করোনা আবহ এবং বিশ্বমহামারীর এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে আমরা প্রত্যেকেই গৃহবন্দি। এক অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি প্রায় সকলেই। কিন্তু এই পরিস্থিতি ক্ষণস্থায়ি, প্রকৃতি সুস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আশা করি আমরা ফিরে যেতে পারব আমাদের ‘ওল্ড নর্মাল’ লাইফে... বিশ্বমহামারীর এই কঠিন পরিস্থিতি আদতে আমাদের শিখিয়েছে প্রকৃতির সংসর্গ, শিখিয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা স্থাপনের একান্ত ব্যক্তিগত অবসর খুঁজে নেওয়ার পথ। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এর দৌলতে অনেকেই হয়তো কর্পোরেট ব্লিডিং-এর শীততপনিয়ন্ত্রিত ঘরের জানালা দিয়ে নয়, প্রকৃতিকে এখন দেখতে পারছেন নিজেদের ব্যালকনি বা ছাদ থেকেই। এই একান্ত অবসরের জন্য আলাদা করে ঘড়ির কাঁটায় সেকেন্ড, মিনিটের হিসেব চাওয়া হয় না, বরং প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার ফলে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই মিনিমালিস্টিক চিন্তাধারা ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে। যা আমাদের হয়তো নিয়ে যাবে অজানা, অচেনা সুন্দর কোনও এক ভবিষ্যতের দিকে।
তাই এই মরসুমে, বহুল প্রচলিত পর্যটন কেন্দ্রগুলোর সংসর্গ দূরে রেখে প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় নৈকট্য স্থাপনের চেষ্টা করুন। লোকায়ত বা লোকজ সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে নিজের মনন এবং চিন্তাশীলতার প্রকাশ ঘটিয়ে দেখতে পারেন। স্থানীয়দের সঙ্গে থাকুন, তাঁদের লোকজ ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করুন। লোকজ সংস্কৃতির এমন আস্বাদ আপনি পেতে পারেন সিকিমের বেশ কয়েকটি গ্রামে। প্রগতিশীল এবং উন্নয়নশীল সংস্কৃতি থেকে গ্রামগুলো যেন এক একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এমনই বেশ কয়েকটি গ্রামের সন্ধান রইল আপনাদের জন্য।
দারাপ
৫,৭৯০ ফুট উচ্চতায়, পেলিং থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে দারাপ গ্রামে মূলত লিম্বু সম্প্রদায়ের মানুষেরা বাস করে থাকেন। ‘দারাপ’ শব্দটির উৎপত্তি একটি লিম্বু শব্দ 'ট্যান-লপ' থেকে। যার অর্থ হল সমতল ভূমি। ধানের ক্ষেত এবং এলাচ গাছের বিস্তীর্ণ আবাদক্ষেত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, সমগ্র গ্রামটি জুড়ে।
কী কী করতে পারেন
পশ্চিম সিকিমে অবস্থিত এই গ্রামের হালকা সবুজ ঘাসের ক্ষেত্রভূমি আদতে আপনাকে, পনির প্রক্রিয়াজাতকরণ, ক্ষেতে বাগান করা বা একটি গাভী চারণক্ষেত্র এবং দুগ্ধশিল্পের বিবিধ ক্রিয়াকলাপের জন্য ইঙ্গিত দেয়। আপনি প্রকৃতির এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন বেশ সচ্ছন্দে। ইউমা ধ্যান কেন্দ্রে যাওয়ার পাশাপাশি, প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন লিম্বু ঐতিহ্যবাহী বাড়ি ঘুরে দেখতে পারেন এই সুযোগেই। টার কোটেড সিলিংস (ক্রমাগত জ্বলন্ত আগুনের একটি পরিণতি) এবং শক্ত কাদা মেঝে সহ, এই প্রাচীন কাঠামোটি লিম্বু সম্প্রদায়ের সুপ্রাচীন লোকজ ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে, যা নেপালি লিম্বু উপজাতির বংশ পরম্পরায় প্রেরণ করা হয়েছিল।
