ভারতের দক্ষিণপ্রান্ত ভ্রমণের ইচ্ছা বহু বছর ধরেই মনে লালন করে রেখেছিলাম । তাই আগস্ট মাসের ছুটিকে সঙ্গী করে বেরিয়ে পড়লাম দক্ষিণাত্যের বিখ্যাত হিল স্টেশন উটির উদ্দেশ্যে । ছোট থেকেই উটি শৈল শহর সম্পর্কে অনেক ভ্রমণ বৃতান্ত শুনেছিলাম, তাই এই শহরকে কেন্দ্র করে মনের মধ্যে নানান সন্দেহ উঁকিঝুঁকি দিত । নীলগিরি পর্বত, সুসজ্জিত চা বাগান, আর উটির বিখ্যাত হোমমেড চকলেট এই সব কিছুর সাথে পরিচিত হতে ব্যাকপত্তর গুছিয়ে বেরিয়েই পড়লাম ।
প্রথমদিন
প্রথমেই জানিয়ে রাখি উটি ভ্রমণের জন্য একটা উইকএন্ডই যথেষ্ট । আর এই বছরের ১৫ই অগাস্ট দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার, মাঝে শুক্রবারটি ছুটি নিয়ে পৌঁছে গেলাম উটি । সকাল সকাল বেরিয়ে পৌঁছে গেলাম কলকাতা বিমানবন্দর । কারণ আমার বিমানের সময় ছিল ১২.৩০ মিনিটে । প্রায় ৩ ঘণ্টা দূরত্ব অতিক্রম করে বিকাল ৪টে নাগাদ পৌছালাম কোয়েম্বাটুর বিমানবন্দর । বিমানবন্দর থেকে গাড়ি ভাড়া করে প্রায় ঘণ্টা তিনেক দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম উটি । সারাদিন অনেকটা জার্নি হওয়ার জন্য আজকের দিনটা হোটেলেই কাটালাম । সন্ধেবেলায় চা সহযোগে স্ন্যাক্স খেয়ে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে খোশমেজাজে গল্প করতে করতে দেখলাম রাত হয়ে গেছে । তাই রাতে ডিনারে সাউথ ইন্ডিয়ান খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম ।
দ্বিতীয় দিন
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম উটির বিখ্যাত ভ্রমণ স্থান দর্শনে ।প্রথমেই পৌঁছে গেলাম দোদাবেত্তা পিক দর্শনে । সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৬৫২ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত নীলগিরি পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ দোদাবেত্তা শৃঙ্গ । এখানকার টেলিস্কোপ হাউস থেকে দূরের দোদাবেত্তা শৃঙ্গকে দেখে মনে হল ইশ! যদি আমিও সেই শৃঙ্গ ছুঁতে পারতাম তাহলে কী ভালোই না হতো! এই স্থানটি থেকে সম্পূর্ণ উটির একটা সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করা যায় ।দোদাবেত্তা থেকে গাড়ি চেপে ১০ মিনিট দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম টি ফ্যাক্টরি ভিউ পয়েন্ট । এক কথায় বলতে গেলে এটি চা এর মিউজিয়াম । চা বাগান দর্শনের সাথে সাথে কিভাবে চা তৈরি করা হয় সেটাও দেখতে পাবেন ।
আপনি যদি অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন তাহলে রোপওয়ের সাহায্যে পাখির চোখের ন্যায় চা বাগান দর্শন করতে পারেন । চা বাগানের একটি বিপণি থেকে চা খেয়ে এগিয়ে চললাম বোটানিক্যাল গার্ডেন দর্শনের উদ্দেশ্যে । এই বাগানটি বেশ সুসজ্জিত রং বেরঙের ফুল এবং নানান ছোট বড়ো গাছের সমারোহে এই বাগানটি নির্মাণ করা হয়েছে । এই বাগান দর্শনের পর মিনিট দশেক দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম রোজ গার্ডেন । এই গোলাপের বাগানে মোট ৪০০০ প্রজাতির গোলাপ গাছ আছে । তবে এই রোজ গার্ডেন দর্শনের জন্যই মার্চ থেকে জুন মাসটি আদর্শ ।রোজ গার্ডেন দর্শন করে যাত্রাপথের একটি রেস্তরাঁতে লাঞ্চটা সেরে নিলাম ।
খাওয়া দাওয়া সেরে প্রায় ৩০ মিনিট পথ অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম উটি লেক দর্শনে । পর্যটনের উদ্দেশ্যে এখানে এ্যামিউসমেন্ট পার্ক এবং লেকে বোটিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছে । উটি লেকে অনেকটা সময় সময় কাটিয়ে ফেললাম ।এখন হোটেল ফেরার পালা । হোটেল ফেরার পথে দর্শন করে নিলাম এলখিল মন্দির । এই মন্দিরে স্থাপিত আছেন মুরুগান, তাই বাইরে থেকে ভগবান মুরুগানের বিশাল স্ট্যাচু চোখে পড়ে । স্থানীয় মানুষদের জানতে পারলাম এখানে প্রতিবছর জানুয়ারি -ফেব্রুয়ারি নাগাদ বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । চারিদিকে পাহাড় এবং বড় বড় পাইন গাছে ঘেরা মন্দিরের দৃশ্যটা অসাধারণ লাগল। উটিতে প্রথম দিনের ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় মুগ্ধ হয়ে ফিরে এলাম হোটেলে । রাতের ডিনার সেরে দ্বিতীয় দিনের ভ্রমণের পরিকল্পনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম ।
তৃতীয় দিন -
উটি ভ্রমণের আজই অন্তিম দিন ।তাই ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম সিক্সথ মাইল। প্রায় ৩০মিনিট পথ অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম সিক্সথ মাইল। চারিদিকে সবুজ পাহাড় এবং জলপ্রপাতের প্রবাহমানতা মনকে জাস্ট ছুঁয়ে গেল । বেশ খানিকক্ষণ প্রকৃতির কোলে সময় কাটিয়ে পৌঁছে গেলাম নাইনথ মাইল । প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি এই দুইটি স্থানই ছবির শুটিং স্পট হিসেবে পরিচিত । নাইনথ মাইল থেকে মিনিট পনেরো গাড়ি চেপে পৌঁছে গেলাম পয়করা লেক ।এর মাঝে যাত্রাপথে লাঞ্চটা ও সেরে ফেললাম ।এই লেকের দৃশ্যপটটি বেশ মনোমুগ্ধকর । পর্যটনের উদ্দেশ্যে এখানে বোটিং এবং হর্স রাইডিং এর ব্যবস্থা আছে ।
মূলত পয়করা নদীকে কেন্দ্র করেই লেক নির্মিত হয়েছে । পায়ে একটু হেঁটে গিয়ে দর্শন করে নিলাম পয়করা জলপ্রপাত । পয়করা লেকের প্রাকৃতিক দৃশ্য এর স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে পৌঁছে গেলাম চকলেট ফ্যাক্টরি । এই চকলেট ফ্যাক্টরিটি থেকে আপনি হোমমেড চকলেট নির্মাণের প্রক্রিয়াটি শিখে নিতে পারেন । প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি এখানকার চকলেট গুলির স্বাদ বাজার চলতি চকলেটগুলির থেকে এক্কেবারে আলাদা । যেহেতু আমি চকলেট প্রেমী মানুষ তাই এখান থেকে চকলেট কিনতে ভুললাম না । এরপর উটির বিখ্যাত তিব্বত মার্কেট থেকে ভ্রমণের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কিছু শীতের পোশাক কিনে ফিরে এলাম হোটেলে । আজকের ভ্রমণ এখানেই শেষ ।
চতুর্থ দিন -
এবার উটিকে বিদায় জানিয়ে কলকাতা ফেরার পালা । সকাল ১২টা নাগাদ কোয়েম্বাটুর বিমানবন্দর থেকে বিমান ।তাই সকাল ৭টা নাগাদ বেরিয়ে ১০টায় পৌঁছে গেলাম বিমানবন্দর । এখানেই কিছু খাওয়া দাওয়া সেরে বিমানে উঠে পড়লাম । আবার ও তিনঘণ্টা যাত্রা করে ভ্রমণের নানান রঙীন স্মৃতি মনে নিয়ে ফিরে এলাম কলকাতায় ।