প্রত্যেকটা বাঙালির মনের মণিকোঠায় স্থাপিত ব্যক্তিত্বগুলির মধ্যে অন্যতম হলেন সত্যজিৎ রায়। গুপি গাইন বাঘা বাইন, সোনার কেল্লা, চারুলতা, পথের পাঁচালীর মতো অজস্র সিনেমা এবং কাহিনি বাংলা সিনেমা এবং সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে । আচ্ছা যদি সেই সিনেমা বা কাহিনির স্মৃতি বেয়ে বাস্তব স্থানগুলি ঘুরে আসা যায় তাহলে কেমন হয়? কাহিনিগুলির বাস্তব প্রতিচ্ছবি পেতে এই ব্লগের সাহায্যে আপাতত মানসভ্রমণ করে নেওয়া যাক -
১. হীরক রাজার দেশে -
এই নস্টালজিক ছবিটির কেন্দ্রে আছে পুরুলিয়া এবং জয়চণ্ডি পাহাড়, যা বর্তমানে একটি বিখ্যাত পর্যটন স্থান হিসেবে পরিচিত। কী সেই হীরক রাজার দেশটা নিজের চোখে একবার দেখে আসবেন?
দর্শনীয় স্থান - জয়চণ্ডি পাহাড়ের উপর থেকে সম্পূর্ণ রঘুনাথপুর গ্রামের একটি সুন্দর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায় । এই সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য অনুধাবন করার পর প্রায় ৪০০ সিঁড়ি পেড়িয়ে পৌঁছে যেতে পারেন মন্দিরে। নতুন বছরের সূচনায় জয়চণ্ডি পাহাড়ের পাদদেশে বেশ আড়ম্বর সহকারে মেলার আয়োজন ও করা হয় ।
কখন যাবেন - শীতকালীন সময়ই জয়চণ্ডি পাহাড় ভ্রমণের জন্য আদৰ্শ।
কীভাবে যাবেন -
ট্রেনে - হাওড়া থেকে চক্রধরপুর এক্সপ্রেস বা বোকারো স্টিল সিটি এক্সপ্রেস ধরে মাত্র ৫ঘণ্টার দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যেতে পারেন গন্তব্যে ।
সড়কপথে - কলকাতা থেকে গাড়ি ভাড়া করে মাত্র ৫ঘণ্টা ৩০মিনিট দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যেতে পারেন জয়চণ্ডি পাহাড় ।
২. পথের পাঁচালী -
১৯৫৩ সালে পথের পাঁচালীর নিশ্চিন্দিপুর এবং অপু দুর্গার ছেলেবেলাকে খুঁজে পেতে পৌঁছে যেতে পারেন কলকাতা শহরের খুব কাছেই অবস্থিত বোড়াল অঞ্চলে ।
দর্শনীয় স্থান - এখানে আপনি খুঁজে পাবেন হরিহরের বাড়ির প্রধান দরজা, একটা উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ, একটি স্নান করার পুকুর এবং নিশ্চিন্দিপুরের প্রাচীন মন্দির ।
কখন যাবেন - বর্ষাকাল ছাড়া যে কোনও সময় এই স্থানটি পরিদর্শন করে আসতে পারেন ।
কীভাবে যাবেন -
ট্রেনে - কলকাতা শহরের মেট্রো করে পৌঁছে যান কবি নজরুল মেট্রো স্টেশন, সেখান থেকে অটো ভাড়া করে পৌঁছে যেতে পারেন বোড়াল বা বকুলতলা ।
৩. অপরাজিত -
অপরাজিত এর প্রথম সিকোয়েন্সটা মনে পড়ে? এই সিনেমার সূচনা হয় বেনারস থেকে। অপুর হেরে না যাওয়ার গল্পের স্মৃতিরোমন্থন করতে পৌঁছে যেতে পারেন বেনারস ।
দর্শনীয় স্থান - বেনারসের দর্শনীয় স্থানগুলি - দশাশ্বমেধ ঘাট, মনিকর্ণিকা ঘাট, অসি ঘাট, পবিত্র গঙ্গানদী, এবং কাশী বিশ্বনাথ দর্শন করে নিন ।
কখন যাবেন - বছরের যে কোনও সময় বেনারস যেতে পারেন। তবে শীতকালে এখানকার আবহাওয়া বেশ মনোরম থাকে ।
কীভাবে যাবেন -
বিমানে - কলকাতার নেতাজী সুভাষ বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মাত্র ঘণ্টা দেড়েক দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যান লাল বাহাদুর শাস্ত্রী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ।
ট্রেনে - হাওড়া থেকে ট্রেনে চেপে ৬৮০কিমি দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যেতে পারেন বারাণসী ।
৪. সোনার কেল্লা -
সোনার কেল্লা ছবিটির সাথে আমরা সকলেই পরিচিত । এই সোনার কেল্লা দর্শন করতে পৌঁছে যান রাজস্থানে। এই রাজস্থানের জয়সলমীর শহরের অবস্থিত এই সোনার কেল্লা। ইচ্ছা করলে ফেলু মিত্তিরের মতো অনেক গুপ্ত তথ্যের সন্ধানে বেড়িয়ে পড়তে পারেন ।
দর্শনীয় স্থান - জয়সালমীরের ফোর্ট অর্থাৎ সোনার কেল্লা ছাড়াও দর্শন করে নিন গাদিসার লেক, বারা বাগ মন্দির, পাটওয়া হাভেলি, সালাম সিং কি হাভেলি, আর অবশ্যই থর মরুভূমি ।
কখন যাবেন - মরুভূমি অঞ্চল ভ্রমণের জন্য ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস আদৰ্শ সময় ।
কীভাবে যাবেন -