থাকবার ব্যবস্থা- চেরি ভিলেজ হোমস্টে রিসর্ট

পথনির্দেশিকা:
দারাপ গ্যাংটক থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই অবস্থায় নিকটতম বিমানবন্দরটি হল বাগডোগরা। গ্রামটিতে পৌঁছানোর জন্য নিতে পারেন শেয়ার জিপ বা সিকিমের যে কোনও বড় শহর থেকে সংরক্ষিত ট্যাক্সি। মোটামুটি সুপরিবহন ব্যবস্থা এখানে রয়েছে।
কিউজিং বা কেয়াজিং, ভুটিয়া উপভাষার অর্থ 'গম ক্ষেতের জমি'। এটি 'ল্যান্ড অফ চেস্টনাট ফরেস্ট' বা সোসিং নামেও পরিচিত। প্রায় ৪৬০০ ফুটেরও বেশি উচ্চতায় অবস্থিত কিউজিং। এটি রাঙ্গলা থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দক্ষিণ সিকিমের লেগশিপ-রাংলা হাইওয়ে ধরে সহজেই আপনি এই গ্রামে পৌঁছে যেতে পারবেন। গ্রামটি জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্য। প্রাচীন ভুটানি উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষও এই গ্রামে বসবাস করে থাকেন। এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই হলেন বৌদ্ধ বাসিন্দা। মাউন্ট নরসিং এবং মাউন্ট কাবরু ঘেরা এই গ্রামে প্রায় ৩০টিরও বেশি বাড়ি রয়েছে। গ্রামটিতে রয়েছে সমৃদ্ধ এলাচ বনের আবরণ।
কী কী করতে পারেন
গ্রামটিতে পৌঁছে আপনি আশেপাশের অসংখ্য বৌদ্ধমঠগুলি ঘুড়ে দেখতে পারেন। তাশাইডিং, ম্যাংব্রু, পেমায়াংটসে, রোলং, ডলিং এবং বন মনেস্ট্রিগুলো এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আপনি স্থানীয় উদ্ভিদ এবং প্রাণী পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। পাহাড়ি উপত্যকায় দেখা মিলতে পারে নাম না জানা এমন বহু পাখির সন্ধানও। ভাগ্যে দেখা মিলতে পারে লেজবিশিষ্ট মাইজর্নিস বা বাদামী কাঠের পেঁচা।
পথনির্দেশিকা:
গ্যাংটকের মূল শহর থেকে প্রায় ৭৬ কিলোমিটার দূরে এই গ্রামটি অবস্থিত। নিকটতম বিমানবন্দরটি রয়েছে বাগডোগরাতে। নিকটতম রেলস্টেশন (নিউ জলপাইগুড়ি রেলস্টেশন) বা এনজেপি ১৬০ কিলোমিটার অদূরেই অবস্থিত। কিউজিং-এ পৌঁছনোর জন্য, মেলি চেকপোস্ট থেকে বেরিয়ে, আপনি রাভাংলা এবং নামচির পথ নিতে পারেন।
কাবি
উত্তর সিকিমের এই ঐতিহাসিক গ্রামটিতে লেপচা ও ভুটিয়া সর্দারদের বন্ধুত্বের চিত্র আপনার চোখে পড়বে। রয়েছে পাথরের বিবিধ স্মৃতিস্তম্ভ। এই থেকে আমরা সিকিমের মানুষের জাতিগত সম্পর্কের কথা বিশেষভাবে জানতে পারি। এখানকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হ'ল কাবি লুংটসক সাইট, যেখানে লেপচা এবং ভুটিয়ার মধ্যে ব্লাড ব্রাদারহুডের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। উত্তর সিকিম মহাসড়কের ফোদং-এর নিকটে এই ঐতিহাসিক স্থানটিকে ঘিরে একটি ঘন বনাঞ্চল রয়েছে।
কী কী করতে পারেন ?
