মুঠোফোনের গ্যালারি জোড়া ছবির ভিড়ে টিমটিম করে জ্বলছে একটা ছোট উইকেন্ড ট্রিপের স্মৃতি। সহকর্মী বন্ধুদের সঙ্গে সেবার জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে তাজপুর ঘুরতে গেছিলাম। দীঘার খুব কাছেই অবস্থিত নির্জন এই সমুদ্র-সৈকতটি অনেকেরই বেশ পছন্দের। আমাদের পরিকল্পনামাফিক বরাদ্দ হল মোটে একটা রাত। শনিবার সকালে রওনা দিয়ে রবিবার রাত্রেই ফিরে আসা।
শনিবার ভোরবেলায় ট্রেন ধরে হাওড়া স্টেশন থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হল। গন্তব্য রামনগর স্টেশন। সেখান থেকে টোটো বা গাড়ি করে তাজপুরে পৌঁছনো। প্রায় সাড়ে তিনঘণ্টার ট্রেনযাত্রার স্মৃতি মনে তেমন দাগ কাটেনি। মুখোরোচক খাবার আর নানান গল্প আর সহযাত্রীদের বিবিধ মন্তব্যকে আত্মস্থ করতে করতেই কেটে গেল অনেকখানি সময়। নির্ধারিত সময়ে স্টেশনে নেমে গাড়ি খোঁজার পালা। আর তারইসঙ্গে গাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত বিচিত্র হিসেব-নিকেশের পদ্ধতি এবং আমাদের সঞ্চয়ী হয়ে ওঠার অভিপ্রায়। ঘুরতে যাওয়ার কিছুটা আনন্দ যেন এরই মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে। কাজেই সেক্ষেত্রে মাথার উপরে রোদ্দুরের তীর্যক ব্যাঙ্গোক্তিতেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায়। যথারীতি হোটেলে পৌঁছে চেকইনের পর্ব সেরে ফেললাম। সকালের ট্রেনে অবশ্য বেশ কিছু খেয়েছি কাজেই খিদেটা জাঁকিয়ে বসেওনি। তাই এবার সপ্তাহান্তিক ক্লান্তি ভুলতে ‘সমুদ্রস্নান’-এর দিকে আমাদের যাত্রা। পাঁচবন্ধুর মধ্যে আমি একেবারেই নারাজ সমুদ্রস্নানে। সবশেষে আমার ঠাঁই হল সমুদ্রের পাড়ে ঝিনুক খোঁজার খেলায়। বন্ধুরা শত চেষ্টা করলেও জলে আমাকে নামাতে পারেনি সেবার। আমি যে ভীষণই অপছন্দ করি সমুদ্রকে, সমুদ্রও বুঝি তা ধরে ফেলেছিল... ঢেউ-এর জল এসেও নতুন করে আমার সঙ্গে আতিথেয়তা দেখায়নি।
রোদ্দুরে তখন তটতীরবর্তী বালুকাবেলাও বেশ উত্তপ্ত। কোথাও আবার রোদ্দুরের সোনালি নকশায় শোভা পাচ্ছে বালি আর রঙিন কাঁকরের উপস্থিতি। ইতি-উতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ভাঙা কিংবা গোটা ঝিনুকের অংশবিশেষ। মধ্যে মধ্যে আবার সাক্ষাৎ মিলছে লাল কাঁকড়ার দলের। গর্ত থেকে একটুখানি উপরে উঠে, মুখটুকু দেখিয়েই আবারও তারা ঢুকে পড়ছে গর্তে। অদূরেই মাঝ সমুদ্রে দেখা যাচ্ছে মাঝিদের নৌকা। সমুদ্রের পাড়ে বসেই হাতে-গোনা ট্যুরিস্টদের বিচিত্র সব কাণ্ডকারখানা দেখতে দেখতেই বেলা প্রায় দেড়টা-দুটো বেজে গেল। মাথার উপরের চড়া রোদ আর সমুদ্রের নোনা হাওয়া, এই দুইয়ের যোগে খিদের তীব্রতা যে দ্বিগুণ হয় তা আর নতুন করে বলার দরকার নেই। সেই খিদে আরও চারগুণও হতে পারে যখন সমুদ্রের পাড়ে বসে মনে পড়ে যায়, হোটেলের লাঞ্চে আমাদের জন্য চিংড়ির মালাইকারি অপেক্ষা করে আছে। যাইহোক হোটেলে ফিরে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করেই একটা ভাতঘুমের সেরে নেওয়া। কারণ একটাই, হাতে সময় কম তাই দ্রুততার সঙ্গে আনন্দটুকু যতটা পুষিয়ে নেওয়া যায়.. এই আর কী!
