শ্রাবণ মাসের শুক্লা একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত পাঁচ দিন ধরে বৈষ্ণব মতে অনুষ্ঠিত হয় ঝুলন যাত্রা। রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ যুগলকে দোলনায় বসিয়ে বিভিন্ন রকম আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই ঝুলনযাত্রা পালিত হয়।
ঝুলন যাত্রার প্রাককথা-
ঝুলন শব্দের অর্থ হল ‘দোলনা’। তাই এই উৎসবে রাধা-কৃষ্ণকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে দোলনায় বসিয়ে পুজো করা হয়। মূলত দ্বাপর যুগে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা কেন্দ্র করেই বৃন্দাবনের ঝুলন উৎসব শুরু হয়, যা পরবর্তীকালে মথুরা-বৃন্দাবনের সুপ্রাচীন উৎস হিসেবে দেখা দেয়।
ঝুলন উৎসবের দিন রাধা-কৃষ্ণকে পূর্ব পশ্চিম দিকে মুখ করে বসিয়ে দোলনায় দোলানো হয়। উৎসব পালনের দিনগুলিতে ২৫-৩০ রকমের ফলের নৈবেদ্য, সুজি, লুচি নিবেদন করা হয়। ময়ূরের পালক, ফুলের সাজ, নতুন বস্ত্রে রাধা-কৃষ্ণকে সাজিয়ে তোলা হয়। ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে গায়ত্রী মন্ত্র জপ ও গীতা পাঠ করে ঝুলন যাত্রার পূজা সম্পন্ন করা হয়।
ঝুলন যাত্রা শিল্প ও নিপুণতা-
আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলের জন্যই ঝুলন কিন্তু এক অন্যরকম অনুষ্ঠান। রাধা-কৃষ্ণের ফুলের সাজ, আলোকসজ্জা এবং অলংকারের সজ্জিত পোশাক ছাড়াও এই অনুষ্ঠানের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হল মাটির পুতুল দিয়ে বিভিন্ন রকমের পরিবেশ ফুটিয়ে তোলা। বাড়ির পুরনো ন্যাকড়াগুলিতে কাদা লাগিয়ে প্রথমে পাহাড় তৈরি করা হয়। তারপর বালি দিয়ে খেলার মাঠ, গ্রামের রাস্তা ফুটিয়ে তোলা হয়। পাহাড়ের কোলে গাছের পাতা দিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরি করা হয়। এছাড়াও শহরের পরিবেশ দেখানোর জন্য বিভিন্ন রকমের গাড়ি- ঘোড়া সাজানো হয়। গ্রামের দৃশ্য দেখাতে হলে কোথাও কোথাও নীল রং দিয়ে নদী তৈরি করা হয় এবং পুতুল দিয়ে গ্রামের মেয়েদের নির্ধারিত করা হয়। আসলে ঝুলন যাত্রার মাধ্যমে ভিন্নরকম সামাজিক প্রেক্ষাপটগুলিকে তুলে ধরা হয়।
তবে শুধুমাত্র মথুরা-বৃন্দাবন নয়, বিভিন্ন জায়গার ইসকন মন্দির, মায়াপুর, নবদ্বীপ এমনকি কৃষ্ণনগর শহরেও খুব বড় করে ঝুলন উৎসব পালন করা হয়।
কৃষ্ণনগরের ঝুলন যাত্রা-
কৃষ্ণনগরের অন্যতম প্রাচীন ঝুলন যাত্রা হল চেৎলাঙ্গিয়া বাড়ির ঝুলন যাত্রা। বিশাল দালান যুক্ত নাটমন্দিরের ভিতরে রুপোর দোলনায় গোপালকে দুলতে দেখা যায়। এছাড়াও পিছনের ঠাকুরের সিংহাসনের রয়েছে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি। বাড়ির ভিতরে খুব সুন্দরভাবে বিভিন্ন রকম মাটির পুতুল দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয় এই অনুষ্ঠানের আসল বিষয়বস্তুকে। কোথাও গ্রামের চিত্র, কোথাও চিড়িয়াখানা, কোথাও মন্দির, কোথাও আবার রেলস্টেশন তৈরি করা হয়। এইসব কিছু ছাড়াও রয়েছে খেলার মাঠ, বিয়ে বাড়ি, ভূতের কীর্তন, সাঁওতালি অঞ্চল ইত্যাদি। কৃষ্ণনগর ছাড়াও আশেপাশের অঞ্চল থেকে এই চেৎলাঙ্গিয়া বাড়ির ঝুলন যাত্রা দেখতে অনেক দর্শনার্থী ভিড় করেন।
২০২০ সাল থেকে করোনার আবহে প্রায় ১৬০ বছর পুরোনো এই ঝুলন যাত্রা কিছুটা বাধার সম্মুখীন হলেও পুজো সঠিক সময়ে সমস্ত বিধিনিষেধ মেনেই পালন করা হয়। মূল মন্দিরে প্রবেশের জন্য ভক্তদের হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং দূরত্ব বজায় রেখে দেখার সুযোগ করেও দেওয়া হয়।