বাঙালি মধ্যবিত্তের ঘরে যখন নতুন ছোট্টো অতিথির আগমন ঘটে, তখন বাড়ির মা, জেঠিমা বা ঠাকুমারা তাদের পুরনো শাড়ি বা পুরনো বস্ত্র দিয়ে কাঁথা তৈরি করতে শুরু করে। তারা মনে করেন এই নরম কাপড় দিয়ে নিজের হাতে তৈরি কাঁথার উপর বাড়ির ছোট্ট সদস্য খুব নিশ্চিন্তে তার ঘুমের সময়টুকুকে উপভোগ করতে পারবে। শুধু এই সময়ে নয় অনেক বাড়িতে শীতকালে গায়ে বিভিন্ন বস্ত্র পরিধান করার জন্যও দিদিমা- ঠাকুমারা বাড়ির ছাদে বসে রোদে পিঠ দিয়ে সেগুলি নিয়ে নানারকম কারুকার্য করতে শুরু করেন। গ্রাম বাংলার দিকে এখনও যা বর্তমান। প্রত্যন্ত গ্রামে একটু ঘুরে আসলে দেখা যাবে আজও তাদের বাড়িতে এই কাঁথা স্টিচ শিল্পটির রমরমা চোখে পড়ে। তবে কাঁথা স্টিচের বেশ কিছু ধরন রয়েছে; যেমন- নকশি কাঁথা ( কবি জসীমউদ্দীনের লেখা ‘নকশি কাঁথার মাঠ’ নামক কাব্যগ্রন্থ থেকে এরকম নামকরণ এসেছে), লহরী কাঁথা, পাড়তোলা কাঁথা, আসন কাঁথা, রুমাল কাঁথা, শুজনি কাঁথা, লেপ কাঁথা দস্তরখান ইত্যাদি।
আজ আমরা কথা বলব কাঁথা স্টিচের তৈরি কিছু জনপ্রিয় শাড়ি সম্বন্ধে। কোথায়, কীভাবে তৈরি করা হয় এই শাড়ি? সেই সব কিছু নিয়েই আজ আমাদের বিষয় কাঁথা স্টিচ শাড়ি, যা হয়ে উঠেছে গ্রাম বাংলার অন্যতম লোকশিল্প।
কাঁথা স্টিচ শাড়ি তৈরির পদ্ধতি:-
প্রথমে তাঁত মেশিনের মূল শাড়িটি বোনা হয়। তারপর তাঁতীদের কাছ থেকে সেই কাপড় এনে তাতে বিভিন্ন ধরনের নকশা আঁকা হয়; যেমন- ফুল, পাতা, গাছ, পদ্ম, জাহাজ, সূর্য, চন্দ্র, ম্যান্ডেলা, রথ, কলসি, নৌকো, বিভিন্ন প্রাণী, মাছ, পালকি, আয়না ইত্যাদির অবয়ব তৈরি করা হয়। তারপর সেগুলির উপর রঙিন সুতা দিয়ে সেলাই করে তৈরি করা হয় কাঁথা স্টিচের শাড়ি। এই সেলাই পদ্ধতিকেই মূলত কাঁথা স্টিচ বলা হয়ে থাকে। কাঁথা স্টিচ সেলাই নির্ভর করে নকশার উপর।
বিভিন্ন শাড়িতে কাঁথা স্টিচের প্রকারভেদ:-
প্রধানত তিন ধরনের কাঁথা স্টিচের শাড়ি আমরা দেখতে পাই। যথা- তসর, সিল্ক এবং সুতি। সুতির শাড়িতে এই নকশা খুব হালকা করা হয়। তাই সেখানে কাঁথা স্টিচের কাজ কম থাকে। সুতির কাঁথা স্টিচ শাড়ি তৈরি করতে সময় লাগে ১৫ দিন থেকে ১ মাস।
