ছোটবেলায় যখন ভূগোল পড়তাম, পড়ার বইয়ের মধ্যে ওই মহাকাশের ছবি দেখে মাঝে মাঝে মনে হত যদি কোনদিন এই মহাকাশে যেতে পারি তবে হয়তো জ্যোতিষ্কমন্ডলীগুলিকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে পারব। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম যে ওগুলোকে ছোঁয়া যায় না বরং তার থেকে বেশি অনুভব করতে হয়। তাই দেরি না করেই পড়ে এসে পড়ার ব্যাগটা কোনওরকমভাবে ঘরে রেখে দূরবীন নিয়ে ছুটে যেতাম রাতের আকাশের ঐ জ্যোতিষ্কমন্ডলীগুলো দেখার আশায়। এভাবে দেখতে দেখতে ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ যে কখন আমার ঘরের মধ্যে চলে এলো তা বুঝতেই পারলাম না। নিজের মোবাইল ফোন থেকে ইন্টারনেটের সাহায্যে তখন ক্রমাগত খুঁজতে থাকলাম কীভাবে তারাগুলির কাছে খুব সহজেই পৌঁছানো যায়। আর তা খুঁজতে খুঁজতে যা পেলাম, সেই তথ্যগুলি ‘তোমায় ছুঁতে চাওয়ার মূহুর্তরা/ কে জানে কি আবেশে দিশাহারা’-হয়ে পথ দেখাল!!!
এবার নিশ্চয়ই আপনারা ভাবছেন কী এমন জানতে পারলাম, যার জন্য মন পৃথিবী থেকে সোজা মহাশূন্যের পথে পাড়ি দিল! তবে এটুকু বলতে পারি আপনারাও খুব আশ্চর্য হবেন, যখন জানতে পারবেন জ্যোতিষ্কমন্ডলীকেও খুব কাছ থেকে দেখা সম্ভব। তাও আবার স্বচক্ষে। কীভাবে? চলুন তাহলে দেখে আসি।
অ্যাস্ট্রো ট্যুরিজম:-
জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং পর্যটন এই দুটি শব্দের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা অ্যাস্ট্রো ট্যুরিজম এমন একটি জিনিস যেখানে, রাতের আকাশের মহাজাগতিক বিষয়গুলি আলোক দূষণবিহীন রূপে ধরা দেয়। অ্যাস্ট্রো ট্যুরিজম ব্যাপারটি প্রথমদিকে বিদেশের মাটিতে পা রাখলেও বর্তমানে ভারতবর্ষেও তার প্রভাব দেখা দিয়েছে। ভারতবর্ষে অ্যাস্ট্রো ট্যুরিজমের জন্য নির্বাচিত বিভিন্ন স্থানগুলির মধ্যে প্রথম এবং প্রধান উল্লেখযোগ্য জায়গাটি হল-
লাদাখ:-
দূষণমুক্ত পরিবেশ হিসাবে লাদাখের জনপ্রিয়তা পর্যটকদের কাছে বরাবরই বেশি। তাই এবার এই স্বর্গের টুকরোসম লাদাখের সর্বোচ্চ উচ্চতম জায়গাগুলি থেকে তারা দেখার আনন্দ উপভোগ করার জন্য লাদাখ প্রশাসন অ্যাস্ট্রো ট্যুরিজম প্রকল্পের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
লাদাখের লেফটেন্যান্ট গভর্নর আর.কে মাথুর মনে করেন লাদাখের পরিবেশ দূষণ মুক্ত হওয়ার কারণে এখান থেকে সহজেই তারার সন্ধান পাওয়া যাবে। তাই পর্যটকদের কথা চিন্তাভাবনা করে তিনি পাঁচটি স্টারগাজিং জায়গা তৈরি করেছেন। তাঁরা আশেপাশে তাদের থাকবার ব্যবস্থার জন্য ধর্মশালাও রয়েছে। এই সমস্ত স্টারগাজিং জায়গাগুলিতে তারা দূরবীনের ব্যবস্থা করেছে। তাঁরা মনে করছেন, শহরের কোলাহল থেকে জনমানব শূন্য এই মুক্ত পরিবেশে এসে পর্যটকেরা তাঁদের নিজেদের জ্যোতির্বিজ্ঞান মূলক মনোভাব নিরবিচ্ছিন্নভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবেন।
এছাড়াও চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে রাজস্থানের দুটি নতুন অ্যাস্ট্রো ট্যুরিজম প্রকল্প নির্মাণ করা হয়েছে।
