২০১৯ সালে আমাদের বেশ অনেকগুলির স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। নরওয়ের উত্তররীয় আলোকশোভা, ট্রেন যাত্রার সাহায্যে সুইস আল্পসের সৌন্দর্য, আইফেল টাওয়ারে একটা সন্ধ্যে কাটানোর মুহুর্ত ইত্যাদি রোমাঞ্চকর স্বপ্নগুলি সার্থক হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রাগের ওয়াকিং স্ট্রিটে ভ্রমণ, স্পেনের ফ্ল্যামিং ফ্লেমেনকো সুরে নেচে ওঠা, ক্রুজে চেপে স্ক্যান্ডিনাভিয়ান দেশ ভ্রমণের মতো ইউরোপ ট্যুরের অভিজ্ঞতাটা ও বেশ অসাধারণ ছিল ।
২০১৯ সালে আমাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা - ২০১৯ সালটি আমাদের কাছে স্মরণীয় সাল। নানা শুধুমাত্র অনেক দেশ ভ্রমণ করেছি বলে নয়, অনেক অভিজ্ঞতা সাক্ষী হয়েছে, যেগুলি সত্যি কোনো দিনই ভোলার নয়। আমরা খুবই সৌভাগ্যশালী যে আমরা কোভিড - ১৯ এর পূর্বেই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভ্রমণস্থান গুলি দর্শন করেছি। তবে এই ভ্রমণের সূচনা হয়েছিল নরওয়ে থেকে। নরওয়েতে থেকে কাছাকাছি শহর দর্শন করার মধ্যে দিয়েই এই যাত্রার সূচনা হয় এবং সেখান থেকেই সম্পূর্ণ ইউরোপ ভ্রমণ করি । নিয়ম অনুযায়ী আমাদের বছরে ২৫ টি ছুটি প্রাপ্য ছিল এবং এই ছোট্ট ছুটির সাহায্যেই গোটা ইউরোপ ভ্রমণের পরিকল্পনা করি।
আমরা কিভাবে এক বছরের মধ্যে ১৭ টি দেশ ভ্রমণ করলাম?
৯টা থেকে ৫ টা অফিস করে ট্রাভেল করা মোটেই সহজসাধ্য বিষয় নয়। তবে আপনার যদি কোনো বিষয়ের প্রতি যদি প্যাশন থাকে, তাহলে সেই বিষয়টি পূরণ হবেই।
১. ভ্রমণের প্রতি আগ্রহ - ভ্রমণের প্রতি আমাদের অগ্রাধিকার সবচেয়ে প্রথমে। আমরা জীবনের বিশেষ দিনগুলিতে রেস্তোরাঁতে খেতে গিয়ে টাকা খরচ করার বদলে, এই রকমই বিশেষ দিনে উইকএন্ড গেটওয়ের প্ল্যান করি।
২. ভ্রমণ সম্পর্কে সূক্ষ পরিকল্পনার প্রয়োজন - আমাদের হাতে মাত্র ২৫ টি ছুটি রয়েছে, তাই এই ছুটিকে কাজে লাগানোর জন্য পরিকল্পনার প্রয়োজন। তাই ভ্রমণ তালিকাটি ছোট ছোট খন্ডে বিভক্ত করে পাবলিক হলিডে কিংবা উইকএন্ড গুলির সাথে সংঘবদ্ধ করে নিই । সব ছুটি মিলিয়ে আমাদের কাছে ছিল মোট ৫৬টি ছুটির দিন।
৩. নিখুঁত গবেষণা - যেহেতু ভ্রমণের প্রতি আমাদের উৎসাহ থাকে প্রচুর, তাই প্রতিটি স্থান ভ্রমণের আগে সেই নির্দিষ্ট স্থানটির বিষয়ে একটু রিসার্চ করে নিই। এই রিসার্চ এর ফলে ভ্রমণটা ও বেশ সুবিধাজনক হয়। কোনো মনুমেন্ট দর্শনের সময় সারণী বা ঠিক কোন সময় মনুমেন্ট দর্শনে গেলে বিনামূল্যে সেই মনুমেন্টটি দর্শন করতে পারব এই বিষয় গুলি নিয়েই আমরা রিসার্চ করতাম।
আমরা প্রথম থেকেই মাদ্রিদ ভ্রমণে গিয়ে প্রাদ মিউজিয়াম দর্শন করব বলে মনস্থির করছিলাম। এই মিউজিয়ামে প্রতিদিন ২ঘন্টার জন্য প্রবেশমূল্যের প্রয়োজন হয়না, তাই সেই সময় অনুযায়ী আমাদের ভ্রমণের তালিকাটি সাজিয়ে ছিলাম।
বিঃদ্রঃ - পর্যটনের জন্য ইউরোপের মিউজিয়াম গুলিতে একটা গোটা দিন বা প্রতিদিন ২ বা ৩ঘন্টার জন্য বিনামূল্যে প্রবেশ করা যায়।
রিসার্চ করে আমি জানতে পেরেছিলাম ইউরোপের কিছু কিছু দেশে পর্যটকদের অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে প্যারিস শহরটি বেশ জনপ্রিয়, কিন্তু এই শহরে অনেক ধরণের কেলেঙ্কারি ও হয়। আমরা গাড়িতে উঠবো বলে টিকিট কাটছি, ঠিক সেই সময়ে পুলিশের লোক সেজে আমাদের সামনে এলো। আমাদের কার্ড থেকে কয়েকটি টিকিট কেটে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছিল। ঠিক সেই সময়ে দ্য মেট্রো হেল্পার স্ক্যামের কথা আমার মনে পড়ে এবং আমরা নিজেরা সর্তক হয়ে যাই। এই রিসার্চ এর জন্য আমরা প্রায় ১০০ ইউরো বাঁচাতে পেরেছি।
বিঃদ্রঃ- অন্য দেশ ভ্রমণে গিয়ে এই ধরণের স্ক্যামের কথা মাথায় রাখবেন।
৪. সঞ্চয়ী ক্ষমতা - আমরা কিছু কিছু ট্রিপের জন্য অ্যাডভান্স বুক করে রেখেছিলাম। আমরা সাধারণত আগে থেকে বিমান বা অন্যান্য ট্রান্সপোর্টের ভাড়ার তালিকাটি চেক করতাম। তাই যেদিন ভাড়া কম থাকত সেই দিনেই টিকিট কাটতাম।
এই প্ল্যান সহযোগে আমরা নরওয়ে থেকে জার্মানি যাত্রার জন্য বিমান টিকিট কেটেছি মাত্র ৩৫০০ টাকায়। এছাড়াও নরওয়ে থেকে ডেনমার্ক যাত্রার জন্য ও ক্রুজ ভাড়া পেয়েছি মাত্র ৫০০ টাকায়। তাই আমার মনে হয় একটু ভেবেচিন্তে প্ল্যান করলে বেশ অনেকটা টাকা ও সঞ্চয় করা যায়।
৫. বার্ষিক ভ্রমণের জন্য পুংখ্যানুপুংখ পরিকল্পনার প্রয়োজন - ইউরোপের পারিপার্শ্বিক দেশগুলি ভ্রমণের জন্য প্রায় ২সপ্তাহ ছুটি নিই। এই দুই সপ্তাহের যাত্রায় আমরা সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, লাক্সমবার্গ ভ্রমণ করি।
এই লম্বা ট্রিপের আয়োজন করার জন্য আমরা অনেক টাকা সঞ্চয় করতে পারি। যদি আমরা এই দেশগুলি ভ্রমণের জন্য টুকরো টুকরো ভাগে বিভক্ত করতাম, তাহলে অনেক টাকা খরচ হয়ে যেত। এছাড়াও একটা দেশ থেকে অন্য দেশে যাত্রা করার অন্য আমরা বাস জার্নি করি। তবে কম খরচে ইউরোপ ট্রাভেল করার জন্য ফ্লিক্সবাস সার্ভিসটি আদৰ্শ।
৬. অফটাইমে ট্রাভেল প্ল্যান
আমরা কিছু কিছু স্থানে অফসেশন -এ ভ্রমণ করছি। যার জন্য বেশ অনেক টাকা বাঁচাতে পেরেছি এবং পর্যটকদের ভিড় কম থাকায় আমরা ভালোভাবে ঘুরতে ও পেরেছি ।যেমন সুইজেরল্যান্ডে আমরা অক্টোবর মাসে ভ্রমণ করার জন্য বরফে আবৃত পাহাড়ের সাথে সাথে এবং সবুজের আবরণে সুইস গ্রামগুলির সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করেছি।
বিঃদ্রঃ - অফ সেশনে ভ্রমণ করলে টিকিট ভাড়া, হোটেল খরচ কম হয় ।
৭. খরচে বাঁধন
আমরা অবশ্যই ভ্রমণ করতে ভালোবাসি, তার মানে কিন্তু ভ্রমণের জন্য সমস্ত অর্থ উড়িয়ে দেওয়া নয়। আমাদের ভ্রমণের ক্ষেত্রে বাজেট প্ল্যান করা অসম্ভব ছিল, তাই খরচে মধ্যে বাঁধনের বিষয়ে আমরা বিশেষভাবে নজর দিই। আমাদের প্রতিদিনের খরচের মধ্যে থাকা, খাওয়া, এবং ট্রান্সপোর্ট খরচই অন্তর্ভূক্ত ছিল।
৮. মূল দেশ অন্নেষণ
আমরা প্রায় ১ বছরের জন্য ওসলোতে ছিলাম, তাই স্থানীয় মানুষদের কাছ থেকে ওসলোর যে দর্শনীয় স্থানগুলি সম্পর্কে জেনেছিলাম সেগুলি সবই দর্শন করেছিলাম। ওসলোতে ও একদিন একটি মিউজিয়াম আছে যেটি বিনামূল্যে দর্শন করা যায়। আর ভিসিট ইওর ওন সিটি কার্ড এর সুযোগে নরওয়ের দর্শনীয় স্থান গুলিও ভ্রমণ করে নিলাম।
৯. উইকেন্ড ট্রাভেল- ইউরোপের দেশগুলিতে বিমানে যেতে সময় লাগে ২- ৩ ঘন্টার মতো । তাই উইকএন্ড ছুটি নিয়ে সব গুলির দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।
১০. ঘুমকে বলুন গুডবাই - এই দেশগুলি ভ্রমণের জন্য এবং বাজেট ফ্রেন্ডলি ভ্রমণের জন্য আমাদের গভীর রাতের অথবা ভোরের বিমান ধরার প্রয়োজন হতো। তাই আমরা বিমানেই ঘুমিয়ে নিতাম। আর এই কারণেই ভ্রমণের জন্য ঘুমকে গুড বাই বলতেই হবে।
ভিসার প্রয়োজনীয়তা - আমরা যেহেতু প্রায় ১বছর নরওয়েতেই চাকরি করতাম, তাই ওখানে রেসিডেন্টস পার্মিট ছিল এবং ইউরোপের দেশগুলি ভ্রমণের জন্য সচেঞ্জ ভিসার প্রয়োজন হতো।
আমাদের ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা - আমাদের ইউরোপ যাত্রা শুরু হয়, যখন আমরা নরওয়ে পৌঁছাই। রেসিডেন্টস পার্মিটের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হলে, আমরা ওসলো দর্শনে বেরিয়ে পড়ি। যখন আমরা রেসিডেন্টস পার্মিট পেয়ে যাই, এরপর আমরা সম্পূর্ণ ইউরোপ দর্শনের উদ্দেশ্যে বেরোই।আমাদের প্রথম যাত্রা ছিল জার্মানি।
আমাদের যাত্রা বিবরণী -
ট্রিপ ১- নরওয়ে - জার্মানি
ট্রিপ ২- নরওয়ে - স্পেন
ট্রিপ ৩- নরওয়ে - ইটালি এবং ভাটিক্যান সিটি
ট্রিপ ৪- নরওয়ে - অস্ট্রেয়া - হ্যাঙ্গেরি
ট্রিপ ৫- নরওয়ে - ডেনমার্ক
ট্রিপ ৬- নরওয়ে - সুইডেন
ট্রিপ ৭- নরওয়ে - পোল্যান্ড - স্লোভাকিয়া - চেক রিপাবলিক
ট্রিপ ৮- নরওয়ে - সুইজারল্যান্ড - ফ্রান্স - বেলজিয়াম - লাক্সমবার্গ- আমাস্টারডাম ছাড়াও আমরা নরওয়ের অন্যান্য অঞ্চলগুলিও ভ্রমণ করি।
ভ্রমণের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন -
১. সমস্ত দেশের ম্যাপ ফোনে ডাউনলোড করে রাখা দরকার।
২. মোবাইল নেটওয়ার্ক সম্পর্কে আগে থেকে রিসার্চ করার দরকার। প্রয়োজন হলে আলাদা ভাবে মডেম কিনে রাখুন।
৩. প্রত্যেকটা দেশের ভাষা কিছুটা হলেও জেনে নিন।
৪. যে দেশে বেড়াতে যাচ্ছেন ফোনে সেই দেশের ট্রান্সপোর্ট অ্যাপটি ডাউনলোড করে রাখুন।
৫. আমরা বেড়াতে যাওয়ার আগে থেকেই নির্দিষ্ট দেশের হোস্টেল ভাড়া করে নিতাম।
নতুন দেশে ভ্রমণ করা, নতুন খাবার চেখে দেখা এবং নতুন মানুষদের সাথে আলাপচারিতা করার বিষয়টা খুবই রোমাঞ্চকর।
৯টা থেকে ৫টা অফিস করা মানে কিন্ত বিশ্ব দর্শনের ইচ্ছা ভুলে যাওয়া নয়। ইচ্ছা থাকলেই মনের ইচ্ছা পূরণ করা সম্ভব।
আপনিও কি চাকরি করে ভ্রমণের ইচ্ছা সম্পন্ন করছেন? তাহলে
আপনি কীভাবে ভ্রমণের জন্য পরিকল্পনা করেন আমাদের লিখে জানান।