অপরদিকে, তসরের এবং সিল্কের ক্ষেত্রে নকশা ভারী হয় অর্থাৎ গোটা শাড়ি জুড়ে এই নকশা অঙ্কিত থাকে। তাই সেই তুলনায় দেখতে গেলে তসর ও সিল্কের শাড়ির উপর করা কাঁথা স্টিচ কিন্তু বেশ ঘন হয়। সেক্ষেত্রে এটি তৈরি করতেও বেশ খানিকটা সময় লেগে যায়। মোটামুটি ৪/৫ মাস। তবে তসর এবং সিল্কের কাঁথা স্টিচ শাড়ির চাহিদা কিন্তু বরাবরই বেশি।
বিভিন্ন ধরনের কাঁথা স্টিচ শাড়ি:-
• হ্যান্ডলুম কাঁথা স্টিচ শাড়ি
• আসাম সিল্ক কাঁথা স্টিচ শাড়ি
• কটন খেশ কাঁথা স্টিচ শাড়ি
• কাঁথা স্টিচ সিল্ক শাড়ি
• এমব্রয়ডারি কাঁথা স্টিচ লিনেন শাড়ি
• ব্যাঙ্গালোর কাঁথা স্টিচ শাড়ি
কাঁথা স্টিচ শাড়ি যত্ন:-
• কাঁথা স্টিচ শাড়ি সাধারণত বাড়িতে পরিষ্কার করা উচিত নয়। এক্ষেত্রে বড় কোনও ভাল দোকান থেকে তা কাচিয়ে রাখাই শ্রেয়।
• প্লাস্টিক প্যাকেট সিল্কের কাঁথা স্টিচ শাড়ি রাখা উচিত নয়।
• তসর এবং সিল্কের কাঁথা স্টিচ শাড়ি অর্থাৎ যেগুলোর কাজ খুব ভারি হয়, সেগুলিকে হ্যাঙ্গারে বা কোথাও না ঝুলিয়ে আলগা করে ভাঁজ করে রাখাই উচিত।
• যে বাক্সে শাড়িটি রাখা হবে সেই বাক্সে ন্যাপথলিনের পরিবর্তে দারুচিনি বা লবঙ্গ রেখে দেওয়া দরকার, যাতে পোকা-মাকড় থেকে শাড়িটিকে সংরক্ষণ করা যায়।
• একভাবে শাড়ি বেশিদিন রেখে দিলে কাঁথা স্টিচের সুতোগুলি ছিঁড়তে শুরু করে। তাই বছরে অন্তত দু’বার শাড়ি খুলে অন্যরকমভাবে ভাঁজ করে রাখা উচিত।
এই শাড়ি তৈরির কিছু বিখ্যাত জায়গা:-
ভারতবর্ষ এবং বাংলাদেশে সমানভাবে কাঁথা স্টিচের শাড়ি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ভারতবর্ষে বীরভূম জেলার অন্তর্গত বোলপুর এবং শান্তিনিকেতন অঞ্চলে এই কাঁথা স্টিচ শাড়ি বুননের এক বিশাল প্রক্রিয়া দেখতে পাওয়া যায়। সাধারণত শান্তিনিকেতনে শনিবারে অনুষ্ঠিত খোয়াই-এর হাটে এই কাঁথা স্টিচ শাড়ির সম্ভার নিয়ে পসরা বসান পল্লী গ্রামের গৃহবধূরা। বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রামে এখন মহিলাদের প্রধান জীবিকা হয়ে উঠেছে এই কাঁথা স্টিচ। এখানকার তৈরি কাঁথা স্টিচ শাড়িগুলি পাঞ্জাব, মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোর, দিল্লি প্রভৃতি জায়গায় রপ্তানি করা হয়। তবে বাংলাদেশের যশোর জেলাতেও কিন্তু কাঁথা স্টিচের জনপ্রিয়তার সমান ভাবে লক্ষণীয়।