রাজস্থানের শিল্প ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বি ডি কল্লা-র নির্দেশনা এবং আর্ট এন্ড কালচার ডিপার্টমেন্টের পরিচালনায় গোলাপি শহর জয়পুরের মধ্য গড়ে উঠেছে নাইট স্কাই ট্যুরিজম নামক অ্যাস্ট্রো ট্যুরিজম প্রকল্প। কল্লা বলেছেন, এটি পর্যটকদের জন্য একটি নতুন অভিজ্ঞতা জন্ম দেবে এবং পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে এই রাজ্য আরও গতিশীল হবে। প্রধানত রাজস্থানের পর্যটন শিল্পকে বাঁচিয়ে তুলতে এবং আরও বেশি গতিময়তা দান করতে এই চিন্তাভাবনা করা হয়েছে। এছাড়াও এখানে বহুদিনের পুরনো একটি টেলিস্কোপের ব্যবস্থা রয়েছে, যার ফলে এই ব্যাপারগুলি আরও সহজ হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন মন্ত্রী কল্লা।
রাজস্থানের প্রধান দুটি অ্যাস্ট্রো ট্যুরিজম কেন্দ্র হল-
যন্তর মন্তর:-
রাজস্থানের রাজা দ্বিতীয় শাওয়াই জয় সিং এই জায়গাটি নির্মাণ করেন। বর্তমানে ইউনেস্কোর দ্বারা চিহ্নিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ জায়গাগুলির মধ্যে জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত বিষয়বস্তু পর্যবেক্ষণের জন্য এটি অন্যতম। এখানে ১৮ দশকের নির্মিত একটি পুরনো স্মৃতিস্তম্ভের ভিতরে রয়েছে প্রায় ১৯ রকমের জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি রয়েছে।
ঠিকানা-
গঙ্গোরী বাজার, জে.ডি.এ মার্কেট, পিংক সিটি জয়পুর, রাজস্থান ৩০২০০২।
জওহর কলা কেন্দ্র:-
এটি রাজস্থান সরকার দ্বারা নির্মিত একটি আর্ট সেন্টার। রাজস্থানী শিল্পকলার সংরক্ষণশালা। এখানে আটটি ব্লক, সংগ্রহশালা, ক্যাফেটেরিয়া, ছাত্রাবাস, স্টুডিও, এম্ফিথিয়েটার, আর্ট গ্যালারি প্রভৃতি রয়েছে।
ঠিকানা:-
জহরলাল নেহেরুর মার্ক কমার্স কলেজের সামনে ঝালানা দুঙড়ি, জয়পুর ৩০২০০৪।
নৈনিতাল, উত্তরাখণ্ড:-
‘আর্যভট্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অফ অবজারভেশন সাইন্সস’-এর সাহায্যে উত্তরাখণ্ডের টাকুলা ও দেবস্থলের গ্রামগুলিকে নির্বাচন করে এই প্রকল্প পরিকল্পনা শুরু করা হয়েছে। এআরআইইএস এবং নৈনিতালের পর্যটন সংস্থা থেকে জানানো হয়েছে এই দুটি গ্রাম এখানকার মূল হটস্পটের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। দেবস্থলে ভারতের বৃহত্তম দূরবীন রয়েছে, যার দৈর্ঘ্য ৩.৬ মিটার; যাকে দেব্স্থান অপটিক্যাল টেলিস্কোপ বলে চিহ্নিত করা হয়। সেক্ষেত্রে মনে করা হয়, এই টেলিস্কোপ বা দূরবীনের সাহায্যে এই স্থান থেকে জ্যোতিষ্কমন্ডলী পর্যবেক্ষণ করা বেশ সহজ হয়ে দাঁড়াবে। দ্যা টাইমস অফ ইন্ডিয়া সংবাদপত্রে এই স্থানের জেলা পর্যটক কর্মকর্তা অরবিন্দ গৌর বলেছেন- ‘আমরা চাই নৈনিতালে আসা মানুষেরা এই সমস্ত অভিজ্ঞতা গ্রহণ করুন। সেই জন্য আমরা যে সমস্ত গ্রামগুলিকে নির্বাচন করেছি সেগুলো এআরআইইএস এবং নৈনিতালের নিকটবর্তী। ফলত,নৈনিতালে বেড়াতে আসা পর্যটকেরা খুব সহজেই গ্রামগুলিতে এসে স্টারগাজিং-এর আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন।