সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে সূতানুটি, গোবিন্দপুর আর কলকাতা নামে তিনটি ছোট্ট গ্রামের একসঙ্গে মিলে পথ চলা শুরু। তিন শতাব্দী পর আজ কল্লোলিনী তিলোত্তমা কলকাতা এক সমৃদ্ধশালী মহানগরী। কিন্তু দিনের বেলায় ঝাঁ চকচকে এই শহরের আশ্রয় ছেড়ে আমাদের সঙ্গে আজকে চলুন মাঝরাতের ছায়াঘেরা পথে। আলো আঁধারি অলিগলির মধ্যে পাবেন এক অন্য কলকাতা, যেখানে শোনা যায় শতাব্দিপ্রাচীন অশরীরী আত্মাদের আর্তনাদ; গা ছমছমে পরিবেশে অনুভব করা যায় সাবেকি কলকাতার ভূতুড়ে ইতিহাস। খুব সাবধান, হৃদয়ের দুর্বলতা থাকলে রাত বাড়ার পর কলকাতার এই কটি জায়গায় না যাওয়াই ভাল।
১. রাইটার্স বিল্ডিং
১৭৮০ সালে স্থাপিত রাইটার্স বিল্ডিং প্রায় ১৭০ বছর ধরে ছিল ব্রিটিশ প্রশাসনের কেন্দ্রস্থল। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সদর দপ্তর হিসেবেও রাইটার্স খ্যাত। কিন্তু তাও, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হলেই ফাঁকা হতে থাকে রাইটার্স। কর্মচারীরা চার দিকের আলো থাকতে থাকতে নিরাপদে বেরিয়ে পড়তেন। অনেকে এমনকি দিনের বেলাতেও এড়িয়ে চলেন রাইটার্স বিল্ডিংয়ের কিছু বিশেষ ব্লক। বছরের পর বছর বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা কিছু ঘরে আজও কেউ ঢোকেন না... এমনটাই শোনা যায় বারবার। গল্পের শুরু ১৯৩০ সালে, বিপ্লবীত্রয়ী বিনয়, বাদল এবং দীনেশের হাতে অত্যাচারী ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্ণেল সিম্পসনের মৃত্যুর পর থেকেই। রাত বাড়লেই নাকি আজও সিম্পসনের অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায় রাইটার্সের আনাচে কানাচে। কর্মচারীরা শুনতে পান পদধ্বনি, চিৎকার কিংবা গা ছমছমে অট্টহাসি। তাই কখনও রাইটার্স বিল্ডিংয়ে গেলে সন্ধে নামার আগেই বেরিয়ে পড়বেন কিন্তু।
২. পুতুলবাড়ি
পুতুলবাড়ি নামটি যত মিষ্টি, এই বাড়ির ইতিহাস ততোধিক ভয়ানক। সাবেকি উত্তর কলকাতার ইতিহাসের সাক্ষী এই বাড়িটি আজ কলকাতার অন্যতম অভিশপ্ত বাড়ি বলে খ্যাত। গঙ্গারধারে অবস্থিত এই পোড়োবাড়িটি দেখলে মনে হবে এই বুঝি ভেঙে পড়ল। বাড়ির একতলায় গেঞ্জির কারখানায় হাতে গোনা কয়েকজন কাজ করেন। আর বন্ধ দোতলার ঘর গুলোতে সাজানো আছে অসংখ্য পুরনো পুতুল। এককালে বাবুদের আসর বসত এই দু'তলায়, হতো বাইজিদের নাচ। জানা যায়নি সেই বাবুদের লালসতৃপ্তির শিকার হয়েছেন কত অগুনতি মহিলা এই বাড়িতে। তাদের হাসি, চিৎকার, পায়ের নুপুরের ঝংকারের আওয়াজ ভেসে আসে সূর্য ডুবলেই।
৩. হেস্টিংস হাউস