ভাতঘুম শেষ করেই বিকেলের পড়ন্ত রোদটুকু গায়ে মেখে সমুদ্রের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ভাটার টানে সমুদ্র তখন অনেকখানি পিছিয়ে গেছে, কাদামাটিতে ভরে আছে সমুদ্রতটের একাংশ। মনে মনে আমি বিরক্তই হলাম। এ কেমন সৌন্দর্য হল! না কোনও ছাঁদ আছে, না কোনও ছিরি! এক্বেবারে বিশ্রী!
সূর্য তখন আস্তে আস্তে ঢলে পড়তে শুরু করেছে পশ্চিমের কোলে। ঝুপ করে নিশুতি রাতের অন্ধকার যেন নেমে এল। অনেকদূর থেকে সমুদ্রের মৃদু শোঁ-শোঁ শব্দটুকু শোনা যাচ্ছে মাত্র। গোটা চরজুড়ে এমনই অন্ধকার তখন যে, পাশের মানুষটাকেও ঠিক মতো চেনার উপায় নেই। দূরে একটা ঝুপড়িতে টিমটিমে আলো জ্বলছে। ওখানেই আমাদের রাতের খাবার আর বিকেলের টিফিন সেরে ফেলতে হবে। সত্যি বলতে কী, এত অন্ধকারে ভয় যে করছিল না তা কিন্তু নয়... তবে কোথাও যেন একটা অমোঘ টানও কাজ করেছিল ওইদিন।
বিস্তীর্ণ একটা সমুদ্রতট। থেকে থেকে বালি, কাঁকরের ঢিবি। প্রায় জনমানবশূন্য প্রান্তরে হাতে-গোনা কয়েকজন ট্যুরিস্ট মাত্র। নির্জন একাকিত্ব উপভোগের জন্য এর থেকে ভাল পাণ্ডব-বর্জিত পরিবেশ আর কী-ই বা হতে পারে? সময় যতই পেরোতে লাগল সেই টান, সেই মোহ আরও বাড়তে লাগল। আর ওই অন্ধকারেই আমাদের পাঁচবন্ধুর শুরু হল এক স্বল্পস্থায়ী রোমাঞ্চকর অভিযান। চর থেকে অদূরে জ্বলে থাকা উজ্জ্বল একটা আলোকে লক্ষ্য করেই সমুদ্রতট বরাবর হাঁটতে থাকলাম আমরা। আমাদের সঙ্গী হল মোবাইল ফোনের ফ্ল্যাশ লাইটগুলো। একটা দীর্ঘ সময় হাঁটার পরেও আমরা সেই আলোর কাছাকাছি পৌঁছতে পারলাম না। মনে হতে লাগল, ঘুটঘুটে ওই অন্ধকারে আমাদের হাঁটার ছন্দে তাল মিলিয়ে আলোটাও একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে। কাজেই নিরুপায় হয়ে বিফল মনোরথে আবারও আমাদের প্রত্যাবর্তন। ততক্ষণে সি-বিচের কাছাকাছি টিমটিমে আলোর ঝুপড়ি থেকে ভেসে আসছে দেশী মুরগীর ঝোলের গন্ধ। মাথার উপরে চাঁদ উঠেছে.. আকাশজোড়া তারাদের মেলা আর নিভুনিভু অন্ধকার ভেদ করে বালির চর জুড়ে জ্যোৎস্নার আলো-আঁধারি উপস্থিতি। সবকিছু মিলিয়ে একটা মনোরম পরিবেশ!
দীঘার খুব কাছেই ছোট্ট এই সমুদ্রসৈকতটির আপাতভাবে সৌন্দর্যের অতিরেক নেই। নিপাটই সাদামাটা। ছিমছাম একটা সমুদ্র। টিমটিমে হলুদ আলোয় বসে, সমুদ্রের মৃদুমন্দ গর্জন শুনতে শুনতে কাঁকড়ার ঝাল আর দেশী মুরগীর ঝোল উদরস্থ করে নিলাম ওইদিনের মতো। শহরের কোনও এক মাল্টিপ্লেক্সে বসে উইকেন্ড ‘সর্টেড’-এর চেয়ে এ এক অন্যরকম অনুভূতি বলতেই হবে। সমুদ্রের প্রতি কোনওদিনই বিশেষ কোনও টান নেই, বরাবরই সমুদ্রের মধ্যে আলাদা কিছু খুঁজে পায়নি, এই ট্রিপেও অন্তত সেইরকমটাই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সবটুকু যেন ভেস্তে গেল। সর্বমিলিয়ে একরাত্রির একটা ট্রিপ। কিন্তু ওই ট্রিপে ওই কয়েকটা ঘণ্টার নিকষ অন্ধকারে সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতে আমিও কিঞ্চিত তার রূপে মোহিত হয়েছিলাম। সন্ধেবেলায় আমার পায়ে তার জল ছুঁয়ে আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানোর ওমন অভিনব প্রচেষ্টায় আমি যার পর নায় আপ্লুত হয়েছিলাম বলতেই হবে।
বছর তিনেক আগের কথা, পাহাড় আর সমুদ্রের ভাল-মন্দ নিয়ে প্রবল বাগ্-বিতণ্ডার জেরে সমুদ্রপ্রেমী আমার এক বন্ধু বলেছিল “সমুদ্রের মতো ভাল বন্ধু কিন্তু পাহাড় হতে পারে না” কথাটাকে সেদিন বিশেষ আমলও না দিলেও, একপেশে পাহাড়প্রেমী আমিও এই বন্ধুত্বকে তাজপুরে উপলব্ধি করলাম। অন্যভাবে।
সমু্দ্র এর আগেও দেখেছি পুরীতে, গোয়াতে পরে মুম্বইয়ের মেরিন ড্রাইভে, কখনওই তার বাহারি জৌলুসে এতটা মোহিত হয়নি। কিন্তু ওইদিন বেশ অন্যরকম মনে হয়েছিল তাজপুর গিয়ে। কী আছে ছোট্ট ওই সমুদ্রটাতে? যেখানে ভাটার টানে সমুদ্র প্রায় মিশে রায় দিগন্তরেখায়। যেখানে নেই সমুদ্রের উদ্দাম গর্জন, নেই বাহ্যিক সফেদ ফেনার বাহারি প্রদর্শন। তাহলে? আসলে যা আছে তা হল একান্ত আপন করে নেওয়ার চেষ্টা। বন্ধু হয়ে ওঠার একটা প্রচেষ্টা। দীঘার সুবিস্তৃত সৈকতসজ্জার থেকে বেশ অনেকটা দূরে কিছুটা যেন রূপকথার গল্পের দুয়োরানির মতো ছোট কুটিরঘর তৈরি করে রয়েছে তাজপুর সমুদ্রসৈকতটি।
রাত সাড়ে দশটা নাগাদ একটা ছোট জঙ্গলের রাস্তা পেরিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। সারাদিনের ক্লান্তি আর সকালের ট্রেন ধরবার চিন্তায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল নেই। তবে ওই একদিনেই আমার সঙ্গে সমুদ্রের জমাটি আলাপ সেরে নেওয়ার পর্বটা নেহাতই মন্দ ছিল না। পরদিন ভোরেই যখন আবার সদ্য পাতানো নতুন বন্ধুটির সঙ্গে দেখা হয়েছে, দেখলাম আগের দিনের ভাটার জড়তা কাটিয়ে সে আবারও এক তরতাজা নতুন প্রাণ। এবারও দিব্যি আমার পা-এ জল ছুঁয়ে নিজের উজ্জ্বল উপস্থিতিটুকু জানান দিয়ে চলে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা বন্দী হল নানা মুহূর্ত। হোটেলে ফিরে ব্রেকফাস্ট শেষ করেই শুরু হল আমাদের কলকাতা ফিরে আসার প্রস্তুতি।
কলকাতা ফিরেছিলাম দীঘা হয়ে, দীঘার ওই একরাশ কোলাহলের মাঝে হঠাৎ করে পৌঁছে মনে হয়েছিল যেন একটা গোটারাত কোনও বিচ্ছিন্ন দ্বীপেই কাটিয়েছিলাম আমরা। কলকাতা পোঁছে গতানুগতিক হাজারও কাজের ভিড়ে নতুন বন্ধুটার কথা আর মনে পড়েনি সেভাবে।
তবে ঘরবন্দি এই দশাতে, অনুজীবেদের সঙ্গে নিয়ত প্রাণযুদ্ধের লড়াই চালাতে চালাতে আজ আবারও মনে পড়ছে তাকে। তাঁর ওই মৃদু-মন্দ গর্জন, নোনা হাওয়া সবটুকু যেন প্রযুক্তির কঠিন বেড়াজালকে কাটিয়ে আমাকে নিয়ে চলেছে সেই ফেলে আসা সময়টাতে।