বর্তমান কোভিড পরিস্থিতে যখন আমরা সকলেই কম বেশি ঘরবন্দি, তখন মন ভাল করার একমাত্র উপায় বোধহয় আমাদের আগের ঘুরে আসার স্মৃতিগুলিকে আর একবার ঝালিয়ে নেওয়া! কে জানে, হয়তো ফিরে দেখার মধ্যে দিয়েই আমরা হয়তো খুঁজে পাব ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। গত ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে ঘুরে এসেছিলাম গ্যাংটক এবং পশ্চিম সিকিমের বিভিন্ন ছোট ছোট গ্রাম থেকে। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দু-সপ্তাহ ব্যাপী এই ট্রিপটি যেন সারা বছরের ক্লান্তি দূর করে দিয়েছিল।
সিকিম যাওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি
২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে সিকিম যাওয়ার সময় বাধ্যতামূলকভাবে আমাদের ট্যুরিস্ট ট্র্যাভেল কার্ড তৈরি করে নিয়ে যেতে হয়েছিল এবং সিকিমের বিভিন্ন চেক পোস্টে সেই কার্ডের যাচাই করা হয়। ছাঙ্গু লেক এবং নাথুলা পাস জাতীয় জায়গাতে যাওয়ার পারমিট করার সময়েও ট্র্যাভেল কার্ড দেখাতে হয়েছিল।
বর্তমানে ভারতবর্ষ জুড়ে কোভিডের দ্বিতীয় ওয়েভ চলার কারণে বিভিন্ন রাজ্যে লকডাউন চলছে এবং বিভিন্ন ট্র্যাভেল রেস্ট্রিক্সন আরোপিত হয়েছে। সিকিমও এর ব্যতিক্রম নয়।
সিকিমের রুট ম্যাপ
ডিসেম্বর মাসে সিকিম যাওয়ার পিছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল দুই প্রকার - সারাবছর একই জায়গায় আটকে থাকার পর অন্তত কিছুদিন যাতে একটু প্রকৃতির কাছে থেকে শান্তি পেতে পারি আর ডিসেম্বরের ঠান্ডায় সিকিমের ভয়ঙ্কর সুন্দর সৌন্দর্য অনুভব করতে পারি।
এই কারণে আমরা গ্যাংটক দিয়ে ট্রিপ শুরু করলেও পরবর্তী দিনগুলির জন্যে বেছে নিয়েছিলাম পশ্চিম সিকিমের কয়েকটি অপেক্ষাকৃত অফবিট জায়গা - রিনছেনপং, মার্তাম, বার্মিওক আর দারাপ। পশ্চিম সিকিমের আরও কিছু উল্লেখযোগ্য স্পট হল ওখরে, হিলে, ভার্সে, পেলিং এবং ইয়াকসম। পর্যটকরা গাড়ি ভাড়া করে সহজেই পশ্চিম সিকিমের এক জায়গায় থেকে বাকি জায়গাগুলি ঘুরে আসতে পারেন। ডে ট্রিপ করার জন্যে রয়েছে এখানে প্রচুর সুযোগ।
সিকিমে থাকার ব্যবস্থা - হোটেল না হোম স্টে
ব্যক্তিগতভাবে ঘুরতে যাওয়ার সময় যদি কোনও বড় জায়গায় যাওয়ার কথা হয় অর্থাৎ যেখানে প্রচুর ট্যুরিস্ট সমাগম হয়, সেই সব জায়গায় ভাল হোটেলে থাকা বেশ সুবিধাজনক। সেক্ষেত্রে সকল পরিষেবা ভালভাবে পাওয়া যায়। এই কারণে গ্যাংটকে আমি বেছে নিয়েছিলাম বুকম্যানস বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট - এমন এক জায়গা যেখানে একই সঙ্গে রয়েছে থাকার ব্যবস্থা, বই-এর দোকান এবং একটি ক্যাফে। গ্যাংটকে লোকাল সাইট-সিয়িং এর জন্যে গাড়ি এবং পারমিটের ব্যবস্থাও এখান থেকেই হয়ে গেছিল।
কিন্তু বড় শহর ছেড়ে যদি আপনি আরও গভীরে যেতে চান, তাহলে পাহাড়ি হোম-স্টেগুলির আদর আপ্যায়নের জুড়ি মেলা ভার। রিনছেনপং, দারাপ, মার্তাম ইত্যাদি জায়গার হোম-স্টেগুলিতে যে কদিন ছিলাম, ওনারা যেন একেবারেই নিজেদের পরিবারের মতো আপন করে নিয়েছিলেন। পাহাড়ি মানুষদের ভালবাসা অভিজ্ঞতা করতে হলে কিন্তু ছোট্ট কোনও অজানা গ্রামের হোম-স্টেতে অবশ্যই থাকতে হবে!
