যৌগিক আগ্নেয়গিরি দ্বীপমালা এবং ৬৮৫২টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত প্রাচীন সংস্কৃতি এবং বিস্ময় জাগানো স্থাপত্যের মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সমন্বিত অদ্ভুত একটি দেশ হল জাপান। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ জাপানের এই দ্বীপগুলি ভ্রমণের জন্য আসেন। শুধু তাই নয়, জাপানের রাজধানী টোকিও পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় একটি জায়গা। উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যার দ্বারা পরিচালিত এই দেশে কিন্তু নাগোরো এমন একটি জায়গা রয়েছে, যেখানের একসময় জনসংখ্যা ৩০০ থাকলেও বর্তমানে তা ২৫ থেকে ৩০ জন। শুনলে আরও আশ্চর্য লাগবে প্রায় ১৯ বছর আগে এই গ্রামে প্রথম শিশুসন্তান জন্মেছিল। তারপর থেকে এই গ্রামে আর কোনো শিশুর জন্ম হয় নি। বর্তমানে যারা রয়েছে তারা প্রত্যেকে বৃদ্ধ এবং মধ্যবয়সী।
অবাক করা বিষয় হল, হাতেগোনা সামান্য কিছু মানুষকে নিয়ে গড়ে ওঠা এই গ্রাম কিন্তু গুগল সার্চে বা উইকিপিডিয়ায় বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কিন্তু কেন? কী এমন হয়েছে গ্রামের মধ্যে? আসুন জেনে নেওয়া যাক এর জনপ্রিয়তার কারণ।
সূচনালগ্ন-
সুকিমি আইয়ানো নামের প্রায় ৭০ বছর বয়সী একজন বৃদ্ধা জাপানের নাগোরো গ্রামের অধিবাসী। ছোটবেলায় পড়াশোনা করা সূত্রে এবং পরবর্তীতে বিবাহ করে সংসার করার তাগিদে তিনি ওসাকা শহরে পাড়ি দিলেও; ২০০২ সালে পিতার অসুস্থতার কথা শুনে তিনি পুনঃরায় তার ছেলেবেলার স্মৃতিবিজড়িত গ্রামে ফিরে আসেন। কিন্তু এই ফিরে আসার পর থেকে গ্রামের পরিস্থিতি এবং পরিবেশ দেখে তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পরেন।পুরো গ্রাম ঘুরে তিনি তার পরিচিত কাউকে দেখতে পান না আর সেই কারণেই তিনি এই একাকিত্ব আর গ্রামটির এই নিস্তব্ধ রাতে দূর করতে গ্রামটিকে পুতুল গ্রামে পরিণত করেন।
তাহলে গ্রামের মানুষ কোথায় গেলেন?
জানা যায় ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি সময়ে জাপানের গ্রামের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাঁধ নির্মাণ করা হলে জলের প্রবল সংকট দেখা দিতে শুরু করে। ফলত, বেশিরভাগ মানুষই গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। যে কয়েকজন রয়ে যান তারা নিজেদের জলের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এছাড়াও এই গ্রাম থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা পথ অতিক্রম করে কোনও দোকান এবং হাসপাতালে পৌঁছতে হয়। এই সমস্ত সুযোগ- সুবিধার অভাবের কারণেই গ্রামের সমস্ত পরিবার অন্যত্র স্থানান্তর হতে বাধ্য হয়। বর্তমানে গ্রামের জনসংখ্যা মাত্র ২৫ থেকে ৩০ জন।
কীভাবে এই পুতুল তৈরি করা হয়-
সুকিমি পুতুলগুলি তৈরি করতে বিভিন্ন রকম জিনিস ব্যবহার করেন। যেমন- নমনীয় কাপড়, চোখের জন্য বিভিন্ন রকম বোতাম, মাথার জন্য এক ধরনের তুলো, শরীরের জন্য কাঠ এবং রোল কাগজ ইত্যাদি। প্রধানত দান করা পুরনো কাপড় জামা দিয়ে পুতুলগুলি তৈরি করা হয়। এ ছাড়াও এই গ্রামের পূর্ব বাসিন্দাদের যে সমস্ত জিনিসপত্র ঘরে পরে রয়েছে সেগুলি সংগ্রহ করেও তিনি পুতুল তৈরি করেন। প্রিয় মানুষগুলিকে দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপ দূর করার জন্য সুকিমি গ্রামের বিভিন্ন মানুষের একটি করে প্রতিবিম্ব তুলে ধরেছেন এই পুতুলগুলোর মধ্য দিয়ে। আকর্ষণীয় একটি বিষয়বস্তু হল এখানে এসে আপনি পুতুল বানানো একেবারে হাতে-কলমে শিখতে পারবেন। এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাসের প্রতি চতুর্থ বুধবার সুকিমি আগ্রহী পুতুল প্রেমীদের জন্য পুতুল বানানো শেখান। তবে সেক্ষেত্রে আপনাকে সঙ্গে আনতে হবে পুতুল তৈরির সমস্ত সরঞ্জাম।
পুতুল গ্রামে কী কী দেখতে পাওয়া যায়-
• বিদ্যালয় - একজন শিশুর প্রাথমিক জ্ঞান বিস্তারের জন্য শিক্ষা আবশ্যিক। কিন্তু এই গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ পড়ে থাকায় সেটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে সুকিমি ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকরূপী বেশ কিছু পুতুল তৈরি করেছেন, যাদের দিয়ে সুন্দরভাবে তিনি বিদ্যালয়টি সাজিয়ে তুলেছেন। শুধু তাই নয়, তাদের সামনে খাতা, বই, পেন, পেন্সিল সমস্ত কিছু রাখা আছে এবং প্রত্যেকটি পুতুলকে বিভিন্ন আঙ্গিকে বানানো হয়েছে; যেমন- কেউ আঁকছে, কেউ লিখছে, কেউ তাকাচ্ছে আবার কেউ দুষ্টুমি করছে। আর এই সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়ে একটি বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ তৈরি করেছে এই বৃদ্ধা। শিক্ষার্থী ছাড়াও রয়েছে তাদের পিতামাতা এবং বিদ্যালয়ের অন্য সব চরিত্ররাও।
• কমিউনিটি সেন্টার - পুতুল বলে কী তাদের বিয়ে জন্মদিন হতে নেই? এটা কিন্তু একদম ঠিক নয়। তাই সেই কথা মাথায় রেখেই সুকিমি একটি কমিউনিটি সেন্টারে গড়ে তুলেছেন এই গ্রামে, যেখানে পুতুলদের বিয়ে, জন্মদিনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করা হয়। ওয়েস্টার্ন এবং জাপানি পোশাকে তাদের সজ্জিত করে তোলা হয়।
• গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থানরত পুতুল - এই গ্রামটিতে ঘুরতে গেলে আপনি প্রতিটি বাড়িতে মাঠে-ঘাটে গাছপালার ক্ষেত-খামারে বিভিন্ন রকমের কুকুর দেখতে পাবেন তারা কেউ কাজ করছে কেউ গল্প করছে কেউ বা নিজের প্রিয় মানুষটির জন্য অপেক্ষারত।
গ্রামটির অবস্থান-
জাপানের চারটি সবচেয়ে বড় দ্বীপ হল হোনশু, হোক্কাইডো কুশু এবং শিকোকু। এই চারটি দ্বীপের মধ্যে সবচেয়ে বৃহত্তর দ্বীপ হল শিকোকু। দ্বীপটির আয়তন প্রায় ১৮ হাজার ৮০০ বর্গ কিলোমিটার শিকোকুর ল্যারের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদী উপত্যকার উপর অবস্থিত নাগোরো গ্রামটি পুতুল গ্রাম নামে পরিচিত।