষেরাই। নির্মলা সেনের পারিবারিক আভিজাত্য এবং কৌলিন্য ছিল অবশ্যই উল্লেখযোগ্য, তাঁর বাবা ছিলেন একজন অ্যাডভোকেট। শিক্ষা এবং উদারনৈতিক মানসিকতার সঙ্গে মিসেস সেনের পরিচয় ছিল পারিবারিক এবং বৈবাহিক সূত্রেই।
কবে এই বিমানটি ওড়ে?
বিভিন্ন ঐতিহাসিক নথি এবং গবেষণার বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে এভিয়েশন গবেষক দেবাশিষ চক্রবর্তী জানিয়েছেন ১৯১০ সালের ১৯ বা ২০শে ডিসেম্বর কলকাতার টলি ক্লাব গ্রাউন্ড থেকে উড়েছিল ভারতের প্রথম শখের বিমান।
সেই সময়ের ইতিহাস নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ ১৯১০ সালের ২৮শে ডিসেম্বর টলি ক্লাব থেকে জুল টিক তাঁর হেনরি ফারমান বায়োপ্লেনটি আকাশে উড়িয়েছিলন প্রায় ৪৫মিনিট ধরে। যা পরবর্তীকালে ভারতের প্রথম পাবলিক ফ্লাইট হিসেবে পরিচিতি পায়।
শোনা যায় এর আগেও বেশ কয়েকটি পরীক্ষামূলক ফ্লাইট চালানো হয়েছিল এবং সেই ফ্লাইটেরই একটিতে যাত্রীর আসনে ছিলেন মিসেস সেন। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেই সময়ে নারীর অধিকার এবং নারী স্বাধীনতা বা সমানাধিকারের কোনও বিষয়ই সমাজে বিশেষ মান্যতা পায়নি। ওই প্রেক্ষিতে নারীর এই ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারীর এই নিয়ম বর্হিভূত দৃষ্টান্তের কথা তুলে ধরাই হল প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য...