গৌরবময় উপনিবেশিক স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন রয়েছে শ্রীরামপুর অঞ্চলটি জুড়েই, প্রাচীন ডেনিশ, ব্রিটিশ ও বাঙ্গালি সংস্কৃতির একধরনের মিশেল এক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়। পুরনো ও নির্জন আলস্যে মাখা এই স্থানটি কলকাতা থেকে একদিনের জন্য ঘুরে বেড়িয়ে আসার জন্য একদম যথার্থ বলতে পারি।
ইতিহাস
১৬৬৮ সালে ডেনিশরা সর্বপ্রথম হুগলি নদীর তীরে এসে বসবাস স্থাপন করে এবং ১৭৭৫ সাল নাগাদ শ্রীরামপুরে তাঁদের বাণিজ্য শুরু করার ও কারখানা স্থাপন করার অনুমতি পায়। তুলো ও মশলার ব্যবসা সেইসময় বেশ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এই দু'ধরনের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ডেনিশরা এখানে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে এবং আস্তে আস্তে ছোট্ট গ্রামটিকে একটি সমস্ত রকমের সুযোগ সুবিধা সমেত একটি সুন্দর মফসসলে পরিণত করে।
সেই সময় শ্রীরামপুরের নাম ছিল ফ্রেদেরিক্সনগর। এই নামকরণ করা হয়েছিল তৎকালীন ডেনমার্কের রাজা পঞ্চম ফ্রেদেরিকের নামানুসারে। ব্রিটিশ শাসনের ঠিক বিপরীতে ডেনিশরাও স্থানীয় মানুষদের তাঁদের শাসনব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থাতে সমানভাবে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিয়ে থাকতেন। ফলস্বরূপ মফসসলে নানাবিধ সংস্কৃতির মেলবন্ধনে অষ্টাদশ শতাব্দীতে সাংস্কৃতিক নবজাগরণের একটি পীঠস্থানে পরিণত হয়েছিল।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শ্রীরামপুরের এই ইউরোপিয়ান স্থাপত্যগুলি ভগ্নদশায় চলে যেতে থাকে। কিন্তু ভারত সরকার ও ডেনিশ শিল্প ও সংস্কৃতি দপ্তর-এর সাহায্যে বেন্তে ওয়লফ এবং মণীশ চক্রবর্তী এই ঐতিহ্যবাহী বাড়িগুলির পুনর্নির্মাণ করে অতীতের গৌরব ফিরিয়ে আনতে তৎপরতা দেখান।
এই সুন্দর ডেনিশ শহরে কি কি করবেন
দেখে আসুন সেন্ট ওলাভ গির্জা
২০০ বছরের পুরনো এই গির্জাতে ঘণ্টা যদিও আর বাজেনা কিন্তু এখন ও এখানে ডেনমার্ক-নরওয়ের রাজা সপ্তম ক্রিস্টিয়ানের মনোগ্রাম দেখতে পাবেন। খুব সম্প্রতিকালে এই গির্জাটির পুনর্নির্মাণ করে গাঢ় বাদামি রং করা হয়েছে। ওই রঙের স্লেটের জানালা এবং সমতল ছাদের মাধ্যমে এর আকর্ষণীয় গঠন আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এখানকার নিঃশব্দতার স্রোতে গা ভাসিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখে নিন এই গির্জাটিকে যা অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে।
মুগ্ধ হন শ্রীরামপুরের রাজবাড়ির রাজকীয়তায়
বিখ্যাত গোস্বামী রাজবাড়ির মালিকানা যাওয়ার কথা ছিল এক সম্ভ্রান্ত বাঙ্গালি ব্যবসায়ীর হাতে। ডেনিশরা যখন এই শহর ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তখন উনি ডেনিশদের থেকে এই রাজবাড়ি কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই প্রস্তাব খারিজ করে দেওয়া হয়। অন্যান্য প্রাসাদের মতই এই রাজবাড়ির ওপরেও নিওক্লাসিকাল স্থাপত্যশৈলীর সুস্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায়, যেমন স্লেটের জানালা, অরনেট ব্রাকেট, ছাদের সুনিপুণ পুরু কারুকার্য এবং রাজকীয় স্তম্ভ। বহুল প্রচলিত এবং জনপ্রিয় একটি বাংলা ছবি 'ভূতের ভবিষ্যৎ'-এর শুটিংও এই রাজবাড়িতেই হয়েছিল।
সুরাপানের আমেজ নিতে ঘুরে আসুন ডেনমার্ক ট্রাভেন থেকে
মনীশ চক্রবর্তী দ্বারা পুনর্নির্মিত আরেকটি হেরিটেজ বিল্ডিং বর্তমানে একটি রেস্তোরাঁ ও বেকারি তথা ক্যাফেতে পরিণত হয়েছে, যেখানে আপনি পেয়ে যাবেন ডেনিশ খাবারের সঙ্গে সঙ্গে আরও নানান ধরনের পদ। উঁচু সিলিং, খোলামেলা, প্রশস্ত ঘরের মধ্যে আপনি কাটিয়ে দিতে পারেন এক রাত।
কোথায় থাকবেন
প্রায় ২৩০ বছরের পুরনো ডেনমার্ক ট্রাভেনে এক রাত কাটানোর ভাড়া পড়বে প্রায় কমপক্ষয়ে ৪৩৮০ টাকার মতো। আরও একটু কম বাজেটের মধ্যে থাকার জায়গা হচ্ছে স্পট অন, 49450 সিলভার উডস যেখানে এক রাতের ভাড়া ৮০০ টাকা মত। এছাড়াও আপনি কমলা ইন ডানকুনিতেও থাকতে পারেন। এখানকার ভাড়া প্রতি রাত ১৮০০ টাকা।
কীভাবে যাবেন
সড়কপথে : কলকাতা থেকে ৩০ কিমি দূরে শ্রীরামপুরে ড্রাইভ করে যেতে মোটামুটি এক ঘণ্টা মতো লাগে। এছাড়া কলকাতা থেকে শ্রীরামপুরের বাস ও পাওয়া যায়।
রেলপথে : কলকাতা থেকে শ্রীরামপুর যাওয়ার জন্যও অনেক লোকাল ট্রেন পাওয়া যায়। অথবা আপনি ব্যারাকপুরে নেমে লোকাল ফেরি নিয়ে পৌঁছে যেতে পারেন শ্রীরামপুরে।
বিমানপথে : কলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে শ্রীরামপুরের দূরত্ব প্রায় ৩৪ কিমি মত।
অক্লান্ত পুনর্নির্মাণকরনের মাধ্যমে শ্রীরামপুর শহর নতুন করে তার পুরনো হারিয়ে যাওয়া শক্তিশালী ঐতিহ্য ও ইতিহাস ফিরে পেয়েছে। শহরটি আবার যেন তার নিজের সংরক্ষিত স্থাপত্যশৈলী এবং উত্তরাধিকারকে সঙ্গে নিয়ে নতুন প্রাণশক্তি মেতে উঠেছে। তাই হাতে অল্প হলেও সময় করে ঘুরে আসা যেতেই পারে।