কলকাতা শহরটা বাঙালিদের কাছে অনেকটা স্বপ্নের নগরীর মতো । প্রত্যেকটা মানুষ এই শহরকে নিজের মতো করে কল্পনা করে, আর তাই এই শহরের সঙ্গে মানুষের আশা -আকাঙ্ক্ষার অন্ত নেই । বিশেষত বাঙালির সঙ্গে এই শহরের কোথাও যেন নাড়ির টান রয়েছে । বাঙালিরা বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, এই শহরে ফিরে আসার পর অনুভব করেন যেন মাতৃক্রোড়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন । সুতরাং বাঙালি হৃদয়ের সঙ্গে কলকাতা শহর যে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ, সেটা আলাদা করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হয় না।
ট্রাফিকের ক্যাকোফনি থেকে রাজনৈতিক তরজা, চায়ের দোকানের ঠেক থেকে বৃষ্টিভেজা দিনে তেলেভাজার দোকানে ভিড় কিংবা দুর্গাপুজো বা পার্কস্ট্রিটে খ্রিষ্টমাসের হুল্লোড়, কলকাতা ছাড়া কী এইসব সম্ভব হত? নিন্দুকেরা যে যাই বলুক মিলেনিয়াম পার্কের প্রেম থেকে কফি হাউসের ইনফিউসন চুমুক সমস্ত কিছু কলকাতা ছাড়া জাস্ট অসম্ভব ।
এবার কলকাতা শহরের চিরাচরিত কিছু মুখ্য যানবাহন সম্পর্কে সংক্ষিপ্তসারে জেনে নেওয়া যাক -
১. ট্রাম -
কলকাতা শহরের সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের সঙ্গে একই সূত্রে বাঁধা যানটি হল ট্রাম। ১৯৭৩ সালে কলকাতায় প্রথম ট্রামের আবির্ভাব ঘটে। প্রায় ৩.৯ কিমি ট্রামওয়ে সার্ভিসটি শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়াম ঘাট পর্যন্ত প্রশস্ত ছিল । পরবর্তী কালে ১৮৮২ সালে ঔপনিবেশিক যুগে ঘোড়ায় টানা ট্রামগাড়ির প্রচলন ঘটে । এরপর ১৯০২ সালে এশিয়ার প্রথম ইলেকট্রিক ট্রামগাড়ির প্রচলন ঘটে কলকাতায়। প্রথম দিকে এসপ্ল্যানেড থেকে খিদিরপুর পর্যন্ত রুটে ট্রামের যাত্রা শুরু হয়, তারপর কলকাতায় রাজপথ জুড়ে ট্রামের বেশ রমরমা ছিল ।
বর্তমানে দ্রুতগতির যানের আধিক্য- এর কারণে এই শহরে ট্রামের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে । তবে ঐতিহ্যবাহী এবং পরিবেশবান্ধব এই যানটি একমাত্র কলকাতা শহরেই উপস্থিত ।
২. হাতে টানা রিক্সা -
কলকাতা শহরের বিশেষ যানবাহনের মধ্যে হাতে টানা রিক্সা অন্যতম । আপনি কিজানেন কলকাতা শহরের এই যানটি প্রায় ১৩০ বছরের প্রাচীন । একটা সময় এই হাতে টানা রিক্সা মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের পদমর্যাদাকে চিহ্নিতকরণের জন্য নিম্নবিত্ত মানুষদের এই রিক্সা বহনের দায়িত্ব নিতে হত । হতদরিদ্র মানুষগুলো পেটের তাগিদে দুপয়সা রোজগার করার জন্য কায়িক পরিশ্রম করতে পিছুপা হননি ।এই হাতে টানা রিক্সা মূলত উত্তর কলকাতা অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যেত । আজও বড়োবাজার এবং উত্তর কলকাতার কিছু অংশে হাতে টানা রিক্সার সন্ধান পাওয়া যায় ।
৩.হলুদ ট্যাক্সি -
ব্যস্ততম শহর কলকাতার দৃষ্টান্তমূলক যানের অপর নাম হলো হলুদ ট্যাক্সি। হিন্দুস্তান মোটরস্ নির্মিত ক্লাসিক আম্বাসাডর ট্যাক্সির কলকাতার রাজপথে প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৫৮ সালে ।হলুদ ট্যাক্সি চেপে কলকাতা শহর ভ্রমণের অনুভূতিটা একমাত্র কলকাতাবাসীরাই বোঝেন ।বর্তমানে ওলা উবেরে আধিক্য হলুদ ট্যাক্সির জনপ্রিয়তা কেড়েছে ।
৪. ঘোড়ার গাড়ি বা এক্কাগাড়ি -
ছেলেবেলায় বর্ণপরিচয়ে পরিচিত হওয়া এক্কাগাড়ির বাস্তব ধারণা পেয়ে যাবেন খাস কলকাতাতেই । ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে এখানে ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার শুরু হয়। নিস্তব্ধ রাতে ঘোড়ার গাড়ি চেপে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ময়দান, ফোর্ট উইলিয়াম ভ্রমণের অভিজ্ঞতাটা কিন্ত একেবারেই অন্যরকম ।
রাজকীয়ভাবে নির্মিত এই ঘোড়ার গাড়ি একসাথে ৫- ৬জন মানুষের ভ্রমণের উপযোগী । বর্তমানে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য বাহ্যিকভাবে প্রাচীনত্বকে বজায় রাখলেও,অন্দরসজ্জায় শীততাপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র বা আধুনিকতার আলতো প্রলেপ লাগানো হয়েছে ।
৫. দোতলা বাস -
৯০ এর দশকে কলকাতা শহরে দোতলা বাস বেশ জনপ্রিয় ছিল । তবে ১৯২৬ সালে প্রথম কলকাতার রাস্তায় এই বাসের দেখা পাওয়া যায় । শেষপর্যন্ত ২০০৫ সাল পর্যন্ত সময়ে কলকাতাবাসীর এই দোতলা বাসে চেপে শহর পরিক্রমার সুযোগ ছিল । তারপর বেশ কয়েক বছর কলকাতা শহরের মানুষ দোতলা বাসের ধারণাটা প্রায় ভুলতে বসেছিলেন ।
গত বছর ২০২০ সালে দূর্গাপুজো পরিক্রমার উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃপক্ষ প্যান্ডেল হপিং এবং পর্যটনের স্বার্থে দোতলা বাসের শুভ উদ্বোধন করেন । ৫১টি বসার জায়গা সহযোগে ছাদ খোলা এই বাসে CCTV , অটোমেটিক প্রবেশদ্বার, ইত্যাদি আধুনিকতার মোড়ক চোখে পড়ে । শুধু কলকাতা ভ্রমণ নয়, এই বাসে চেপে আপনি কলকাতার ঐতিহ্যবাহী বিল্ডিং গুলোর সাথে পরিচয় করার সুযোগ পেয়ে যাবেন ।
নস্টালজিয়া, অভিমান, ভালোবাসা, আবেগ সমস্ত কিছুই যেন কলকাতা শহরের সাথে অঙ্গাঙ্গিকভাবে যুক্ত । চলুন একটা মজার খেলা শুরু করি, আচ্ছা বলুন তো কলকাতা বলতে আপনি কী বোঝেন? আমরা আপনার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম!