সেই কবে থেকে সবাই বাড়িতে বসে আছে বলুন তো! যাও একটু কাজের সূত্রে বাইরে বেরানো হত, তাও এখন এই পরিস্থিতিতে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। আগে কাজের চাপে মাথা তুলতে পারতেন না, আর এখন বাড়িতে বসে অবকাশ-ই অবকাশ। ফোন, ল্যাপটপ, টিভি যাই সামনে আসুক না কেন সেই করোনার সংবাদ। কিচ্ছু ভাল লাগছে না তো? মনে হচ্ছে.... এই লকডাউনটা উঠলেই দৌড়ে কোথাও একটা চলে যাবেন, একটু প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে। কিন্তু কাছাকাছি জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না? চিন্তা নেই। আপনার মনের সব বাসনা পূরণ করতে আজ এমন একটা জায়গার সন্ধান দেব যেখানে গেলে শুধু মন ভরবে না বাড়ি ফেরার পথে সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন ইতিহাসের কিছু অজানা তথ্যকেও।
পুরুলিয়া জেলার পঞ্চকোট পাহাড়ের কোলে নিতুড়িয়া থানার অন্তর্গত গোবাগ গ্রামের কাছে এই গড়পঞ্চকোট জায়গাটি অবস্থিত। বর্তমানে, যা পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে প্রাচীন অযাচিত ইতিহাসের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন সৃষ্টি করেছে এই স্থানটি।
খুঁজে পাওয়া গড়পঞ্চকোট দুর্গের ভগ্ন ইতিহাস-
পঞ্চকোট পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত রহস্যাবৃত ধ্বংসপ্রাপ্ত দুর্গটি গড়পঞ্চকোট দুর্গ নামে পরিচিত। গড় শব্দের অর্থ দুর্গ, পঞ্চ মানে পাঁচ আর কোট কথাটি এসেছে গোষ্ঠী থেকে। শোনা যায়, রাজা দামোদর শেখর ৯০ খ্রিস্টাব্দে পুরুলিয়া জেলার ঝালদা অঞ্চলের ৫ জন আদিবাসী সর্দারের সাহায্য নিয়ে এই স্থানে তাঁর রাজত্ব গড়ে তোলেন এবং সেই থেকেই এই জায়গাটির নাম হয় গড়পঞ্চকোট। পরবর্তীতে রাজবংশের উত্তরসূরিরা পঞ্চকোটে ছোট-বড় মোট ৪০ টি পাথর এবং পোড়ামাটির মন্দির তৈরি করেন। কারও কারও মতে, এই মন্দিরগুলি রাজার নন বরং ধনী বণিকেরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে জানা যায়। অনুমান করা হয়, প্রায় পাঁচ মাইল বিস্তৃত এই দুর্গটির ১২ বর্গ মাইল বিস্তৃত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল। দুর্গের পিছনে ছিল পঞ্চকোট পাহাড় আর বাকি তিন দিক গভীর পরিখা দ্বারা আবৃত ছিল। মূল দুর্গ ঘেরা ছিল পাথরের দেওয়াল দ্বারা। তাই এই গড়পঞ্চকোট দুর্গটি বেশ সুরক্ষিত বলে মনে করা হত।
তবে এই সমস্ত এখন ইতিহাস! স্থাপত্য প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অবলুপ্তির পথে। পড়ে রয়েছে হাতে গোনা দুই-একটি ভগ্নপ্রায় মন্দির। আর সেই রাজ দুর্গ, তার অবস্থা তো আরও খারাপ। কিন্তু কী এমন ঘটনা ঘটেছিল, যার জন্য আজ পুরুলিয়ার গড়পঞ্চকোটের অবস্থা এইরূপ হয়ে উঠল?
সেই সব কিছু জানব তবে এই রকম আরও আকর্ষণীয় সব ঘটনা এবং ইতিহাসের অজানা কিছু অধ্যায় জানতে হলে চোখ রাখুন আমাদের ট্রিপটো বাংলার ( https://www.tripoto.com/bn) পেজে।
ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে জানা যায় ১৭৪০ সালে সরফরাজ খাঁ কে হত্যা করে আলিবর্দি খাঁ বাংলার সিংহাসনে বসেন। সেই সময় বাংলার বিভিন্ন জায়গায় বর্গী ভাস্কর পণ্ডিত লুটপাট চালানো শুরু করেন। আলিবর্দি খাঁ কে প্রতিহত করার জন্য ওড়িশার নায়েব নাজিম রুস্তম জং ব্যবস্থা নিতে শুরু করলে, তা জানতে পেরে আলিবর্দি খাঁ তাঁকে উড়িষ্যা থেকে বিতাড়িত করেন। রুস্তম সং নাগপুরের মারাঠা শাসক রঘুজী ভোঁসলের সাহায্যে আলিবর্দি খাঁ কে পুনরায় প্রতিহত করতে সমর্থ হন। এইসময় রঘুজি একদল মারাঠা অশ্বারোহীকে বাংলায় পাঠিয়ে ভয়ানক হত্যাকার্য এবং লুটপাট শুরু করেন। এই মারাঠা অশ্বারোহীরা পাঞ্চেত হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে এবং তারপর ১০ বছর ধরে তারা সেখানে নৃশংস হত্যাকার্য এবং ধ্বংসলীলা চালায়। এই ঘটনা ইতিহাসের