ব্রিটিশ ইতিহাস ও স্থাপত্যের আরেক নিদর্শন হল মধ্য কলকাতার হেস্টিংস হাউস। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের নিজস্ব বসতবাড়ি আজ দিনের বেলায় মহিলাদের কলেজ হিসাবে পরিচালিত হলেও, রাত বাড়লেই কিন্তু ছাত্রীরা পা বাড়ায় বাড়ির দিকে। অনেকেই দেখেছেন ঘোড়া চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সাদা চামড়ার এক ব্যক্তি। অনেকেই মনে করেন এটি স্বয়ং ওয়ারেন হেস্টিংসের অতৃপ্ত আত্মা। হেস্টিংস হাউসের মাঠে নাকি ফুটবল খেলতে গিয়ে মারা যান এক কিশোর। রাতের বেলায় নাকি শোনা যায় সেই কিশোরের হাসি, ফুটবল খেলার আওয়াজ। অপঘাতে মৃত কিশোর, না শেষ বয়সে অবসাদগ্রস্ত হেস্টিংসের আত্মা, কে ঘুরে বেড়ায় হেস্টিংস হাউসের অন্ধকারে? এই রহস্যের খোঁজ আজও অধরা।
৪. ন্যাশনাল লাইব্রেরি
১৮৩৬ সালে স্থাপিত অলিপুরের জাতীয় গ্রন্থাগার কলকাতা তথা ভারতের গর্ব। তবে বহু দশক ধরেই ন্যাশনাল লাইব্রেরির বদনাম ভূতুড়ে হওয়ার। নিঝুম নিস্তব্ধ পরিবেশে বহু পাঠকেরই মনে হয়েছে কোনও পারলৌকিক শক্তি ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। অনেকে মনে করেন এটি লেডি মেটকাফের আত্মা। আবার ২০১০ সাল নাগাদ খুঁজে পাওয়া যায় একটি বন্ধ ঘর, যেটিকে দেখে শুনে মনে হয়েছে ব্রিটিশ আমলে টর্চার চেম্বার। ২০১২ সালে রক্ষণাবেক্ষণ কার্যের সময় রহস্যজনক ভাবে মারা যান ১২ জন শ্রমিক। অশরীরী উপদ্রব তার পর থেকে আরও বেড়েছে। তাই এই লাইব্রেরি থেকে বই ধার করলে, সময়ে ফিরিয়ে দেওয়াই ভাল, কি বলেন?
কলকাতার পুরনো ভূতুড়ে বাড়িগুলোর কথা শুনে কি নিরাপদ বোধ করছেন? ভাবছেন আধুনিক কলকাতার বুকে নেই কিছু অশুভ?
৫. উইপ্রো অফিস
চেনা কেউ সেক্টর ফাইভের উইপ্রো অফিসে কাজ করে? জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন যে ওই অফিসের টাওয়ার থ্রি-এর তিন তলায়ে কেউ যায় না কেন। লোকমুখে শোনা যায় যে উইপ্রো অফিসের মাটিতে এককালে ছিল কবরস্থান। বহু অনৈতিক কার্যকলাপ, এমনকি খুন জখমও হয়েছে সেই কবরস্থানে। হয়তো সেই সকল মৃত আত্মারাই আজ বারে বারে ফিরে আসে সেই একই জায়গায়। সন্ধের পরে শোনা যায় আর্তনাদ, অশরীরী আওয়াজ। তাই অফিস কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে রেখেছেন নির্দিষ্ট ফ্লোরগুলি, যার করিডোর থেকে প্রতিরাতে ভেসে আসে প্রতিশোধকামী আক্রোশ।
৬. রয়্যাল টার্ফ ক্লাব
মানুষ ভূত কলকাতায় কম নেই ঠিক, কিন্তু পশু ভূত? বিধাননগরের রয়্যাল টার্ফ ক্লাবে দেখা পাবেন সাদা ঘোড়ার ভূতের। ১৯৩০-এর দশকে টার্ফ ক্লাবের রেসিং ট্র্যাক মাতিয়ে রাখত পার্ল নামের এক ধবধবে ফর্সা ঘোড়া। কিন্তু বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমে আসে তার ক্ষিপ্রতা ও গতি। পার্লের শেষ রেসে বাজিতে অনেক টাকা হারিয়ে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন পার্লের মালিক জর্জ উইলিয়ামস। পরদিন সকালে আস্তাবলের পাশে পাওয়া যায় পার্লের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ। সেই পার্ল ছুটে চলেছে আজও। মৃত্যুকে অতিক্রম করে সে যেন জিতে নিতে চাইছে তার শেষ রেস।
৭. রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশন
খাস কলকাতার বুকে মেট্রো স্টেশনের মতো জনবহুল এলাকায় আর কিসের ভয়। কিন্তু রাত বাড়লেই রবীন্দ্র সরোবর স্টেশনে ঘনিয়ে আসে ভয়াল অশরীরীদের আনাগোনা। বহু আত্মহত্যার সাক্ষী থাকা এই স্টেশনে হয়তো রাত বাড়লে ফিরে আসে তাদেরই প্রেতরূপ। শেষ ট্রেনের বহু যাত্রী দেখেছেন হঠাৎ করে ছায়ামূর্তিদের আগমন আর মিলিয়ে যাওয়া। এমনকি ট্রেন লাইনে ছায়ামূর্তিদের দেখে মাঝপথে ট্রেন থামিয়েছেন একাধিক ড্রাইভার। শেষ ট্রেনে বাড়ি ফেরার ঝুঁকি না নিলে এই মেট্রো স্টেশনটি এড়িয়ে চলতে পারেন।
৮. পার্ক স্ট্রিট কবরস্থান
দক্ষিণ পার্ক স্ট্রিট সেমেটারী কলকাতার ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষী। দেশি বিদেশি বহু মানুষের কবর আজ এই কবরস্থানে মাটি চাপা পড়ে, সময় আর অবহেলার অগোচরে। কিন্তু দিনের বেলাতেও শান্ত নিঝুম এই কবরস্থানে গেলে অনুভূত হবে অলৌকিক কোনো উপস্থিতি। ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে খ্যাত এই কবরস্থানে কিন্তু মাঝে মধ্যেই দেখা গেছে আত্মাদের। কখনও গ্রূপ ফটোতে দেখা গেছে আবছায়া ভূত। কখনো স্বচক্ষে ভূত দেখে হাঁপানিতেও আক্রান্ত হয়েছেন অভাগা ট্যুরিস্ট। তাই যেতে হলে যান দিনের বেলায়, থাকুন শ্রদ্ধাশীল এবং সূর্য ডোবার আগেই বেরিয়ে আসুন এই ভূতুড়ে জায়গাটি থেকে।
৯. নিমতলা শ্মশানঘাট
কলকাতার ইতিহাসের মতোই প্রাচীন উত্তর কলকাতার নিমতলা শ্মশানঘাট। সম্ভবত কলকাতার প্রাচীনতম শ্মশানও বটে। সর্বদা এক গা ছমছমে ভয়াল পরিবেশের মাঝে এই এলাকার কুখ্যাতি সকলের পরিচিত। শুধু ভূতপ্রেতের উপদ্রব নয়, শোনা যায় পূর্ণিমা, অমাবস্যা বা কালিপুজোর রাতে আঘোরী সন্ন্যাসীদের আনাগোনা বেড়ে যায় এখানে। মৃতদেহ নিয়ে তন্ত্রসাধনা, চিতায় জ্বলন্ত মৃতদেহ থেকে হাড় ও মাংস নিয়ে বিভিন্ন আচারে ব্যবহার করা, এমনকি ভক্ষণ করাও তাদের তন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রেতসাধনায় সিদ্ধহস্ত আঘোরী সাধুদের ধারে কাছে যেতে না চাইলে, নিমতলা শ্মশানে রাত কাটানো থেকে দূরে থাকুন।
১০. হাওড়া ব্রিজ
কলকাতার ভূতুড়ে বাড়ির ভয়ে ভাবছেন পালিয়ে গিয়ে রেহাই পাবেন? খবরদার, মাঝরাতের হাওড়া ব্রিজ দিয়ে কিন্তু যাবেন না। ১৯৪৩ সালে জনগণের জন্য ব্রিজটি খুলে দেওয়ার পর আজ অবধি বহু মানুষ এই সেতু থেকে গঙ্গার জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। মল্লিকবাজারের ঘাটের কুস্তিগীররা মনে করেন গভীর রাতে ফিরে আসে অপঘাতে মৃত সেই লোকগুলোর ভূত। জলের উপরে দেখা যায় ডুবতে থাকা হাত সাহায্য চাইছে। সাহায্য করতে গিয়ে ডুবেও গেছেন বহু মানুষ। আবার সাদা শাড়ি পরিহিত এক মহিলাকেও দেখা গেছে এখানে। কাঁদতে কাঁদতে সেই শ্বেতবস্ত্রা নারী ডাকবে আপনার নাম, এগিয়ে গেলেই মৃত্যু অবধারিত।
(মানুষের মনে অলৌকিক কল্পনার প্রসার ঘটানো এই লেখার উদ্দেশ্য নয়... লোকমুখে শোনা বিভিন্ন গল্প কথার উপরে ভিত্তি করেই রচনাটি লেখা হয়েছে।)