ইছামতী নদীর পশ্চিমতীরে অবস্থিত ছোট এই মফস্সলের শহরটি পর্যটকদের কাছে বিশেষভাবেই জনপ্রিয়। ছোট এই শহরটাকে ঘিরে রয়েছে বহু প্রাচীন ইতিহাস এবং ইতিবৃত্ত। ইতিহাসের পাতায় বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ উত্তর ২৪ পরগণার এই শহর টাকিতে রয়েছে রাজা এবং রাজপরিবারের অনেক তথ্য। রাজা প্রতাপাদিত্যের বংশধর কৃষ্ণদাস রায়চৌধুরী টাকিতে বসতি স্থাপন করেন। বর্তমান ইছামতি নদীর নাম কিন্তু সে সময়ে যমুনা-ইছামতী নামে অত্যন্ত সুপরিচিত ছিল। ইতিহাসের বিভিন্ন নজির থেকে জানা যায় রাজা কৃষ্ণদাসের প্রচেষ্টায় টাকি সম্ভ্রান্ত এবং ব্রাহ্মণ পরিবারের বাসভূমিতে পরিণত হয়। নন্দদুলালের বিগ্রহের জন্য টাকিতে জালালপুর গ্রামের বেশ নামডাক ছিল। রাজা মানসিংহ প্রতাপাদিত্যের সাম্রাজ্যে আক্রমণের পূর্বে টাকিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দু’পক্ষের লড়াই হয় বসিরহাটের সংগ্রামপুরে। প্রতাপাদিত্যের সৈন্যদলকে তাড়া করে মানসিংহের বাহিনি। টাকি শ্মশানের পাশ দিয়ে ইছামতী পার হয়ে রক্ষা পায় প্রতাপাদিত্যের দলবল। সেই ইতিহাসকে মনে রেখেই শ্মশান-সংলগ্ন রাস্তার নাম পরে রাখা হয় মানসিংহ রোড। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে টাকি কুলেশ্বরী কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা হয়। টকিতে ইচ্ছামতী নদীতে দুর্গা পূজার বিজয়া দশমী উপলক্ষ্যে ভারত ও বাংলাদেশের বেশ কিছু পূজা কমিটি নৌকায় করে দুর্গা প্রতিমা নিয়ে বিসর্জনে অংশ নেয়। যা এখন টাকির একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। একইসঙ্গে প্রতিবছরে দশমীর দিনে দুইবাংলার এই প্রকার মিলন ঘটে যায়, বিজয়ার সুরে...
টাকি শহরটির অবস্থান নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ, বলে রাখা প্রয়োজন শহরটি ইছামতী নদীর পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত এবং অন্যদিকে ইছামতীর পশ্চিমতীরে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশ-কাল-সময়ের সীমারেখাকে পেরিয়ে দুই অখণ্ড বাংলার পারস্পরিক বন্ধনের যোগসূত্রটি তৈরি হয়েছে ইছামতী নদীটিকে কেন্দ্র করে।
কীভাবে যাবেন
টাকি শহরটি কলকাতা থেকে প্রায় ৭০ কিমি পূর্বে অবস্থিত, কাজেই আপনি সড়কপথ এবং রেলপথের মাধ্যমে অবশ্যই যাতায়াত করতে পারেন।
সড়কপথে
কলকাতার এসপ্ল্যানেড থেকে কলকাতা বাস রুট ২৫২ ধরে হাসনাবাদ যেতে পারেন। এই পথেই বারাসাত এবং বাসিরহাট থেকে টাকি যায় বাসটি। আরেকটি বাস, ৭৯ সি রুটে একটি অনুরূপ পথ অনুসরণ করে কিন্তু এটি এসপ্ল্যানেডের পরিবর্তে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে যাত্রা শুরু / সমাপ্ত করে। যাত্রায় ২-৩ ঘণ্টা সময় লাগে।
রেলপথে
টাকি রেল স্টেশন কলকাতা শহরতলি রেলপথের হাসনাবাদ শাখার অংশ। এটি উত্তর কলকাতায় বারাসত রেল জংশন স্টেশনের মাধ্যমে শিয়ালদহ স্টেশনে যুক্ত রয়েছে। কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেনে টাকি পৌচ্ছাতে প্রায় ২ ঘণ্টা সময় লাগে এবং প্রতিদিন কয়েকবার লোকাল ট্রেন শিয়ালদহ স্টেশন থেকে টাকি পর্যন্ত যাতায়াত করে।
কী কী করবেন
টাকি শহরে গিয়ে আপনি কী কী দেখতে পারেন, সেই তালিকা করতে গিয়ে সর্বপ্রথম বলা যায়, আপনি দেখতে পারেন
ইচ্ছামতী নদী-কে। বলাবাহুল্য এই নদীর মৃদুমন্দ সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই। নদীর পাড়ে বসে আপনি সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের পাশাপাশি, সূর্যের রঙিন আভার বিভিন্ন গতিবিধিকে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন।
রায়চৌধুরী জমিদার বাড়ি- সাবেকী আমলের জমিদার বাড়ির অন্দরমহলকে প্রত্যক্ষ করতে চাইলে অবশ্যই যেতে পারেন এই বাড়িতে। বলে রাখা ভাল প্রাচীন এই বাড়িটির কাছেই রয়েছে পুরনো এক নাটমন্দিরের প্রাঙ্গণ। স্বভাবতই প্রাচীন ইতিহাসের আস্বাদ পেতে চাইলে আপনি অবশ্যই ঘুরে আসতে পারেন।
মাছরাঙা দ্বীপ- এই দ্বীপের নামকরণের মধ্যেই রয়েছে একধরনের সৌন্দর্য। ইছামতী এবং ভাসা নদীগুলোর মিলনস্থলে অবস্থিত নির্জন এই দ্বীপটি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। বিভিন্ন রকমের পাখি এবং জলজ প্রাণী দেখার ইচ্ছে থাকলে আপনি অবশ্যই ঘুরে আসতে পারেন।
গোলপাতার জঙ্গল- জঙ্গলে ঘেরা এই ভূখণ্ডটি নদীর গতিপথ অনুসারে প্রসারিত। এই জঙ্গল বরাবর গেলে আপনি হয়তো বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডেও প্রবেশ করতে পারেন, তবে জঙ্গলে প্রবেশের আগে নিজের কাছে নিজের পরিচয় পত্রটি রাখা বিশেষভাবে কাম্য।
এছাড়া আপনি দেখতে পারেন রামকৃষ্ণ মন্দির এবং কুলেশ্বরী কালিবাড়িটি।
অন্যতম আকর্ষণের বিষয়
পর্যটকদের কাছে বিশেষভাবে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হল টাকিতে পৌঁছে ইছামতী নদীতে নৌবিহার। নৌবিহারের মাধ্যমে আপনি দেখতে পারেন বাংলাদেশ বর্ডার, বিদ্যাধরী কালিন্দী এবং ইছামতীর মোহনা, গোলপাতার জঙ্গল, যা স্থানীয়দের কাছে মিনি সুন্দরবন নামেও সুপরিচিত। সুতরাং, স্থানীয় খাবারে কামড় বসাতে বসাতে অনায়াসেই আপনার নৌকাভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন।
কী কী কিনতে পারেন
এই অঞ্চলে মালপোয়া বিশেষভাবে জনপ্রিয়, কাজেই ফেরবার পথে আপনি মালপোয়া কিনতে পারেন।
সুতরাং, সামনের কোনও একটা উইককেন্ডে গিয়ে ঘুরে আসুন এই শহরটি থেকে, নিজের অভিজ্ঞতাও ভাগ করে নিতে পারেন আমাদের সঙ্গে।