বিভিন্ন প্রজাতির পাখির সন্ধান পাওয়া যাবে এই গ্রামে, রয়েছে প্যারিয়া কাইট, ক্রেস্ট সর্প ইগল, শাহিন ফ্যালকন, রুফস-গলার পার্টিজ, কালো ব্রেস্টড পারটবিল এবং গ্রে-ক্রাউন্ড প্রিনিয়া ইত্যাদি।
পথনির্দেশিকা:
গ্রামটি উত্তর সিকিম হাইওয়েতে এবং গ্যাংটক থেকে প্রায় ১৭কিমি দূরে অবস্থিত। নিয়মিত এখানে জিপ কাবি থেকে গ্যাংটক পর্যন্ত চলাচল করে। মিনিট ৪০-এর ড্রাইভেই আপনি কাবি পৌঁছে যেতে পারবেন।
পস্তঙ্গা গ্রাম, পূর্বসিকিম

পূর্ব সিকিমের এই বিস্ময়কর এই গ্রামটি, ৪৭০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। পাখি প্রেমীদের জন্য একটি আদর্শ স্থান রূপেও একে চিহ্নিত করা যায়। ব্লু মর্মন এবং মনার্ক প্রজাপতি সহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতিগুলো এখানে দেখা যায়। গ্রামটি এলাচ চাষের জন্যও বিশেষভাবে পরিচিত।
কী কী করতে পারেন ?
প্রাচীন ভুটানি এবং রাই বাড়িগুলি (জাতিগত নেপালি সম্প্রদায়) ঘুরে দেখতে পারেন। আশপাশের জলপ্রপাতগুলির সঙ্গে সঙ্গে দেখার জন্য রয়েছে এলাচ গাছের বিস্তীর্ণ বাগান। আর যারা একটু-আধটু অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী তাঁরা মালিঙ্গগো ট্রেইল হয়ে খেদি পৌঁছানোর জন্য বাঁশ গাছের ঘন বনের মধ্য দিয়ে ট্রেকিং করতে পারেন। সূর্যাস্তের মৃদু আলোয় প্রকৃতির মায়াময় ঐশ্বর্য উপভোগ করতে পারবেন এই অবকাশে।
থাকবার ব্যবস্থা: মালিঙ্গো হোমস্টে

পথনির্দেশিকা:
গ্যাংটক থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, এখান থেকে পস্তঙ্গা প্রায় দুই ঘণ্টার পথ, এমনটা বলা যেতে পারে।
৮৬১০ ফুট উচ্চতায় মনোরম নদীর ধারে অবস্থিত পাহাড়ি এই গ্রামটি বেশিরভাগ ভুটিয়াউপজাতি দ্বারা পরিবৃত (এটি লাচুঙ্গপাস নামেও পরিচিত)। লাচুং-এর পীচ, এপ্রিকট এবং আপেল বাগানের জন্যও সুপ্রসিদ্ধ।
কী কী করতে পারেন ?
ইয়ামথাং ভ্যালি এবং জিরো পয়েন্ট ঘুড়ে দেখার কথা অবশ্যই আপনার প্ল্যানিং-এর মধ্যে থাকা উচিত। লাচুং গোম্ফা ঘুরে দেখতে পারেন। এই গোম্ফার গায়ে সুপ্রাচীন কারুকার্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই। দশম বৌদ্ধ মাসের (ডিসেম্বর) ২৮তম এবং ২৯তম দিনে মঠটিতে একটি ধর্মীয় নৃত্য পরিবেশিত হয়ে থাকে। প্রসিদ্ধ উলের কার্পেট বানানোর পিছনে প্রক্রিয়াটি দেখতে আপনি কার্পেট বয়ন কেন্দ্রটিও দেখতে পারেন। শিংবা রোডোডেনড্রন অভয়ারণ্যটি প্রচুর পরিমাণে রডোডেনড্রন গাছ এবং ঝোপঝাড়ের জন্য পরিচিত, গ্রীষ্মেও এটি উন্মুক্ত থাকে। লাচুং যাওয়ার পথে লাচুং, লাচেন চুস এবং তিস্তা নদীর সঙ্গম দেখতে চুংথাং-এ থামুন। চুংথাং বিহারটি দেখুন এবং পবিত্র পাথর (নায়দো) পরিদর্শন করুন, যাতে গুরু পদ্মসম্ভাবার পায়ের ছাপ রয়েছে।
থাকাবার ব্যবস্থা: ইথো মেথো

পথনির্দেশিকা:
গ্যাংটক থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটারের দূরে অবস্থিত, তবে রাস্তার অবস্থা এখানে খারাপ। গাড়িতে গ্যাংটক থেকে লাচুং পৌঁছতে এখনও গাড়িতে প্রায় ৬ ঘণ্টা সময় লাগে।