বিমানে - কলকাতা থেকে বিমানে চেপে পৌঁছে যান জয়পুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে ৫৭২ কিমি পথ অতিক্রম করে পৌঁছে যেতে পারেন জয়সলমীর।
ট্রেনে - হাওড়া থেকে যোধপুর এক্সপ্রেস ধরে পৌঁছে যান যোধপুর স্টেশন । স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে মাত্র ৪ঘণ্টা ৩০মিনিট দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যান গন্তব্যে ।
৫. অরণ্যের দিনরাত্রি -
সত্যজিৎ রায়ের অরণ্যের দিনরাত্রি ছবির স্মৃতিকে উপভোগ করতে হলে পৌঁছে যেতে পারেন পালামৌ শহরের বেতলা অঞ্চলে ।
দর্শনীয় স্থান - আপনি যদি অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী এবং একই সঙ্গে প্রকৃতিপ্রেমী হন তাহলে এই স্থানটি ভ্রমণের সুযোগটা মিস করবেন না । এখানে আপনি পালামৌ রেঞ্জ এবং কোয়েল নদীর সঙ্গে মধুরালাপ করে নিতে পারেন । এছাড়াও কেচেকি ফরেস্ট রেস্ট হাউস এবং পালামৌ ব্যাঘ্র সংরক্ষণাগার সর্বোপরি ডাল্টনগঞ্জ শহর দর্শন করে নিতে পারেন।
কখন যাবেন - নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস এই অঞ্চল ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ সময় ।
কীভাবে যাবেন -
ট্রেনে - হাওড়া থেকে ট্রেনে চেপে পৌঁছে যান রাঁচি। রাঁচি স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে প্রায় ৫ঘণ্টার দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যান ডাল্টনগঞ্জ ।
সড়কপথে - কলকাতা থেকে গাড়ি ভাড়া করে ভায়া রাঁচি বা ধানবাদ হয়ে পৌঁছে যেতে পারেন ডাল্টনগঞ্জ ।
৬.ছিন্নমস্তার অভিশাপ -
সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ছিন্নমস্তার অভিশাপ বা সদ্যমুক্তি পাওয়া ফেলুদা ফেরতে এর সঙ্গে সমস্ত সত্যজিৎপ্রেমী মানুষ যথেষ্ট পরিচিত । এই দেবী ছিন্নমস্তার দর্শন পেতে চাইলে এবং ফেলুদার রহস্য সমাধানের সেই কাহিনি বাস্তব প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেতে পৌঁছে যেতে পারেন ঝাড়খণ্ডের রামগড়ের রাজারাপ্পা মন্দিরে ।
দর্শনীয় স্থান - এখানে আপনি দেবী ছিন্নমস্তার দর্শন করে আশীর্বাদ নিয়ে নিন । এরপর নৌকা করে দামোদর এবং ভৈরবী নদীর সংযোগস্থল দর্শন করে নিতে পারেন । শীতকালে এখানে গেলে আপনি অনেক পরিযায়ী পাখির সন্ধান পেতে পারেন ।
কখন যাবেন - ডিসেম্বর -জানুয়ারী মাস ভ্রমণের জন্য আদৰ্শ । এছাড়াও নবরাত্রি তিথিতে এখানে মেলার আয়োজন করা হয় । তাই নবরাত্রিতে দেবীর দর্শন পেতে চাইলে অক্টোবর মাসটিকে বেছে নিতে পারেন ।
কীভাবে যাবেন -
ট্রেনে - হাওড়া থেকে রাঁচিগামী ট্রেনে চেপে পৌঁছে যান রামগড় । স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে মাত্র ২৮কিমি দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যান গন্তব্যে ।
সড়কপথে - কলকাতা থেকে খড়গপুর হয়ে মাত্র ৭ঘণ্টার দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যান রাজারাপ্পা মন্দির ।
৭. হত্যাপুরী -
সত্যজিৎ রায়ের গোয়েন্দা কাহিনিগুলির মধ্যে হত্যাপুরী উপন্যাসটি অন্যতম। ১৯৭৯ সালে সন্দেশ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হওয়া এই কাহিনিটির প্রেক্ষাপটে রয়েছে পুরী শহর ।
দর্শনীয় স্থান - পুরী মানেই জগন্নাথ দর্শন এবং সমুদ্র। এছাড়াও গুন্ডিচা মন্দির, হনুমান মন্দির, সুদর্শন ক্র্যাফট মিউজিয়াম দর্শন করে নিতে পারেন ।
কখন যাবেন - বর্ষাকাল ছাড়া বছরের যে কোনও সময় পৌঁছে যেতে পারেন পুরী ।
কীভাবে যাবেন -
বিমানে - কলকাতা থেকে পৌঁছে যান ভুবনেশ্বর বিজু পট্টনায়ক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর । সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে মাত্র ১ঘণ্টা ৩০মিনিটের দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যেতে পারেন গন্তব্যে ।
ট্রেনে - হাওড়া থেকে পুরী যাওয়া জন্য অনেক ট্রেন উপলব্ধ আছে ।
সত্যজিৎ রায়ের গোয়েন্দা কাহিনিগুলির বাস্তব রূপরেখা দর্শন করার যাত্রাটা কেমন লাগল আমাদের লিখে জানাতে কিন্তু অবশ্যই ভুলবেন না ।