সত্যজিত রায়ের বিখ্যাত উপন্যাস এবং সিনেমা সোনার কেল্লা দেখার পর সচক্ষে সেই কেল্লা দর্শনের ইচ্ছা বহুদিন ধরেই মনের মধ্যে লালিত হচ্ছিল । আমি একজন ভ্রমণপ্রেমী মানুষ আর সেই কারণেই ইতিহাসকে সামনে থেকে উপলব্ধি করার লোভটা সামলাতে পারলাম না । তাই একদিন সময় করেই কলকাতা থেকে বেরিয়ে পড়লাম রাজস্থানের সোনার কেল্লা দর্শনের উদ্দেশ্যে । ভ্রমণের আগে এই ঐতিহাসিক স্থানটির ইতিহাসটা একটু জেনে নেওয়া যাক -
সোনার কেল্লার ইতিহাসচর্চা
কিংবদন্তী অনুসারে জানা যায় সোনার কেল্লা ১১৫৬ সালে রাজপুত বংশীয় রাজা রাওয়াল জয়সাল নির্মাণ করেন ।১২৯৩ - ১২৯৪ সালে দিল্লির সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি এই কেল্লাকে নিজের দখলে আনার জন্য কেল্লা সহ রাওয়াল জয়সাল কে বন্দি বানিয়ে নেন । এরপর রাজপুত এবং খিলজির সঙ্গে অমীমাংসিত যুদ্ধের পর এই ফোর্টটি বহুকাল পরিত্যক্ত হিসেবে পড়েছিল । এরপর ১৫৪১ মুঘল সাম্রাজ্যের রাজা হুমায়ুন ও এই কেল্লা দখল করার চেষ্টা করেন ।পরবর্তী কালে আকবরের সাথে রাজপুত রাজা তাঁর কন্যার সঙ্গে বিবাহ দিয়ে চুক্তিবদ্ধ হন । ১৭৬২ সাল পর্যন্ত সময়ে এই কেল্লা মুঘলদের দখলাভুক্ত ছিল । পরবর্তী কালে ১৮১৮ সালে এই ফোর্ট রক্ষার স্বার্থে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে রাজপুতদের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । তাই ইংরেজরা এই ফোর্টের সম্পদগুলি অপরহরণ করা থেকে বিরত থাকেন।
এই ফোর্টের গঠনপ্রকৃতি
এই ফোর্টটি প্রায় ৪৬০ মিটার উঁচু এবং ২৩০ মিটার চওড়া । চুনাপাথরে নির্মিত এই ফোর্টটি থর মরুভূমির ত্রিকূট পাহাড়ের উপরে অবস্থিত । স্বর্নাভ আভরণে এই বিশাল ফোর্টটি দেখলে মনে হয় কোনো দ্বাররক্ষীরা একসঙ্গে থর মরুভূমিকে রক্ষা করে চলেছে । প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি এই ফোর্টটি রাজস্থানের দ্বিতীয় প্রাচীনতম ফোর্ট হিসেবে পরিচিত ।
সোনার কেল্লা বা জয়শালমীর ফোর্টের সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য -
১. বর্তমানে এই ফোর্টটি রাজস্থানের বিখ্যাত ভ্রমণস্থান হিসেবে পরিচিত । জয়শালমীর শহরের বেশিরভাগ মানুষ এই ফোর্টের মধ্যেই বসবাস করেন।
২. প্রায় ৪০০০ মানুষ এই কেল্লায় বাস করেন। মূলত ব্রাহ্মণ এবং রাজপুত বংশের মানুষরাই কেল্লায় বসবাস করেন।
কেল্লার দর্শনীয় স্থান -
এই ঐতিহাসিক কেল্লার পরতে পরতে রয়েছে নানান ইতিহাস । এই কেল্লার বিখ্যাত ভ্রমণ স্থানগুলি হল -
রাজ মহল প্যালেস
এই প্যালেসে রাজপুত বংশের রাজা মহারাওয়াল বাস করতেন ।
জৈন মন্দির
কেল্লার ভিতরে মোট ৭টি জৈন মন্দির আছে । অসাধারণ স্থাপত্য এর নিদর্শন এই মন্দির গুলি ১২শ - ১৬ শ শতকে নির্মিত ।
লক্ষীনাথ মন্দির
এই মন্দিরে স্থাপিত আছেন দেবী লক্ষী এবং ভগবান বিষ্ণু । এছাড়াও রয়েছে ১০০ বছরের প্রাচীন হাভেলি ।
আমার চোখে সোনার কেল্লা
দুই রাত ট্রেন যাত্রার পর যোধপুর হয়ে জয়শালমীর পৌঁছেতে বিকাল হয়ে গিয়েছিল। তবে যতই ক্লান্তি থাকুক না কেন হোটেল পৌঁছানোর আগেই পড়ন্ত বিকেলে সোনালী আভায় প্রতিফলিত হওয়া ঐতিহাসিক ফোর্ট এর প্রথম দর্শনে আমি আপ্লুত হয়ে পড়ি ।মনের মধ্যে এই কেল্লা সম্পর্কে নানান কৌতূহল নিয়ে একরাত হোটেলে কাটিয়ে সকাল সকাল কেল্লা দর্শনে গিয়ে রহস্য উপন্যাস এবং ইতিহাসকে প্রত্যক্ষ করি।
এই বিশালাকার কেল্লা ভ্রমণ করতে প্রায় ১টা গোটা দিন সময় লাগবে, এছাড়াও এখানে থর মরুভূমি ও দর্শন করতে পারবেন তাই হাতে কিছুটা সময় রেখেই ভ্রমণের পরিকল্পনা করবেন । আর এই কেল্লার ইতিহাসকে জানার জন্য গাইডের সাহায্য নিতে কিন্তু ভুলবেন না । এই কেল্লা দর্শন করার ফলে সোনার কেল্লা সিনেমার দৃশ্যগুলি সরাসরি উপভোগ করার সাথে সাথে উপরি পাওনা হিসেবে রাজস্থানী সংস্কৃতির সাথে ও পরিচিত হতে পেরেছিলাম ।
কখন যাবেন?
রাজস্থান ভ্রমণের জন্য নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসটি ভ্রমণের জন্য আদর্শ।
কীভাবে যাবেন?
বিমানে - ভারতের যে কোনও বিমানবন্দর থেকে পৌঁছে যান যোধপুর বিমানবন্দর । সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে ২৯০ কিমি পথ অতিক্রম করে পৌঁছে যান গন্তব্যে ।
ট্রেনে - ভারতের যে কোনও শহর থেকে ট্রেনে চেপে পৌঁছে যান যোধপুর রেলস্টেশন । স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে ৫ ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে পৌঁছে যান জয়শালমীর ।
এই কেল্লায় সত্যিই কোনও গুপ্তধন আছে নাকি সমগ্র কেল্লাটিই আসলে ভারতের একটা অনন্য সম্পদ , এই সত্যের অন্বেষণ করতে হলে আপনাকে আসতেই হবে জয়শালমীর ফোর্ট ।