প্রতিটি রাজবাড়ি কোনও না কোনও গল্প বহন করে। ইতিহাসের পাতায় সেই গল্পগুলি কখনও হয়ে ওঠে রঙিন, আবার কখনও পুরাতন জীর্ণতা প্রাপ্ত হয়। এর আগে আমরা যে সমস্ত রাজবাড়ির ইতিহাস তুলে ধরেছি, তা হয়তো সকলের জানা। তবে এবার আমরা একটু অন্যরকম কিছু জানার আশায় হঠাৎ করে পৌঁছে যাই শান্তিনিকেতন। বোলপুর শান্তিনিকেতন যে শুধুমাত্র বসন্ত উৎসব কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্য বিখ্যাত এমন নয়। এখানে এমন অনেক অজানা জায়গায় রয়েছে, যার সম্বন্ধে হয়তো অনেকের তেমন ধারনা নেই। ঠিক সেইরকম একটি অচেনা জায়গা হল সুরুল রাজবাড়ি। কী আছে সেখানে? জানতে নিশ্চয়ই খুব ইচ্ছা করছে! জানার জন্য পড়তে থাকুন।
বীরভূম জেলায় অবস্থিত প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো সুরুল সরকার বাড়ি, যা সুরুল রাজবাড়ি নামে পরিচিত। অনুমান করা হয়, অষ্টাদশ শতাব্দীতে বর্ধমানের বাঁকা নদীর ধারে নীলপুর গ্রামে ভরত চন্দ্র ঘোষ(সরকার) নামে এক অভিজাত ধার্মিক ব্যক্তি বাস করতেন। ভরত চন্দ্র এবং তাঁর স্ত্রীর বহু প্রচেষ্টার পরেও তাঁদের কোন সন্তান না হওয়ায় তাঁরা বারাণসীতে তীর্থযাত্রা করবেন বলে মনস্থির করেন। যাবেন বলে মনস্থির করেন। কিন্তু বারাণসী যাওয়ার পথে একটু যাত্রাভঙ্গ করার জন্য তাঁরা এসে পৌঁছায় এই বীরভূমের সুরুলে। এখানে এসে তাঁরা তাদের গুরুদেব বাসুদেব ভট্টাচার্যের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। এই বাড়িতে শ্যামসুন্দর নিত্য পূজিত হতেন। তাই দেখে ভরত চন্দ্র সরকার এবং তাঁর স্ত্রী শ্যামসুন্দরের পুজো করতে শুরু করেন এবং তাঁরা একটি পুত্র সন্তান লাভ করেন, যার নাম রাখেন কৃষ্ণহরি। শোনা যায়, এই পরিবারের আসল পদবী কিন্তু সরকার নয়। ইংরেজদের কাছ থেকে এই পদবী তাঁরা পেয়েছিলেন। কৃষ্ণহরির পুত্র শ্রীনিবাস ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা করে বিশাল প্রতিপত্তি করেছিলেন। এদের মূলত নীল চাষ এবং জাহাজের পাল তৈরি ব্যবসা ছিল।
সুরুল রাজবাড়ির পুজো:
ভরত চন্দ্র সরকারের আমল থেকে এই রাজবাড়ির পুজো শুরু হয়। এই বছর পুজোটির আনুমানিক বয়স প্রায় ২৮৬ বছর। চতুষ্কোণ রাজবাড়ির মধ্যস্থিত নাটমন্দির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই সুরুল রাজবাড়ির পূজো কিন্তু কলকাতার বেশ কিছু বনেদি পরিবারের পুজোর সমতুল্য। তবে এই রাজবাড়ির এই পুজোর মূলত দুই ভাগে করা হয়। বড় তরফ এবং ছোট তরফ। তবে দুই তরফের পুজোয় কিন্তু এখনও সাবেকিয়ানা বর্তমান। আলাদা ট্রাস্ট রয়েছে। ছোট তরফের বাড়িতে গেলে এখনও সেই পুরনো প্রাচীন টেরাকোটা মন্দির দেখতে পাওয়া যায়, যেগুলি এই রাজবাড়ির পূর্বপুরুষদের সময় চিহ্নিত করে। এই মন্দিরগুলির কাজ দেখার জন্য বহুদূর থেকে মানুষজন এখানে ঘুরতে আসেন। কৃষ্ণহরির পুত্র শ্রীনিবাস ৫ খিলান বিশিষ্ট ঠাকুরদালান মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন ১৮ হাজার টাকায়। রথের দিন এখানে কাঠামো পুজো হয়। তারপর শুরু হয় প্রতিমা নির্মাণ। একচালার প্রতিমার অঙ্গে থাকে ডাকের সাজ। ৫ প্রজন্ম ধরে মৃৎশিল্পীরা এই বাড়ির প্রতিমা নির্মাণ করে আসছেন। সুরুল রাজবাড়ি দুর্গা প্রতিমাকে সাজানো হয় ৩০০ বছরের পুরনো অস্ত্রশস্ত্র এবং এই বাড়ির পারিবারিক অলংকার সামগ্রী দিয়ে। পুজার নিয়মনীতির মধ্যে অন্যতম হল মা এখানে পূজিত হন বৈষ্ণব মতে। তাই অন্ন ভোগের পরিবর্তে চিড়ে, নাড়ু, ফল, মিষ্টি দিয়ে ভোগ নিবেদন করা হয়।
পুজোর ক’টা দিন রাজবাড়ি সেজে ওঠে সেজে ওঠে বৈদ্যুতিক আলোতে নয় রেড়ির তেলের প্রদীপে। ঠাকুরের নাট মন্দিরকে সাজানো হয় বেলজিয়াম থেকে নিয়ে আসা লন্ঠনে ঝাড়বাতিতে। রাজবাড়িতে পুজোর তিনদিন বলি দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। সপ্তমীর দিন চালকুমড়ো, অষ্টমীতে পাঁঠা এবং নবমীতে চালকুমড়া এবং আখ বলি দেওয়া হয় রাজবাড়িতে নারায়ন অধিষ্ঠিত। তাই নারায়ণের সামনে বলি দেয়া নিষিদ্ধ। সেই জন্য বলির সময়টুকু নারায়ণকে নিয়ে যাওয়া হয় অন্য মন্দিরে। বলি হয়ে যাওয়ার পরে পুনরায় তাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। পূর্বে রাজবাড়ির পুজোয় বসত যাত্রাপালা এবং তা দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন ছুটে আসত। সময় বদলায়। তাই এখন অতটা লোকের সমাগম হয় না এই রাজবাড়িতে। তবে এই রাজবাড়ির প্রতিটি সদস্য দেশে-বিদেশে যেই প্রান্তেই থাকুক না কেন পুজোর সময় তারা প্রত্যেকে ফিরে আসে নিজের বাড়িতে। সরকার রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে পূর্ব দিকে গেলে রয়েছে টেরাকোটার তৈরি একটি পুরনো শিব মন্দির।
আকর্ষণীয় বিষয়বস্তু:-
• সুরুল রাজবাড়ির সঙ্গে ঠাকুর বাড়ির সম্পর্ক বেশ নিবিড়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই রাজপরিবারের এসে বেশ কিছুদিন সময় কাটিয়েছেন এছাড়াও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনের বেশ কিছু জমি রাজপরিবার তরফ থেকে প্রদান করা।
• এই রাজবাড়িতে বেশকিছু চলচ্চিত্র শুটিং চলেছে। তার মধ্যে অন্যতম হল- হীরকজয়ন্তী, প্রতিশোধ, দেবদাস, পদি পিসির বর্মীবাক্স, বলিদান, সমাপ্তি, গয়নার বাক্স ইত্যাদি।
• ধারাবাহিকগুলির মধ্যে অন্যতম হল- তুমি রবে নীরবে, লালু ভুলু, রাখিবন্ধন এবং রানী রাসমণি।
পথনির্দেশ:-
বোলপুর শান্তিনিকেতন থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই সুরুল রাজবাড়ি। টুকটুক করে যেতে সময় লাগে ৩০ মিনিট।