পাতায় বর্গী আক্রমণ নামে পরিচিত হয়। এই বর্গী আক্রমণের ফলে বাংলা প্রায় ধ্বংসের মুখে এগিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে ১৭৫১ সালে আলিবর্দি খাঁ-এর সঙ্গে মারাঠাদের চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে তখন বাংলায় বর্গী আক্রমণের অবসান হয়। বাংলায় প্রবেশের সময় এই বর্গীরা পঞ্চকোটে তাদের অত্যাচারে ছাপ রেখে আসে। গড়পঞ্চকোট প্রাসাদে ঢুকে প্রহরী এবং প্রাসাদ রক্ষীদের হত্যা করে লুটপাট চালায়। এখানকার সমস্ত স্থাপত্য ভাস্কর্যকে বিনাশ করে দিতে উদ্যত হয় এবং তাই দেখে তখনকার রাজা তাঁর ১৭ জন রানিকে নিয়ে আত্মসম্মান বাঁচাতে কুয়োতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। আর এইভাবে গড়পঞ্চকোট অবহেলিত ধ্বংসপ্রাপ্ত মৃত ভগ্নপ্রায় অবস্থায় পড়ে থাকে। প্রায় বারো হাজার বর্গফুট অঞ্চল জুড়ে পড়ে থাকায় ধ্বংসস্তূপ প্রমাণ করে দেয় প্রাসাদের সুবিশাল বিস্তৃতি।
দর্শনীয় স্থান-
• বড়ন্তি হ্রদ - এই রোদের সৌন্দর্য অসাধারণ শীতকালে এখানে প্রচুর পরিযায়ী পাখি দেখতে পাওয়া যায় |
• পাঞ্চেত বাঁধ - পশ্চিমবঙ্গ ঝাড়খণ্ড সীমান্তে এই বাঁধ অবস্থিত |
• মাইথন বাঁধ - বরাকর নদীর উপর এইবার দেখতে পাওয়া যায় |
• জয়চন্ডী পাহাড় - সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে চলচ্চিত্রের শুটিং হয় এই জায়গায়। মূলত ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের একটি পাহাড়।
• পঞ্চরত্ন মন্দির - ৬০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট বিগ্রহবিহীন এই মন্দিরটি গড়পঞ্চকোটের সবথেকে উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য শিল্প রীতির নিদর্শন। মন্দিরটি তৈরি হয়েছে টেরাকোটা শিল্পের আদলে। দক্ষিণ ও পূর্ব দুয়ারে অবস্থান করছে রাস মন্দির। মন্দিরের দেওয়ালে বিভিন্ন রকমের ফুল, পাখি, ফল, আলপনা, বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্যরত মানব-মানবীর মূর্তি খোদাই রয়েছে। এই মন্দিরের উত্তর-পশ্চিমে আরও কয়েকটি জীর্ণ ভগ্ন মন্দির দেখতে পাওয়া যায়।
• কঙ্কালী মাতার মন্দির - গড়পঞ্চকোটের পশ্চিম দিকে এই ভগ্নপ্রায় মন্দিরটি অবস্থান করছে। মন্দিরের সামনের অংশ অক্ষত থাকলেও; পিছনের অংশ প্রায় ধ্বংসের মুখে। কঙ্কালী মাতা ছিলেন গড়পঞ্চকোটের শেখর রাজবংশের কুল দেবী। কিন্তু বর্তমানে এই মন্দিরে বিগ্রহ দেখতে পাওয়া যায় না।
• আদি কল্যানেশ্বরী দেবী মন্দির- গড়পঞ্চকোটের বাঁদিকে রয়েছে প্রস্তর দ্বারা নির্মিত কল্যাণেশ্বরী মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।
• জোড় বাংলা মন্দির
• রানিমহল
কোথায় থাকবেন-
পাঞ্চেত রেসিডেন্সি নামে পরিবেশ বান্ধব একটি রিসর্ট রয়েছে।
এছাড়াও গড়পঞ্চকোটে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট-এর প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্র আছে, এগুলির মধ্যে যেটি ইচ্ছা অনলাইনে বুকিং করা যেতে পারে। এছাড়াও কাছেপিঠে অনেক গেস্ট হাউজ এবং হোটেল পেয়ে যাবেন।
কীভাবে পৌঁছাবেন এই ঐতিহাসিক জায়গায়-
হাওড়া থেকে ট্রেন করে প্রথমে বরাকর অথবা কুমারডুবি কিংবা আদ্রা স্টেশনে। স্টেশন থেকে আগের থেকে ঠিক করে রাখা গাড়িতে বা অটো ভাড়া করে গড় পঞ্চকোট পৌঁছনো যায়।
এছাড়াও প্রথমে আসানসোল পৌঁছে তারপর আসানসোল থেকে সড়কপথে দিশেরগড় হয়ে চিরকুন্ডা রাস্তা ধরে সোজা গড়পঞ্চকোট পৌঁছানো যায়।
তাহলে আর দেরী কিসের! বর্গী আক্রমণের ইতিহাসের এই করুণ প্রতিচ্ছবিকে চাক্ষুষ দর্শন করতে কোন একদিন সময় করে বেরিয়ে পড়ুন। তবে সাবধানতার জন্য বলে রাখি এই স্থানে বর্তমানে জঙ্গল এবং বিভিন্ন রকম বিষাক্ত কীট পতঙ্গের বসবাস রয়েছে। তাই সাবধানতা অবলম্বন করা আবশ্যিক। সঙ্গে মাস্ক আর স্যানিটাইজার নিতে একদম ভুলবেন না।