ট্রিপ হাইলাইটস - কী কী করেছিলাম পশ্চিম সিকিমে
শীতকালে সিকিম, দার্জিলিং, নর্থ বেঙ্গল এই সকল এলাকার আবহাওয়া থাকে অত্যন্ত মনোরম। তাই ঠান্ডা থাকলেও, গোটা ট্রিপটি ছিল অত্যন্ত সুন্দর। দুই সপ্তাহের ট্রিপে এমন বেশ কয়েকটি অভিজ্ঞতা হয়েছে যা মিস করা যাবে না।
কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন : পেলিং, রিনছেনপঙ বা কালুক থেকে সমগ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জের অসাধারণ ভিউ পাওয়া যায়। সিকিমের অন্য কোনও ট্যুরিস্ট স্পট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে এত কাছ থেকে বা এত স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাওয়া যায় না। সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত - উভয় সময়েই কাঞ্চনজঙ্ঘা হয়ে ওঠে মোহময়ী।
গ্যাংটক সাইট-সিয়িং : গ্যাংটকের লোকাল সাইট সিয়িং বা মনেস্ট্রিগুলি বাদেও এখন থেকে ডে ট্রিপে বেরিয়ে দেখে আসতে পারেন ছাঙ্গু লেক, নাথুলা পাস আর বাবা মন্দির। হাতে কিছুদিন সময় থাকলে গ্যাংটক থেকে নর্থ সিকিমের লাচেন - লাচুং - গুরুদংমার সার্কিটটিও ঘুরে আসা যায়।
ট্রেকিং : পশ্চিম সিকিমের নানান ট্রেকিং রুটে বেরিয়ে পড়তে পারেন সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে। বার্সের রোডোদেনড্রন ট্রেক, দারাপ থেকে রানী ধুঙ্গা ট্রেক বা সিঙ্গালীলা ট্রেকের মতো অজস্র রুট অপেক্ষা করে রয়েছে আপনার জন্যে।
মোনাস্ট্রি হপিং : গ্যাংটক এবং পশ্চিম সিকিম মিলিয়ে আছে বহু জনপ্রিয় এবং কিংবদন্তি তিব্বতি গুম্ফা। রুমটেক, দুবদি বা তাসিডিঙের মতো মনেস্ট্রির খ্যাতি জগৎবিখ্যাত।
সিকিমিজ কুইজিন : সিকিম ভ্রমণের পিছনে অন্যতম কারণ ছিল সিকিমের নানান রকম আঞ্চলিক খাবার চেখে দেখা। হোম স্টেগুলির ঘরোয়া খাবার বা গ্যাংটকের এম.জি.মার্গের রেস্টুরেন্ট, সমস্ত সিকিম জুড়ে ভাল খাবারের কোনও অভাব নেই। অন্যতম উল্লেখযোগ্য নানা ধরনের ফ্রুট ওয়াইন, আপেল, কলা, কমলালেবু, ইত্যাদি ফল দিয়ে তৈরি হয় নানান রকম ওয়াইন, যা খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। রডোডেনড্রোন গাছের ফুল দিয়ে তৈরি লালিগুরাস ওয়াইন পর্যটকদের খুব প্রিয়।
নিরিবিলি অবসরযাপন : তবে এই ট্রিপের সবথেকে বড় পাওনা ছিল মনের সুখে নিশ্চিন্তে কয়েকদিন কোনও কাজ না করে একেবারে সুখে শান্তিতে অবসরযাপন, যা সারাবছর দুশ্চিন্তার পর মনকে করে তুলেছিল তরতাজা, দিয়েছিল নতুন প্রাণের সন্ধান।
কেমন লাগল সিকিম বেড়িয়ে আসার গল্প? আপনিও স্মৃতি রোমন্থন করে আমাদের জানাতে পারেন আপনার মনপসন্দ ট্রিপের কাহিনি!